আল্লাহ তাআলার আরশে ইস্তিওয়া ও সৃষ্টিকুল থেকে সুউচ্চ হওয়া বিষয়ে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের সালাফুস সালিহীনের আকীদাহ পর্ব: ২

بسم الله الرحمن الرحيم

এই প্রবন্ধে যা আলোচনা করা হবে তা হচ্ছে:

১) আল্লাহ তাআলার আরশে সমুন্নত হওয়া ও সৃষ্টিকুল থেকে সুউচ্চ হওয়ার ব্যাপারে সালাফুস সালিহীনের উদ্ধৃতি।

২) সালাফুস সালিহীনের পর যেসব আলিমগণের আবির্ভাব ঘটেছে, এই আকিদার ব্যাপারে তাঁদের সাক্ষ্য। অর্থাৎ এই আকিদাটি যে সালাফুস সালিহীনের আকিদাহ এবং আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকিদাহ সে বিষয়ে তাঁদের বক্তব্য।

সালাফের উদ্ধৃতিসমূহ তাঁদের মৃত্যু সালের ক্রম অনুযায়ী সাজানো হয়েছে। 

সালাফুস সালিহীনের উদ্ধৃতি: 

সাহাবীদের [রা.] বক্তব্য: 

১) আবু বাকর আস সিদ্দীক [রা.]: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মারা যাবার পর লোকজন যখন আপ্লুত হয়ে ছিল তখন আবু বাকর [রা.]  মিম্বরে আরোহণ করলেন। এরপর আল্লাহ তাআলার প্রশংসা ও স্তুতি বর্ণনা করে বললেন, 

  أيها الناس! إن كان محمدٌ إلهكم الذي تعبدون فإن إلهكم محمدًا قد مات، وإن كان إلهكم الذي في السماء فإن إلهكم لم يمت

“হে লোকসকল, যদি মুহাম্মাদ তোমাদের ইলাহ হয়ে থাকেন, যার ইবাদাত তোমরা করতে, (তাহলে জেনে রাখো) মুহাম্মাদ মারা গিয়েছেন। আর যদি তোমাদের ইলাহ তিনি হয়ে থাকেন যিনি আসমানে রয়েছেন (তাহলে জেনে রাখো) তোমাদের ইলাহ কখনো মারা যাবেন না”। এরপর তিনি তিলাওয়াত করলেন- وَمَا مُحَمَّدٌ إِلَّا رَسُولٌ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ الرُّسُلُ أَفَإِنْ مَاتَ أَوْ قُتِلَ انْقَلَبْتُمْ عَلَى أَعْقَابِكُمْ

‘আর মুহাম্মদ একজন রাসূল মাত্র; তার আগে বহু রাসূল গত হয়েছেন। কাজেই যদি তিনি মারা যান বা নিহত হন তবে কি তোমরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে?’”।

২) আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ [রা.]: তিনি বলেন,

بين سماء الدنيا والتي تليها مسيرة خمس مئة عام، وبين كل سماءين مسيرة خمس مئة عام، وبين السماء السابعة وبين الكرسي مسيرة خمس مئة عام، وبين الكرسي وبين الماء مسيرة خمس مئة عام، والعرش فوق الماء، والله تبارك وتعالى فوق العرش، وهو يعلم ما أنتم عليه

“দুনিয়ার আসমান ও তার নিকটবর্তী আসমানের মধ্যে পাঁচ শত বছরের ভ্রমণ দূরত্ব রয়েছে। প্রত্যেক দুই আসমানের মধ্যে পাঁচ শত বছরের ভ্রমণ দূরত্ব রয়েছে। সপ্তম আসমান ও কুরসীর মধ্যে পাঁচ শত বছরের ভ্রমণ দূরত্ব রয়েছে। কুরসী ও পানির মধ্যে পাঁচ শত বছরের ভ্রমণ দূরত্ব রয়েছে। আর আরশ রয়েছে পানির ওপরে। আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তাআলা রয়েছেন আরশের ওপরে। (সেখান থেকে) তোমরা যা করছ সেসব তিনি জানেন”। 

অপর বর্ণনায় রয়েছে, তিনি বলেন, ‌وَالْعَرْشُ ‌فَوْقَ ‌الْمَاءِ، ‌وَاللَّهُ ‌فَوْقَ ‌الْعَرْشِ، وَمَا يَخْفَى عَلَيْهِ مِنْ أَمْرِكُمْ شَيْءٌ

“আর আরশ রয়েছে পানির ওপর। আল্লাহ আছেন আরশের ওপর। তোমাদের কোনো কাজই তাঁর কাছে (সেখানে) গোপন থাকে না”।

৩) উম্মুল মুমিনীন যায়নাব বিন্ত জাহাশ [রা.]: তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্যান্য স্ত্রীদের ওপর গর্ব করে বলতেন,

زَوَّجَكُنَّ ‌أَهَالِيكُنَّ، وَزَوَّجَنِي اللهُ تَعَالَى مِنْ فَوْقِ سَبْعِ سَمَاوَاتٍ

“তোমাদেরকে তোমাদের পরিবার বিয়ে দিয়েছে, আর আমাকে আল্লাহ তাআলা সাত আসমানের ওপর থেকে বিয়ে দিয়েছেন”।

৪) আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস [রা.]: উম্মুল মু’মিনিন আইশাহ [রা.] যখন মৃত্যু শয্যায় তখন তাঁকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস [রা.] বেশ কিছু কথা বলেন। তার মধ্যে এও বলেন: ‌وَأَنْزَلَ ‌اللهُ ‌بَرَاءَتَكِ ‌مِنْ ‌فَوْقِ ‌سَبْعِ سَمَاوَاتٍ، جَاءَ بِهِ الرُّوحُ الْأَمِينُ

“আর আল্লাহ আপনার পবিত্রতার কথা সাত আসমানের ওপর থেকে নাযিল করেছেন, যা রূহুল আমীন নিয়ে এসেছেন”।

অপর বর্ণনায় রয়েছে, তিনি বলেন, «‌إن [‌الله] ‌كان ‌على ‌عرشه ‌قبل ‌أن ‌يخلق شيئا

“কোনো কিছু সৃষ্টি করার পূর্বে আল্লাহ আরশের ওপর ছিলেন”।

২০০ হিজরি পর্যন্ত সাহাবাদের পরবর্তী প্রজন্মের বক্তব্য: 

৫) ইমাম ইবন ইসহাক [রাহ.]: ইমাম ইবন ইসহাক [রাহ.] কে বলা হয় ইমামুল মাগাযী তথা সিরাতের ইমাম। মূলত সিরাত শাস্ত্রের বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধন তাঁরই হাত ধরে হয়। তিনি ১৫০ হিজরিতে মারা যান। তিনি বলেন, 

“আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তাআলা স্বীয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলেছেন-

إِنَّ رَبَّكُمُ ٱللَّهُ ٱلَّذِی خَلَقَ ٱلسَّمَـٰوَ ٰ⁠تِ وَٱلۡأَرۡضَ فِی سِتَّةِ أَیَّامࣲ ثُمَّ ٱسۡتَوَىٰ عَلَى ٱلۡعَرۡشِۖ

‘নিশ্চয় তোমাদের রব আসমানসমূহ ও যমীন ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আরশে সমুন্নত হয়েছেন’।

وَهُوَ ٱلَّذِی خَلَقَ ٱلسَّمَـٰوَ ٰ⁠تِ وَٱلۡأَرۡضَ فِی سِتَّةِ أَیَّامࣲ وَكَانَ عَرۡشُهُۥ عَلَى ٱلۡمَاۤءِ

‘আর তিনিই আসমানসমূহ ও যমীন সৃষ্টি করেছেন ছয় দিনে, আর তাঁর আরশ ছিল পানির উপর’।

তিনি তাবারাকা ওয়া তাআলা নিজেকে যেভাবে এসব গুণে বিভূষিত করেছেন তিনি তেমনই। আরশ কেবল পানির ওপরই ছিল। আর আরশের ওপর (وَعَلَى الْعَرْشِ) আছেন মহিমাময়, মহা সম্মানিত, ক্ষমতা, রাজত্ব, শক্তি ও সহনশীলতার অধিকারী, জ্ঞান, রহমত ও নিয়ামতের অধিকারী মহান সত্ত্বা। যিনি যা চান তাই করেন। যিনি একক-অদ্বিতীয়, অমুখাপেক্ষী। যিনি কাউকে জন্ম দেন নি, তাঁকেও জন্ম দেয়া হয়নি। যার সমকক্ষ আর কেউ নেই”। 

৬) ইমাম আবু হানিফাহ নু’মান বিন সাবিত [রাহ.]: ইমাম আবু হানিফাহ [রাহ.] পরিচয়ের মুখাপেক্ষী নন। তিনি হানাফী ফিকহের প্রতিষ্ঠাতা, ফিকহের প্রসিদ্ধতম ইমামগণের একজন। তিনি বলেন,

من قَالَ لَا اعرف رَبِّي فِي السَّمَاء اَوْ فِي الأَرْض فقد كفر وَكَذَا من قَالَ إِنَّه على الْعَرْش وَلَا ادري الْعَرْش أَفِي السَّمَاء اَوْ فِي الأَرْض

“যে এটা বলে যে আমি জানি না আমার রব কি আসমানে আছেন নাকি যমিনে আছেন, সে কুফরি করে। একইভাবে যে বলে যে তিনি আরশে আছে (ঠিক) তবে আমি জানি না যে আরশ কি আসমানে নাকি যমিনে (সেও কুফরি করে)”। 

অপর বর্ণনায় রয়েছে যে তিনি বলেন, ‌من ‌أنكر ‌أن ‌الله ‌في ‌السماء ‌فقد ‌كفر

“যে এটা অস্বীকার করে যে আল্লাহ আসমানে আছেন, সে কুফরি করে”।

ইমাম তহাউই [রাহ.] তাঁর প্রসিদ্ধ “আকিদার” শুরুতে উল্লেখ করেছেন, 

‌‌هذا ذكر بيان عقيدة أهل السنة والجماعة على مذهب فقهاء الملة أبي حنيفة النعمان بن ثابت الكوفي وأبي يوسف يعقوب بن إبراهيم الأنصاري وأبي عبد الله محمد بن الحسن الشيباني رضوان الله عليهم أجمعين

“এই পুস্তিকায় আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকিদাহ বর্ণনা করা হয়েছে এই উম্মতের ফুকাহা আবু হানিফাহ আন নু’মান বিন সাবিত আল কূফী, আবু ইউসুফ ইয়া’কুব বিন ইবরাহীম আল আনসারী ও আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন আল হাসান আশ শাইবানীর (আল্লাহ তাঁদের সবার প্রতি সন্তুষ্ট হন) মাযহাব অনুযায়ী”। 

কাজেই ইমাম তহাউই [রাহ.] এখানে যে আকিদাহ উল্লেখ করেছেন তা উনার ভাষ্যমতে উক্ত তিন মহান ইমামের আকিদার প্রতিনিধিত্ব করে। ইমাম তাহাউই [রাহ.] লিখেছেন, 

والعرش والكرسي حق

“আরশ ও কুরসি হক।”

وهو مستغن عن العرش وما دونه

“তিনি আরশ ও আরশ ব্যতীত অন্য সব কিছু থেকেই অমুখাপেক্ষী”।

مُحِيطٌ بِكُلِّ شَيْءٍ وَفَوْقَهُ

“তিনি সবকিছু পরিবেষ্টন করে আছেন এবং সবকিছুর ঊর্ধ্বে আছেন”।

এই লাইনের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবন আবিল ইয [রাহ.] বলেন, 

“এর অর্থ হচ্ছে ১) আল্লাহ তাআলা সবকিছু পরিবেষ্টন করে আছেন এবং সবকিছুর ঊর্ধ্বে আছেন।

২) তিনি আরশের ওপরে থেকে সবকিছু পরিবেষ্টন করে আছেন”। 

এথেকে বোঝা যায় যে আল্লাহ তাআলা যে আরশের ওপর সমুন্নত এটা ইমাম আবু হানিফাহ, আবু ইউসুফ ও মুহাম্মাদ বিন হাসানের [রাহ.] সমন্বিত আকিদাহ। 

৭) ইমাম মালিক বিন আনাস [রাহ.]: 

ইমামু দারিল হিজরাহ ইমাম মালিক বিন আনাস [রাহ.] মালিকী মাযহাবের মূল ব্যক্তিত্ব। তিনি ১৭৯ হিজরিতে মারা যান। 

একবার একজন লোক তাঁর কাছে এসে প্রশ্ন করলো, “হে আবু আব্দুল্লাহ (তাঁর উপনাম এটা), الرحمن على العرش استوى ‘দয়াময় আরশে সমুন্নত হলেন’, 

فكيف استوى

তিনি কিভাবে সমুন্নত হলেন?”

অর্থাৎ তার প্রশ্ন ছিল এই সমুন্নত হবার স্বরূপ বা ধরণটা কেমন বা কী? 

প্রশ্ন শুনে ইমাম মালিক [রাহ.] মাথা নিচু করে বসে রইলেন, এক পর্যায়ে তিনি ঘেমে উঠলেন। অতঃপর বললেন, 

الإستواء غير مجهول، والكيف غير معقول، والإيمان به واجب، والسؤال عنه بدعة، وما أراك إلا مبتدعا

“ইস্তিওয়া বা সমুন্নত হওয়া (শব্দটির অর্থ) আমাদের কাছে অজ্ঞাত নয় ( আমরা এর অর্থ জানি)। তবে (আল্লাহর ক্ষেত্রে) এর স্বরূপ আমাদের বোধের ঊর্ধ্বে। এর ওপর ঈমান রাখা ওয়াজিব বা আবশ্যক। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা বিদআত। আমি তো দেখছি, তুমি একজন বিদআতী”। এরপর তিনি এই প্রশ্নকারী লোককে মজলিস থেকে বের করে দিতে বললেন। 

এই উক্তিটি ইমাম মালিক [রাহ.] থেকে একাধিক সনদে কিছুটা শাব্দিক পার্থক্যসহ বর্ণিত আছে। অপর এক বর্ণনায় রয়েছে যে ইমাম মালিক [রাহ.] উত্তরের বলেন, 

الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى كَمَا وَصَفَ نَفْسَهُ، ‌وَلَا ‌يُقَالُ: ‌كَيْفَ، ‌وَكَيْفٌ ‌عَنْهُ ‌مَرْفُوعٌ، وَأَنْتَ رَجُلُ سُوءٍ صَاحِبُ بِدْعَةٍ، أَخْرِجُوهُ

“দয়াময় আরশে সেভাবেই সমুন্নত হয়েছেন যেভাবে তিনি (আয়াতে) নিজেকে বিভূষিত করেছেন। এটা বলা যাবে না যে কিভাবে সমুন্নত হলেন। এটাও বলা যাবে না যে তিনি কিভাবে আরশে সুউচ্চ হলেন। তুমি একজন খারাপ লোক, বিদআতী লোক। (অন্যদের বললেন) তোমরা একে বের করে দাও।” এরপর সেই লোককে বের করে দেয়া হল।

মালিকী মাযহাবের প্রসিদ্ধ ইমাম, ইমাম আবু বাকর ইবনুল আরাবী আল মালিকী [রাহ.] সিফাত বিষয়ক হাদিস বর্ণনার এক পর্যায়ে এই বিষয়ে ইমাম মালিকের [রাহ.] মাযহাব বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, 

ومذهب مالك رحمه الله أن كل حديث منها معلوم المعنى ولذلك قال للذي سأله: “الإستواء معلوم والكيفية مجهولة

“মালিক রাহিমাহুল্লাহ-এর মাযহাব হচ্ছে সিফাত বিষয়ক সকল হাদিসের অর্থ জ্ঞাত বিষয় (অর্থাৎ আমরা শব্দগুলোর অর্থ জানি)। এজন্যই যে ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিল তাকে তিনি বলেছিলেন, আল ইস্তিওয়া বা সমুন্নত হওয়া তো (শব্দ ও অর্থ হিসেবে) জানা আছে। তবে (আল্লাহর সাপেক্ষে) এর স্বরূপ অজ্ঞাত”।

ইমাম মালিক [রাহ.] আরও বলেছেন, ‌اللَّه ‌في ‌السماء ‌وعلمه ‌في ‌كل ‌مكان ‌لا ‌يخلو ‌منه ‌شيء

“আল্লাহ তাআলা আসমানে রয়েছেন, আর তার ইলম রয়েছে সর্বত্র। কোনো কিছুই তাঁর ইলমের বাইরে নয়”।

ইমাম মালিক [রাহ.] যে এই আকিদাহ পোষণ করতেন, আল্লাহ আরশে সমুন্নত, এর স্বপক্ষে আরও বেশ কয়েকজন ইমামদের সাক্ষ্য পাওয়া যায়, যেমন ইমাম আবু হাতিম আর রাযী রাহ. [মৃত্যু ২৭৭ হি.], ইমাম আবু যাইদ আল কাইরাওয়ানী রাহ. [মৃত্যু ৩৮৬ হি.], ইমাম মুহাম্মাদ বিন মাউহাব আল মালিকী রাহ. [মৃত্যু ৪০৬ হি.], ইমাম আবুল কাসিম আল লালিকাঈ রাহ. [মৃত্যু ৪১৮ হি.], ইমাম আবু নাসর আস সাজযী রাহ. [মৃত্যু ৪৪৪ হি.] প্রমুখ। ইন শা আল্লাহ সামনে তাঁদের বক্তব্যও আলোচিত হবে।

৮) ইমাম হাম্মাদ বিন যাইদ [রাহ.]: হাম্মাদ বিন যাইদ আল বাসরী [রাহ.] ছিলেন ইলমে হাদিসের একজন সুমহান ইমাম। তিনি ১৭৯ হিজরিতে মারা যান। তিনি বলেন, 

(إنما يدورون على أن يقولوا: ليس في السماء إله) يعني الجهمية.

“তাদের অর্থাৎ জাহমিয়্যাদের কথা এই বক্তব্যকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে যে তারা বলে, আসমানে ইলাহ নেই”। 

অর্থাৎ এভাবে তিনি জাহমিয়্যাদের দাবি খণ্ডন করে বিপরীতভাবে বোঝালেন যে আল্লাহ আসমানের ওপারে আরশে সমুন্নত রয়েছেন। 

৯) ইমাম ইবনুল মুবারাক [রাহ.]: আলী বিন আল হাসান বিন শাকীক [রাহ.] বলেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাককে [রাহ.] জিজ্ঞেস করলাম, আমারা আমাদের রবকে আযযা ওয়া জাল্ল কিভাবে চিনবো?” (অর্থাৎ আমরা আমাদের অন্তরে তাঁর পরিচয়ের ব্যাপারে কী ধারণা পোষণ করব?)

ইবনুল মুবারাক [রাহ.] উত্তরে বললেন, 

 على السماء السابعة على عرشه، ولا نقول كما تقول الجهمية: أنه ها هنا في الأرض

“(আমরা এভাবে চিনবো যে) তিনি সপ্তম আসমানের ওপারে আরশের ওপর রয়েছেন। আমরা জাহমিয়্যাদের মত বলবো না যে, তিনি এখানে এই পৃথিবীতেই আছেন”।

অপর এক বর্ণনায় আছে যে তিনি বলেন, بأنه فوق السماء السابعة على العرش بائن من خلقه

“(আমরা তাঁকে এভাবে চিনবো যে) তিনি সৃষ্টিকুল থেকে পৃথক হয়ে সপ্তম আসমানের ওপারে আরশের ওপর রয়েছেন”। 

১০) ইমাম জারীর বিন আব্দিল হামীদ আদ দ্বাব্বী [রাহ.]: জারীর বিন আব্দিল হামীদ ছিলেন ইমাম, হাফিযুল হাদিস ও বিচারক। তিনি ১৮৮ হিজরিতে মারা যান। তিনি বলেন, 

‌كَلَام ‌الْجَهْمِية ‌أَوله ‌عسل ‌وَآخره ‌سم وَإِنَّمَا يحاولون أَن يَقُولُوا لَيْسَ فِي السَّمَاء إِلَه

“জাহমিয়্যাদের কথার প্রথম অংশ মধু আর শেষাংশ বিষ। তারা কেবল এটা বলার চেষ্টা করতে থাকে যে, আসমানে কোনো ইলাহ নেই”।

এই উক্তি থেকে এটা বোঝা গেল যে, আল্লাহ তাআলা সাত আসমানের ওপারে আরশে আযীমের ওপরে সমুন্নত নেই বা তিনি কোথাও নেই- এই ধরণের কথা মূলত জাহমিয়্যাদের কথা। একই সাথে এই কথাও জাহমিয়্যাদের বক্তব্যের অনুরূপ যে আল্লাহ আসমানে আছেন বা আরশে আছেন তা বলা যাবে না। 

১১) আবু মুআয খালিদ বিন সুলাইমান আল বালখী [রাহ.]: তিনি ছিলেন হানাফী মাযহাবের প্রাথমিক যুগের প্রসিদ্ধ ইমামদের একজন, যিনি হানাফী মাযহাবের ওপর ফাতাওয়া দেবার অধিকারপ্রাপ্ত ছিলেন। ইমাম মালিক ও সুফইয়ান আস সাওরী [রাহ.] থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। ১৯৯ হিজরিতে মারা যান।

তিনি ফারগানায়, যা বর্তমান পূর্ব উজবেকিস্তানে অবস্থিত, এক ভাষণে বলেন,

كان جهم على معبر ترمذ، وكان فصيح اللسان، [و] لم يكن له علم ولا مجالسة أهل العلم، فكلم السُمَنية، فقالوا له: صف لنا ربك الذي تعبده. فدخل البيت لا يخرج

ثم خرج إليهم بعد أيام فقال: هو هذا الهواء مع كل شيء، وفي كل شيء، ولا يخلو منه شيء”. قال أبو معاذ: “كذب عدو الله، إن الله في السماء على العرش كما وصف نفسه

“জাহম ছিল তিরমিযের (আমু দরিয়ার) নদীর পড়ের লোক। সে ছিল বাগ্মী লোক। তবে তার নিজের তো ইলম ছিল না, সে আলিমদের সাহচর্যও গ্রহণ করেনি। অথচ সে বৌদ্ধ শ্রমণদের সাথে বিতর্ক করতে গিয়েছিল। যখন শ্রমণরা তাকে বলল, যে রবের তুমি ইবাদাত কর, তাঁর বৈশিষ্ট্য/গুণ আমাদের কাছে বর্ণনা কর। 

(এই প্রশ্ন শুনে) সে বাড়িতে প্রবেশ করলো, (এরপর কিছুকাল) বাইরে বের হল না। 

কিছুদিন পর সে শ্রমণদের কাছে ফিরে এলো। এবার বললো, তিনি (আল্লাহ) হচ্ছে এই যে প্রবাহমান বায়ু তা, যা সব কিছুর সাথেই রয়েছে, সব কিছুর ভেতরেই রয়েছে, কোনো কিছুই তাঁর থেকে মুক্ত নয়! 

(জাহমের বক্তব্য উল্লেখের পর) আবু মুআয [রাহ.] বললেন, আল্লাহর এই দুশমন মিথ্যা বলেছে। আল্লাহ নিজেকে যেভাবে সিফাতে বা গুণে বিভূষিত করেছেন ঠিক সেভাবেই তিনি আসমানের ওপারে আরশের ওপর রয়েছেন”।

এই বর্ণনা থেকে এটাও বোঝা যায় যে প্রথম যুগের হানাফী ইমামগণের আকিদাহ অন্যান্য ইমামগণের মতই ছিল। সেই সাথে এটাও বোঝা যায় যে, অনেকে যে দাবি করেন মা ওয়ারাউন নাহার অঞ্চলের হানাফীদের আকিদাহ ভিন্ন ধরণের ছিল,যার প্রতিনিধিত্ব ইমাম মাতুরিদী [রাহ.] করেছেন, সেটাও সঠিক নয়। বরং সেখানেও ঐ একই আকিদাহ বিদ্যমান ছিল যা ছিল আরবে, ইরাকে, শামে, মিসরে ও আফ্রিকায়। অন্তত ১৯৯ হিজরি পর্যন্ত তো বটেই। এরপর কোনো বিকৃতি প্রবেশ করে থাকলে সেটা অসম্ভব নয়। 

২০১ হিজরি থেকে ৩০০ হিজরি পর্যন্ত আলিমদের বক্তব্য:

১২) ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইদ্রিস আশ শাফিঈ [রাহ.]: ইমামু আহলিল বাইত ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইদ্রিস আশ শাফিঈ [রাহ.] ফিকহের প্রসিদ্ধ ৪ ইমামের একজন। তাঁরই দিকে সম্পৃক্ত করে শাফিঈ মাযহাব প্রতিষ্ঠিত। তিনি ২০৪ হিজরিতে মারা যান। আধুনিক সময়ের আশআরীদের বড় অংশ ফিকহীভাবে শাফিঈ। তবে আল্লাহ তাআলার আরশে সমুন্নত হওয়ার মাসআলায় ইমাম শাফিঈর [রাহ.] অবস্থান তাদের থেকে একদমই ভিন্ন। এ বিষয়েও তিনিও অন্যান্যদের মত একই মত অনুসরণ করে থাকেন। 

শাইখুল ইসলাম আবুল হাসান আল হাক্কারী রাহ. [মৃত্যু ৪৮৬ হি.] ইমাম শফিঈর [রাহ.] “আকিদাহ” সঙ্কলন করেন। 

এতে ইমাম শাফিঈ [রাহ.] বলেন, 

القول في السنة التي أنا عليها، رأيت أهل الحديث عليها، الذين رأيتهم، مثل سفيان، ومالك، وغيرهما

“যে সুন্নাতের (অর্থাৎ আকিদার) ওপর আমি রয়েছি, হাদিসের ইমামগণকে সে আকিদার ওপর আমি দেখেছি, আমি যাদের (এই মতের ওপর) দেখেছি তাঁদের মধ্যে আছে সুফইয়ান, মালিক প্রমুখ [রাহ.]…”

এরপর আকিদাহ বর্ণনার এক পর্যায়ে বলেন, 

وأن الله على عرشه في سمائه، يقرب من خلقه كيف شاء، وينزل إلى سماء الدنيا كيف شاء

“আল্লাহ আসমানে আরশের ওপর রয়েছেন। তিনি যেভাবে ইচ্ছা মাখলুকের নিকটবর্তী হন। তিনি যেভাবে ইচ্ছা দুনিয়ার আসমানে অবতীর্ণ হন”।

ইমাম শাফিঈ [রাহ.] তাঁর সাথী ও ছাত্রদের উদ্দেশ্যে একটি ওয়াসিয়াত করেন যা ইমাম আব্দুল গাণী আল মাকদিসী [রাহ.] বর্ণনা করেছেন। এটি ‌‌وصية الإمام الشافعي বা ইমাম শাফিঈর [রাহ.] ওয়াসিয়াত নামে প্রসিদ্ধ। তিনি এতে ওসিয়াতের এক পর্যায়ে ইসলামী আকিদাহ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, 

وأنه فوق عرشه, “আর তিনি (অর্থাৎ আল্লাহ) স্বীয় আরশের ওপর রয়েছেন”।

এখানে আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, যেসব ক্ষেত্রে শরীআতে কাফফারা হিসেবে দাসমুক্তির বিধান রাখা রয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে এই দাস কি মু’মিনই হতে হবে নাকি কফির হলেও চলবে- এই মাসআলায় ইমাম শাফিঈর [রাহ.] অবস্থান হচ্ছে মু’মিন দাসকেই মুক্তি দিতে হবে। এক্ষেত্রে তাঁর দলিল হল গত পর্বে আমাদের উল্লেখিত দাসীর হাদিসটি। তিনি প্রথমে বলেন

“কেউ যদি যিহারে এমন দাসী আযাদ করে যে মু’মিন নয়, তাহলে এটা বৈধ হবে না, তার দায়িত্ব হচ্ছে সে পুনরায় কোনো মু’মিন দাসীকে আযাদ করবে”।

এরপর তিনি এর স্বপক্ষে দাসীর হাদিসটি উল্লেখ করেন, যেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন তাকে জিজ্ঞেস করেন যে আল্লাহ কোথায়? সেই দাসী উত্তরে বলেন, في السماء, “তিনি আসমানে”। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে মুক্ত করে দিতে বলেন। 

এই হাদিস ইমাম শাফিঈর [রাহ.] উল্লেখ করার মাধ্যমে বোঝা গেল যে, 

১) ইমাম শাফিঈ [রাহ.] কাফফারার ক্ষেত্রে মুসলিম দাস মুক্ত করার বাধ্যবাধকতা এই হাদিসের প্রত্যক্ষ প্রমাণ থেকেই গ্রহণ করেছেন,

২) তিনি হাদিসটি যেভাবে উল্লেখ করেছেন, তাতে এটা সুস্পষ্ট যে আল্লাহ তাআলার আরশে সমুন্নত হওয়া ও আসমানসমূহের ঊর্ধ্বে থাকার যে আকিদাহ- তা তিনি সমর্থন করেন। 

এই বিষয়ে হাদিসের প্রখ্যাত ইমাম ও হাফিয আবু হাতিম আর রাযীর [রাহ.] বক্তব্যও রয়েছে, যা সামনে উল্লেখ করা হবে ইন শা আল্লাহ। 

১৩) ইমাম সাঈদ বিন আমির আদ দ্বুব্বাঈ [রহ.]: 

ইমাম সাঈদ বিন আমির আদ দ্বুব্বাঈ [রাহ.] ছিলেন প্রখ্যাত দুনিয়াবিমুখ আলিম ও হাফিযে হাদিস। তাঁর মৃত্যু ২০৮ হিজরিতে। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন ইমাম আলী ইবনুল মাদিনী, ইয়াহইয়া বিন মাঈন, আহমাদ বিন হাম্বল, ইবন রাহওয়াইহ ও দারিমীর [রাহ.] মত ইমামগণ। তিনি বলেন,

الْجَهْمِيَّةُ أَشَرُّ قَوْلًا مِنَ الْيَهُودِ وَالنَّصَارَى، قَدِ اجْتَمَعَتِ الْيَهُودُ وَالنَّصَارَى، وَأَهْلُ الْأَدْيَانِ أَنَّ اللَّهَ تبارك وتعالى عَلَى الْعَرْشِ، وَقَالُوا هُمْ: لَيْسَ عَلَى الْعَرْشِ شَيْءٌ

“জাহমিয়্যাদের কথা ইহুদী ও খৃষ্টানদের চেয়েও বেশি ক্ষতিকর। ইহুদী, খৃষ্টান এবং সকল ধর্মের লোক এ বিষয়ে একমত যে আল্লাহ তাবারাক ওয়া তাআলা আরশের ওপর আছেন। আর জাহমিয়্যারা বলে, আরশের ওপর কিছু নেই!”

১৪) ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইউসুফ আল ফিরিয়াবী [রাহ.]: ইমাম আল ফিরিয়াবী [রাহ.] ছিলেন হাফিযুল হাদিস, শাইখুল ইসলাম। তিনি ইমাম আওযাঈ ও সাওরীর [রাহ.] মত ইমামগণের ছাত্র আর ইমাম আহমাদ, বুখারী, দারিমী [রাহ.] প্রমুখ ইমামগণের উস্তায। তিনি ২১২ হিজরিতে মারা যান। তিনি বলেন, 

مَنْ قَالَ ‌إِنَّ ‌اللَّهَ ‌لَيْسَ ‌عَلَى ‌عَرْشِهِ ‌فَهُوَ ‌كَافِرٌ

“যে বলে যে আল্লাহ স্বীয় আরশের ওপর নেই, সে কাফির”।

১৫) ইমাম আবু জা’ফার মুহাম্মাদ বিন মুসআব আদ দাআ (‌الدعَّاء) [রাহ.]: ইমাম মুহাম্মাদ বিন মুসআব [রাহ.] ছিলেন প্রসিদ্ধ ইবাদাতগুজার ও কুরআনের বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিত্ব। তিনি ইবনুল মুবারাকের [রাহ.] ছাত্র ছিলেন, ইমাম আহমাদ [রাহ.] তাঁর প্রশংসা করেছেন। ইমাম আবু ইয়া’লা [রাহ.] তাঁকে হাম্বলী ফিকহের আলিমদের মধ্যে গণ্য করেছেন। তিনি ২২৮ হিজরিতে মারা যান। 

তিনি বলেন, 

«من زعم أنك لا تتكلم ولا ترى في الآخرة فهو كافر بوجهك لا يعرفك، أشهد أنك فوق العرش فوق سبع سماوات ‌ليس ‌كما ‌يقول ‌أعداء ‌الله ‌الزنادقة

“হে আল্লাহ, যে এই দাবি করে যে আপনি কথা বলেন না আর আখিরাতে আপনাকে দেখা যাবে না, সে আপনার সত্তা (চেহারা) অস্বীকারকারী কাফির, সে আপনাকে চিনে না। আমি এই সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আপনি আরশের ওপর রয়েছেন, সাত আসমানের ওপারে রয়েছেন। বিষয়টা মোটেও সেরকম নয় যেমনটা আল্লাহর দুশমন যিন্দীকরা বলে থাকে”।

১৬) ইমাম আবু আব্দিল্লাহ ইবনুল আ’রাবী [রাহ.]: ইমাম আবু আব্দিল্লাহ ইবনুল আ’রাবী [রাহ.] ছিলেন আরবি ভাষার প্রসিদ্ধতম ইমামগণের অন্যতম। তিনি আরেক ইমাম, আবুল হাসান আল কিসাঈর [রাহ.] ছাত্র এবং ইমাম সা’লাবের [রাহ.] উস্তায, ২৩১ হিজরিতে মারা যান। 

আবু সুলাইমান দাউদ বিন আলী [রাহ.] বলেন, আমরা একবার ইবনুল আ’রাবীর [রাহ.] কাছে ছিলাম এমন সময় একজন লোক এসে তাঁকে জিজ্ঞেস করলো, আল্লাহ আযযা জালের বাণী الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى “দয়াময় আরশের ওপর সমুন্নত হলেন”-এর মানে কী?

ইবনুল আ’রাবী [রাহ.] বললেন, هُوَ عَلَى عَرْشِهِ كَمَا أَخْبَرَ ، عز وجل

 তিনি আযযা ওয়া জাল্ল যেমনটা (এই আয়াতে) জানিয়েছেন তিনি স্বীয় আরশের ওপর রয়েছেন”। 

সেই লোক তখন বলল, হে আবু আব্দুল্লাহ, এর অর্থ এটা না, এর অর্থ হচ্ছে اسْتَوْلَى, অর্থাৎ তিনি প্রভাব বিস্তার করেছেন/ দখল করেছেন/পরাভূত করেছেন।

ইবনুল আ’রাবী [রাহ.] বললেন, “চুপ করো, তুমি এর ব্যাপারে কী জান?”

لا يقال: استولى على الشيء إلا أن يكون له مضاد فإذا غلب أحدهما قيل: استولى

“(আরবরা) কোনো কিছুকে ততক্ষণ ইস্তাওলা বলে না, যতক্ষণ না তার কোনো প্রতিপক্ষ থাকছে। এরপর যখন তাদের কোনো একজন বিজয়ী হয়/প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয় তখন বলা হয়: ইস্তাওলা- সে প্রভাব বিস্তার করেছে/পরাভূত করেছে”। 

এরপর তিনি এর স্বপক্ষে জাহিলী যুগের প্রখ্যাত আরবী কবি নাবিগার পঙক্তি শোনালেন। 

১৭) ইমাম আবু রাজা কুতাইবাহ বিন সাঈদ আল বাগলানী [রাহ.]: কুতাইবাহ বিন সাঈদ ছিলেন শাইখুল ইসলাম, মুহাদ্দিস, ইমাম, সিকাহ রাবী, ইলম অন্বেষণে ব্যাপক সফরকারী ব্যক্তিত্ব। ইমাম বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবন মাজাহ, নাসাঈ [রাহ.] সবাই তাঁর ছাত্র ছিলেন, তাঁর থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি ২৪০ হিজরিতে মারা যান। তিনি বলেন, 

هَذَا قَول الْأَئِمَّة فِي الْإِسْلَام وَالسّنة وَالْجَمَاعَة نَعْرِف رَبنَا فِي السَّمَاء السَّابِعَة على عَرْشه كَمَا قَالَ جل جلاله {الرَّحْمَن على الْعَرْش اسْتَوَى}

“এটা ইসলাম ও আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের ইমামগণের বক্তব্য যে, আমরা আমাদের রবকে এভাবে চিনি যে তিনি সপ্তম আকাশের ওপারে স্বীয় আরশের ওপর রয়েছেন। যেমনটা তিনি জাল্লা জালালুহ বলেন- ‘দয়াময় আরশের ওপর সমুন্নত হলেন’”।

এই রেওয়ায়েতের মূল বর্ণনাকারী ইমাম আল হাকীম আল কাবীর [রাহ.] ইমাম কুতাইবাহ [রাহ.] থেকে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকিদাবিষয়ক সম্পূর্ণ একটি আলোচনা উদ্ধৃত করেছেন, যা একটি মূল মতন বা টেক্সট হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। সেখানে এভাবে উল্লেখ করেছেন, 

وَيَعْرِفَ اللَّهَ فِي السَّمَاءِ السَّابِعَةِ عَلَى عَرْشِهِ كَمَا قَالَ: {الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى

“আর এটা জানবে যে আল্লাহ সপ্তম আসমানে(-র ওপারে) স্বীয় আরশের ওপর আছেন, যেমনটা তিনি বলেছেন- ‘দয়াময় আরশে সমুন্নত হলেন’”।

১৮) ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল [রাহ.]:  ইমামু আহলিস সুন্নাহ ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল [রাহ.] ইসলামের প্রসিদ্ধতম ইমামগণের একজন, এবং প্রতিষ্ঠিত ৪ মাযহাবের একটি-হাম্বলী মাযহাব, তাঁর দিকে সম্পৃক্ত। 

ইউসুফ বিন মুসা আল কাত্তান [রাহ.] বলেন, قيل لأبي عبد الله أحمد بن حنبل: الله عز و جل فوق السماء السابعة على عرشه بائن من خلقه وقدرته وعلمه في كل مكان؟

“আবু আব্দুল্লাহ আহমাদ বিন হাম্বলকে (রাহ.) প্রশ্ন করা হল যে, আল্লাহ আযযা জাল কি সৃষ্টিকুল থেকে পৃথক হয়ে সপ্ত আসমানের ওপারে স্বীয় আরশের ওপর রয়েছেন, আর তাঁর শক্তি-ক্ষমতা ও জ্ঞান সর্বত্র বিরাজমান?”

ইমাম আহমাদ [রাহ.] উত্তরে বললেন,  نعم على العرش وعلمه لا يخلو منه مكان

“হ্যাঁ, তিনি আরশের ওপর, আর কোনো জায়গায়ই তাঁর জ্ঞানের বাইরে নয়”।

মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম আল কাইসী [রাহ.] বলেন, আমি ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলকে [রাহ.] জিজ্ঞেস করলাম, ইমাম ইবনুল মুবারাককে [রাহ.] যখন জিজ্ঞেস করা হল আমরা আমাদের রবকে কিভাবে চিনবো? তিনি উত্তরে বললেন, 

في السماء السابعة على عرشه بحد

“তিনি সপ্তম আকাশে সুনির্দিষ্টভাবে স্বীয় আরশের ওপরে রয়েছেন”।

এটা শুনে ইমাম আহমাদ [রাহ.] বললেন, هكذا هو عندنا

“আমাদের কাছেও বিষয়টা এমনই”। 

ইমাম আহমাদ [রাহ.] যে এই আকিদাহ পোষণ করতেন তা উনার সাথী ইমাম আবু হাতিম আর রাযী [রাহ.], ইমাম হারব আল কিরমানী [রাহ.] প্রমুখের উক্তি এবং পরবর্তীকালের ইমাম যেমন ইমাম আবুল কাসিম আল লালিকাঈ [রাহ.] ও ইমাম আবু নাসর আস সাজযী [রাহ.] প্রমুখের উদ্ধৃতি থেকেও জানা যায়। অচিরেই তাঁদের আলোচনাও উপস্থাপন করা হবে ইন শা আল্লাহ।

১৯) ইমাম মুহাম্মাদ বিন আসলাম আত তূসী [রাহ.]: ইমাম মুহাম্মাদ বিন আসলাম আত তূসী [রাহ.] ছিলেন ইমাম, হাফিযুল হাদিস, শাইখুল ইসলাম, আল্লাহওয়ালা ব্যক্তিত্ব এবং ইমামুল আইম্মাহ ইবন খুযাইমাহ [রাহ.] এর উস্তায। তিনি ২৪২ হিজরিতে মারা যান। 

খুসারানের আব্বাসী শাসনকর্তা আব্দুল্লাহ বিন তাহির একবার তাঁকে বললেন, আমার কাছে এই খবর পৌঁছেছে যে আপনি আসমানের দিকে মাথা তোলেন না?

তিনি উত্তরে বললেন, ولم لا أرفع رأسي إلى السماء؟ وهل أرجو الخير إلا ممن في السماء

“আমি কে আসমানের দিকে মাথা তুলবো না? আসমানে যিনি আছেন (সেই আল্লাহ) ব্যতীত আমি কি অন্য কারও কাছে কল্যাণ প্রত্যাশা করি?!”

২০) ইমাম আল হারিস আল মুহাসিবী আস সূফী [রাহ.]: হারিস আল মুহাসিবী [রাহ.] ছিলেন তাসাউফের প্রসিদ্ধ ইমাম, এছাড়া তিনি উসূল ও মুআমালাত বিষয়ে জ্ঞানী ছিলেন। মু’তাযিলাদের খণ্ডন করে প্রচুর লিখেছেন। তিনি ২৪৩ হিজরিতে মারা যান। সাধারণত আশআরীদের মধ্যে যারা ইমাম ইবন কুল্লাবের [রাহ.] অনুসরণ করে থাকেন, তাঁরা ইমাম হারিসকে বিশেষভাবে মূল্যায়ন করেন। তিনি লিখেছেন, 

وَأما قَوْله {على الْعَرْش اسْتَوَى} {وَهُوَ القاهر فَوق عباده} و {أأمنتم من فِي السَّمَاء} {إِذا لابتغوا إِلَى ذِي الْعَرْش} فَهَذِهِ وَغَيرهَا مثل قَوْله {إِلَيْهِ يصعد الْكَلم} وَقَوله {ثمَّ يعرج إِلَيْهِ فِي يَوْم} فَهَذَا مقطع يُوجب أَنه فَوق الْعَرْش فَوق الْأَشْيَاء منزه عَن الدُّخُول فِي خلقه لَا يخفى عَلَيْهِ مِنْهُم خافية لِأَنَّهُ أبان فِي هَذِه الْآيَات أَن ذَاته بِنَفسِهِ فَوق عباده لِأَنَّهُ قَالَ {أأمنتم من فِي السَّمَاء أَن يخسف بكم الأَرْض} يَعْنِي فَوق الْعَرْش وَالْعرش على السَّمَاء لِأَن من كَانَ فَوق شَيْء على السَّمَاء فَهُوَ فِي السَّمَاء وَقد قَالَ مثل ذَلِك {فسيحوا فِي الأَرْض} يَعْنِي على الأَرْض لَا يُرِيد الدُّخُول 102 فِي جوفها وَكَذَلِكَ قَوْله {ولأصلبنكم فِي جُذُوع النّخل} يَعْنِي فَوْقهَا

“আর তাঁর বাণী, ‘দয়াময় আরশে সমুন্নত হয়েছেন’, ‘তিনি স্বীয় বান্দাদের ওপর পরাক্রমশালী’, ‘তোমরা কি নিঃশঙ্ক হয়ে গেছ তাঁর ব্যাপারে যিনি আসমানে আছেন’, ‘তবে তারা অবশ্যই আরশের অধিপতি পর্যন্ত পৌঁছার পথ তালাশ করত’,এই আয়াতগুলো, বা এর মত অন্যান্য আয়াত যেমন আল্লাহ বলেন, ‘তাঁর দিকেই উত্তম বাণীসমূহ উত্থিত হয়’, ‘তারপর তা একদিন তাঁর কাছেই উঠবে’-এই আয়াতগুলো এমন অকাট্য দলিল যা এটা মানতে বাধ্য করে যে তিনি আরশের ওপর রয়েছেন, সকল বস্তুর ওপরে রয়েছেন, তিনি স্বীয় সৃষ্টির ভেতর প্রবেশ করা থেকে পবিত্র। সৃষ্টির কোনো কিছুই তাঁর কাছে গোপন থাকে না। 

কেননা এ সকল আয়াতে তিনি সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন যে তিনি সত্তাগতভাবেই স্বীয় সৃষ্টিকুলের ওপরে রয়েছেন। কেননা তিনি বলেন, ‘যিনি আসমানে আছেন, তিনি তোমাদের সহ যমীন ধসিয়ে দেয়া থেকে কি তোমরা নিরাপদ হয়ে গেছ?’ অর্থাৎ আরশের ওপরে, আর আরশ আছে আসমানের ওপারে। কারণ যা কিছু আসমানের ওপরে থাকবে সেটাই হচ্ছে فِي السَّمَاء। 

এরকমই একটা কথা আল্লাহ অন্য আয়াতে বলেন, فسيحوا فِي الأَرْض ‘তোমরা যমীনে পরিভ্রমণ কর। এখানে ফিল আরদ্ব মানে على الأَرْض অর্থাৎ যমিনের ওপরে, এর দ্বারা যমিনের ভেতরে প্রবেশ করা উদ্দেশ্য নয়। একইভাবে এই আয়াতে, ولأصلبنكم فِي جُذُوع النّخل

‘অচিরেই আমি তোমাদেরকে খেজুর গাছে কাণ্ডে শূলিতে চড়াব, অর্থাৎ فَوْقهَا তার ওপরে চড়াব (ভেতরে নয়)”।

২১) ইমাম খুশাইশ বিন আসরাম আন নাসাঈ [রাহ.]: তিনি ছিলেন ইমাম, হাফিযুল হাদিস, হুজ্জাহ এবং ইমাম আবু দাউদ ও নাসাঈর [রাহ.] মত ব্যক্তিত্বের উস্তায। সেকালের বিদআতীদের খণ্ডন করে তিনি “আল ইস্তিকামাহ” নামক কিতাব লেখেন। ২৫৩ হিজরিতে মারা যান।

তিনি স্বীয় কিতাবে লেখেন: 

‌وَأنكر ‌جهم أَن يكون الله فِي السَّمَاء دون الأَرْض وَقد دلّ فِي كِتَابه أَنه فِي السَّمَاء دون الأَرْض بقوله حِين قَالَ لعيسى عليه السلام {إِنِّي متوفيك ورافعك إِلَيّ ومطهرك من الَّذين كفرُوا}

“আল্লাহ যে যমিনে নয় বরং আসমানে রয়েছেন তা জাহম অস্বীকার করেছে। আল্লাহর কিতাব এর প্রমাণ দিচ্ছে যে আল্লাহ যমিনে নয় বরং আসমানে রয়েছেন।  যেমন ঈসা আলাইহিস সালামের ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন- ‘নিশ্চয় আমি তোমাকে পরিগ্রহণ করব, তোমাকে আমার দিকে উঠিয়ে নেব এবং কাফিরদের থেকে তোমাকে পবিত্র করব’”।

এরপর তিনি এ প্রসঙ্গে বেশ কিছু আয়াত উল্লেখ করেন যেগুলোতে আসমান থেকে, আল্লাহর কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয় নাযিল হওয়ার আলোচনা রয়েছে। এ থেকে বোঝা যায় যে তিনি ওপরে রয়েছেন তাই তাঁর নির্দেশ ওপর থেকে নিচে যমিনে নাযিল হয়, একইভাবে যমিন থেকে রূহ, আমল, ফেরেশতারা আসমানে তাঁর দিকেই উত্থিত হয়। তিনি বলেন,

لَو كَانَ فِي الأَرْض كَمَا هُوَ فِي السَّمَاء لم ينزل من السَّمَاء إِلَى الأَرْض شَيْئا ولكان يصعد من الأَرْض إِلَى السَّمَاء كَمَا ينزل من السَّمَاء إِلَى الأَرْض

“তিনি যেভাবে আসমানে রয়েছেন সেভাবে যদি যমিনেও থাকতেন, সেক্ষেত্রে আসমান থেকে যমিনে কিছুই নাযিল হত না; বরং (বাস্তবে) এটা হয়ে থাকে যে যমিন থেকে আসমানে (আমল ও অন্যান্য বিষয়) উত্থিত হয়, যেভাবে আসমান থেকে (নির্দেশ ও অন্যান্য বিষয়) যমিনে নাযিল হয়ে থাকে”। 

তিনি আরও বলেন,

 أجمع وَمن أنكر الْعَرْش فقد كفر بِاللَّه وَجَاءَت الْآثَار بِأَن لله عرشا وَأَنه على عَرْشه

“এ বিষয়ে ইজমা রয়েছে যে, যে ব্যক্তি আরশকে অস্বীকার করে, সে বস্তুত আল্লাহকে অস্বীকার করে। আর এ বিষয়ে হাদিস রয়েছে যে, আল্লাহর আরশ রয়েছে, আর তিনি স্বীয় আরশের ওপরে রয়েছেন”।

২২) ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইয়াহইয়া আয যুহলী [রাহ.]: তিনি ছিলেন ইমাম, আল্লামা, হাফিযুল হাদিস, শাইখুল ইসলাম ও খুরাসানের মুহাদ্দিসদের ইমাম। ২৫৮ হিজরিতে মারা যান। 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে একজন জিজ্ঞেস করেছিলেন, وما تزكية النفس

“আর তাযকিয়াতুন নাফস বা আত্মশুদ্ধি কী জিনিস?”

তিনি উত্তরে বলেন, أن ‌يعلم ‌أن ‌الله عز وجل ‌معه ‌حيث ‌كان»

“(আত্মশুদ্ধি হচ্ছে) এট যে ব্যক্তি জানবে, সে যেখানেই থাকুক না কেন আল্লাহ আযযা ওয়া জাল তার সাথেই রয়েছেন”।

এই হাদিসের অর্থ সম্পর্কে ইমাম যুহলীকে [রাহ.] জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, 

يريد أن الله علمه محيط بكل مكان، والله على العرش 

“এর দ্বারা এটা বোঝানো উদ্দেশ্য যে আল্লাহ স্বীয় ইলম বা জ্ঞান দ্বারা সব স্থানকে পরিবেষ্টন করে আছেন, আর আল্লাহ (নিজে) আছেন আরশের ওপর”।

২৩) ইমাম আবু যুরআহ আর রাযী [রাহ.]: তিনি ছিলেন ইমাম, সায়্যিদুল হুফফায বা হাদিসের হাফিযকুল শিরোমণি। ইমাম মুসলিম, আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ, আবু হাতিম, আবু আওয়ানাহ [রাহ.] প্রমুখ হাদিসের ইমামগণ ছিলেন তাঁর শীষ্য। বলা হয়ে থাকে, আবু যুরআহ যদি কোনো হাদিস না চিনে থাকেন তাহলে এর কোনো ভিত্তি নেই। তিনি ২৬৪ হিজরিতে মারা যান।

ইমাম ইবন আবি হাতিম [রাহ.] বলেন, আমি আমার পিতা (অর্থাৎ ইমাম আবু হাতিম) ও আবু যুরআহ [রাহ.] কে জিজ্ঞেস করলাম যে, বিভিন্ন অঞ্চলের আলিমদেরকে আপনারা যে আকিদাহ পোষণ করতে দেখেছেন, অর্থাৎ দ্বীনের উসূল বা আকিদার ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাহর যে অবস্থান তা আমাকে জানান। তখন উভয় ইমাম আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকিদাহ সম্পর্কে জানালেন। বক্তব্যের শুরুতে তাঁরা বলেন, 

‌أَدْرَكْنَا ‌الْعُلَمَاءَ ‌فِي ‌جَمِيعِ ‌الْأَمْصَارِ ‌حِجَازًا ‌وَعِرَاقًا ‌وَشَامًا وَيَمَنًا فَكَانَ مِنْ مَذْهَبِهِمُ

“হিজাজ, ইরাক, শাম , ইয়ামান ও যাবতীয় অঞ্চলের আলিমদের আমরা দেখেছি যে (আকিদার ক্ষেত্রে) তাঁদের মাযহাব ছিল…”

এরপর তাঁরা লম্বা আলোচনা করেন। এক পর্যায়ে বলেন, 

وَأَنَّ اللَّهَ عز وجل عَلَى عَرْشِهِ بَائِنٌ مِنْ خَلْقِهِ كَمَا وَصَفَ نَفْسَهُ فِي كِتَابِهِ ، وَعَلَى لِسَانِ رَسُولِهِ صلى الله عليه وسلم بِلَا كَيْفٍ ، أَحَاطَ بِكُلِّ شَيْءٍ عِلْمًا ، {لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ} [الشورى: 11]

“আর আল্লাহ আযযা ওয়া জাল স্বীয় কিতাবে নিজেকে যেভাবে বিভিন্ন সিফাতে বিভূষিত করেছেন এবং স্বীয় রাসূলের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামে জবানীতে যেভাবে জানিয়েছেন, ঠিক সেভাবে তিনি কোনো স্বরূপ ব্যতীত সৃষ্টিকুল থেকে পৃথক হয়ে স্বীয় আরশের ওপর আছেন।  তিনি সব কিছুকে স্বীয় জ্ঞান দ্বারা পরিবেষ্টন করে আছেন, ‘তাঁর মত কিছুই নেই, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা’”।

যদিও শিরোনামে কেবল ইমাম আবু যুরআর [রাহ.] নাম উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু এটা আসলে ইমাম আবু যুরআ, আবু হাতিম ও ইবন আবি হাতিমের [রাহ.] আকিদাহ। 

২৪) ইমাম ইসমাঈল বিন ইয়াহইয়া আল মুযানী [রাহ.]: ইমাম মুযানী [রাহ.] ছিলেন ইমাম শাফিঈর [রাহ.] ছাত্র, ইমাম তহাউইর [রাহ.] মামা, ইমাম ইবন খুযাইমাহ, ইবন আবি হাতিম, তহাউই [রাহ.] প্রমুখের উস্তায, শাফিঈ ফিকহের অন্যতম ভিত্তি। ইমাম শাফিঈ [রাহ.] তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, المُزَنِيُّ نَاصرُ مَذْهبِي “মুযানী হচ্ছে আমার মাযহাবের রক্ষক(পৃষ্ঠপোষক)”। তিনি ২৬৪ হিজরিতে মারা যান।

বর্তমান কালে আশআরী আকিদার প্রধান পৃষ্ঠপোষক মূলত শাফিঈরা। এটা তাঁদের অফিসিয়াল মাযহাবে পরিণত হয়েছে। আমরা পেছনে খোদ ইমাম শাফিঈকে [রাহ.] অন্যান্য সালাফের মতই আকিদাহ লালন করতে দেখেছি। এবার তাঁর মাযহাবের বাহক, সংরক্ষক ও খাস ছাত্র ইমাম মুযানীর [রাহ.] আকিদাহ দেখব। আমরা দেখতে পাব তিনিও অন্যান্য সালাফের মত, স্বীয় উস্তাযের মত একই আকিদাহ লালন করতেন। 

তিনি স্বীয় গ্রন্থে লিখেছেন, 

عَال على عَرْشه فِي مجده بِذَاتِهِ وَهُوَ دَان بِعِلْمِهِ من خلقه 

“তিনি স্বমহিমায় সত্তাগতভাবে স্বীয় আরশের ওপর সমুন্নত, আর স্বীয় জ্ঞানের মাধ্যমে মাখলুকের নিকটবর্তী”। 

একই গ্রন্থে অন্যত্র বলেন, ‌عَال ‌على ‌عَرْشه ‌بَائِن ‌من ‌خلقه

“তিনি স্বীয় আরশের ওপর সমুন্নত, সৃষ্টিকুল থেকে পৃথক”।

২৫) ইমাম আবু হাতিম আর রাযী [রাহ.]: তিনি ছিলেন ইমাম, হাফিযুল হাদিস, শাইখুল মুহাদ্দিসীন, ইমাম আবু দাউদ, নাসাঈ, আবু আওয়ানাহ [রাহ.] প্রমুখের উস্তায। তিনি ২৭৭ হিজরিতে মারা যান।  

পেছনে তাঁর সহচর ও বন্ধু ইমাম আবু যুরআর [রাহ.] সাথে তাঁর উক্তিও আলোচিত হয়েছে। এর পাশাপাশি তাঁর আরও কিছু বক্তব্য এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে। 

এই বক্তব্যের শুরুতে তিনি আকিদাহ ও ফিকহের মূলনীতি সম্পর্কে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেন, 

مَذْهَبُنَا ‌وَاخْتِيَارُنَا اتِّبَاعُ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَأَصْحَابِهِ وَالتَّابِعِينَ وَمَنْ بَعْدَهُمْ بِإِحْسَانٍ ، وَتَرْكُ النَّظَرِ فِي مَوْضِعِ بِدَعِهِمْ ، وَالتَّمَسُّكُ بِمَذْهَبِ أَهْلِ الْأَثَرِ مِثْلِ أَبِي عَبْدِ اللَّهِ أَحْمَدَ بْنِ حَنْبَلٍ ، وَإِسْحَاقَ بْنِ إِبْرَاهِيمَ ، وَأَبِي عُبَيْدٍ الْقَاسِمِ بْنِ سَلَّامٍ ، وَالشَّافِعِيِّ. وَلُزُومُ الْكِتَابِ وَالسُّنَّةِ ، وَالذَّبُّ عَنِ الْأَئِمَّةِ الْمُتَّبِعَةِ لِآثَارِ السَّلَفِ ، وَاخْتِيَارُ مَا اخْتَارَهُ أَهْلُ السُّنَّةِ مِنَ الْأَئِمَّةِ فِي الْأَمْصَارِ مِثْلُ: مَالِكِ بْنِ أَنَسٍ فِي الْمَدِينَةِ ، وَالْأَوْزَاعِيِّ بِالشَّامِ ، وَاللَّيْثِ بْنِ سَعْدٍ بِمِصْرَ ، وَسُفْيَانَ الثَّوْرِيِّ ، وَحَمَّادِ بْنِ زِيَادٍ بِالْعِرَاقِ مِنَ الْحَوَادِثِ مِمَّا لَا يُوجَدُ فِيهِ رِوَايَةٌ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم وَالصَّحَابَةِ وَالتَّابِعِينَ

“আমাদের মাযহাব ও আমাদের গৃহীত অবস্থান হচ্ছে- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তাঁর সাহাবী, তাবিঈ এবং তাঁদের পরে যারা ইহসানের ওপর ছিলেন তাঁদের অনুসরণ করা, আর বিদাআতী বিষয়ে নজর না দেয়া। আর আমাদের অবস্থান হচ্ছে আমরা আহলুল আসারের মাযহাবকে আঁকড়ে ধরি, (আহলুল আসার) যেমন আবু আব্দুল্লাহ আহমাদ বিন হাম্বল, ইসহাক বিন ইব্রাহীম, আবু উবাইদ আল-কাসিম বিন সাল্লাম ও শাফিঈ [রাহ.]। 

আমরা কুরআন ও সুন্নাহকে আবশ্যকীয়ভাবে গ্রহণ করি, যেসব ইমাম সালাফের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন আমরা তাঁদের স্বপক্ষে প্রতিপক্ষের জবাব দেই। আর সেসব নতুন উদ্ভূত সমস্যার সমাধান  রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবা ও তাবিঈদের বর্ণনায় পাওয়া যায় না, সেগুলোর ক্ষেত্রে আমরা সেই মত গ্রহণ করি যা বিভিন্ন অঞ্চলের ইমামগণ থেকে আহলুস সুন্নাহ গ্রহণ করেছেন। এসব ইমামগণের মধ্যে রয়েছেন মদীনার মালিক বিন আনাস, শামের আওযাঈ, মিসরের লাইস বিন সা’দ, ইরাকের সুফিয়ান আস সাওরী ও হাম্মাদ বিন যিয়াদ [রাহ.]”। 

এরপর এক পর্যায়ে তিনি বলেন, وَالصَّوَابَ نَعْتَقِدُ وَنَزْعُمُ أَنَّ اللَّهَ عَلَى عَرْشِهِ بَائِنٌ مِنْ خَلْقِهِ

“সঠিক কথা হল, আমরা এই আকিদাহ রাখি, আর এই দাবিই করি যে, আল্লাহ মাখলুক থেকে পৃথক থেকে আরশের ওপর রয়েছেন”।

২৬) ইমাম আবু ঈসা আত তিরমিযী [রাহ.]: ইমাম তিরমিযী [রাহ.] হাদিসের প্রসিদ্ধ ইমাম, তাঁর সংকলিত “সুনান” আমাদের সবারই পরিচিত। তিনি ২৭৯ হিজরতিতে মারা যান। তিনি স্বীয় কিতাবে একটি হাদিসের ব্যখ্যায় আলিমদের মত উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, 

عِلْمُ اللَّهِ وَقُدْرَتُهُ وَسُلْطَانُهُ فِي كُلِّ مَكَانٍ، وَهُوَ عَلَى العَرْشِ كَمَا وَصَفَ فِي كِتَابهِ

“আল্লাহর জ্ঞান, কুদরত ও প্রভাব-কর্তৃত্ব সকল স্থানেই পরিব্যাপ্ত। আর তিনি স্বয়ং আরশের ওপর রয়েছেন যেমনটা তিনি স্বীয় কিতাবে নিজের সিফাত সম্পর্কে জানিয়েছেন”।

২৭) ইমাম হারব বিন ইসমাঈল আল কিরমানী [রাহ.]: তিনি ছিলেন ইমাম, আল্লামা, ফকীহ এবং ইমাম আহমাদের [রাহ.] খাস ছাত্রদের একজন। তিনি ইমাম আহমাদ [রাহ.] কে জিজ্ঞেস করে মাসাইলের এক সঙ্কলন প্রস্তুত করেন যা “মাসাইলু হারব আল কিরমানী” নামে প্রসিদ্ধ। ২৮০ হিজরিতে মারা যান। তাঁর মাসাইল থেকে ড. আসআদ আয যা’তারীর তাহকীকে যেটুকু প্রকাশিত হয়েছে তার নাম হচ্ছে, إجماع السلف في الاعتقاد كما حكاه الإمام حرب بن إسماعيل الكرماني। 

গ্রন্থের শুরুতেই ইমাম হারব [রাহ.] সুস্পষ্টভাষায় বলেছেন যে এই গ্রন্থে আহলুস সুন্নাহর মূলনীতি উল্লেখিত হয়েছে যার খেলাফ কেবল বিদআতী-পথভ্রষ্টরাই করতে পারে। তিনি বলেন, 

فمن خالف شيئًا من هذه المذاهب، أو طعن فيها، أو عاب قائلها، فهو [مخالفٌ]، مبتدعٌ، خارجٌ [من] الجماعة، زائل عن منهج السنة وسبيل الحق

“এই (গ্রন্থে উল্লেখিত) মতসমূহের কিছুটারও যদি কেউ বিরোধিতা করে বা বিপরীত মত পোষণ করে, তা এগুলোর ওপর দোষারোপ করে বা নিন্দা করে, বা এই মত পোষণকারীর ত্রুটি অন্বেষণ করে, সে (সুপথ) বিরোধী, বিদআতী, (আহলুস সুন্নাহ ওয়াল) জামাআত থেকে বের হয়ে যাওয়া ব্যক্তি, সুন্নাতের মানহাজ ও হক পথ থেকে সে বিচ্ছিন্ন”।

এই মতসমূহ আসলে কাঁদের, সেটাও তিনি সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, 

وهو مذهب أحمد وإسحاق بن إبراهيم بن مخلد، وعبد الله بن الزبير الحميدي، وسعيد بن منصور، وغيرهم ممن جالسنا وأخذنا عنهم العلم

“এটা হচ্ছে ইমাম আহমাদ, ইসহাক বিন ইব্রাহীম বিন মুখাল্লাদ, আব্দুল্লাহ বিন আয যুবাইর আল হুমাইদী, সাঈদ বিন মানসূর [রাহ.] ও অন্যান্য আলিমদের মত যাদের কাছে আমরা বসেছি এবং তাঁদের থেকে ইলম গ্রহণ করেছি”।

আমরা দেখছি তাঁরা সবাই অনেক বড় বড় ইমাম। কাজেই ইমাম হারব এখানে যে আকিদাহ উল্লেখ করেছেন তা কেবল তাঁর একার আকিদাহ নয়; বরং আহলুস সুন্নাতের বড় বড় ইমামগণের আকিদাহ। তিনি বলেন, 

والماء فوق السماء[العليا] السابعة، وعرش الرحمن [عز وجل] فوق الماء، والله تبارك وتعالى على العرش 

“সুউচ্চ সপ্তম আসমানের ওপরে আছে পানি। আর দয়াময় আযযা ওয়া জাল্ল-এর আরশ রয়েছে পানির ওপরে। আর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তাআলা রয়েছেন আরশের ওপরে”।

একটু পরে বিদআতীদের খণ্ডন করে বলেন, 

لأن الله [تبارك و] تعالى على العرش فوق السماء السابعة العليا، يعلم ذلك كله، وهو بائن من خلقه، لا يخلو من علمه مكان

“আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তাআলা সুউচ্চ সপ্তম আসমানের ওপারে আরশের ওপর সমুন্নত। তিনি (সেখান থেকে) ঐ সব কিছুই জানেন। তিনি স্বীয় সৃষ্টিকুল থেকে পৃথক। কোনো স্থানই তাঁর ইলম থেকে খালি নয় তথা তাঁর জ্ঞানের বাইরে নয়”।

গ্রন্থের এক স্থানে তিনি জাহমিয়াদের ব্যাপারে বলেন, و‌‌الجهمية : أعداء الله

“জাহমিয়্যারা হচ্ছে আল্লাহর দুশমন”। 

কেন তারা আল্লাহর দুশমন, তিনি এর কারণ হিসেবে তাদের কিছু আকিদাহ উল্লেখ করেন, এর মাঝে এটাও বলেন,

ولا يُعرف لله مكان، وليس لله عرش

“তারা দাবি করে যে আল্লাহর অবস্থান (মাকান) জানা যায় না, আর আল্লাহর আরশ নেই”।

২৮) ইমাম উসমান আদ দারিমী [রাহ.]: তিনি ছিলেন ইমাম, আল্লামা, হাফিযুল হাদিস, হাদিস সমীক্ষক ও ‘সুনান’ গ্রন্থ প্রণেতা। তিনি ২৮০ হিজরিতে মারা যান। তিনি জাহমিয়্যাদেরকে খণ্ডন করে “আর রাদ্দু আলাল জাহমিয়্যাহ” নামক গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। তিনি বলেন, 

وَقَدِ اتَّفَقَتِ الكَلِمَةُ مِنَ المُسْلِمِينَ أَنَّ الله تَعَالَى ‌فَوْقَ ‌عَرْشِهِ ‌فَوْقَ ‌سَمَاوَاتِهِ

“মুসলিমরা এই কথার ওপর একমত যে আল্লাহ তাআলা স্বীয় আরশের ওপরে, আসমানসমূহের ওপারে রয়েছেন”।

অপর গ্রন্থে তিনি বলেন, 

‌فالله تبارك وتعالى ‌فوق ‌عرشه، فوق سماواته، بائنٌ من خلقه، فمن لم يعرفه بذلك؛ لم يعرف إِلَهَهُ الذي يَعبُد

“কাজেই আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তাআলা স্বীয় আরশের ওপরে রয়েছেন, তাঁর (সৃষ্ট) আসমানসমূহের ওপারে রয়েছেন। তিনি সৃষ্টিকুল থেকে পৃথক রয়েছেন। যে আল্লাহকে এভাবে চেনে না, সে যেই ইলাহর উপাসনা করে থাকে, তাঁকেই আসলে চেনে না”। 

২৯) ইমাম আবু বাকর ইবন আবি আসিম আশ শাইবানী [রাহ.]: ইমাম ইবন আবি আসিম [রাহ.] ছিলেন অনেক বড় হাফিযে হাদিস। তিনি প্রচুর গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। তিনি ২৮৭ হিজরিতে মারা যান।

তিনি স্বীয় কিতাব “আস সুন্নাহ” তে আল্লাহ তাআলার সুউচ্চ হওয়া বিষয়ে একটি অধ্যায়ই তৈরি করেছেন, এর নাম রেখেছেন, 

‌‌ماذكر أَنَّ اللَّهَ تَعَالَى فِي سَمَائِهِ دون أرضه”

“অধ্যায়: আল্লাহ তাআলা যে যমিনে নন বরং আসমানে রয়েছে সে বিষয়ে যা বর্ণিত হয়েছে”। এই অধ্যায়ে তিনি সেই বিখ্যাস দাসীর হাদিসটি নিজস্ব সনদে বর্ণনা করেছেন। 

৩০) ইমাম আবু জা’ফার বিন আবি শাইবাহ [রাহ.]: ইমাম মুহাম্মাদ বিন উসমান বিন আবি শাইবাহ [রাহ.] ছিলেন ইমাম, হাফিযুল হাদিস, ইমাম তাবারানীসহ [রাহ.] বহু মুহাদ্দিসের উস্তায ও সিকাহ রাবী। তিনি ২৯৭ হিজরিতে মারা যান। তিনি আরশ বিষয়ে একটি গ্রন্থই রচনা করেছেন, যার নাম العرش وما رُوِي فيه, অর্থাৎ আরশ, আর এ বিষয়ে যা বর্ণিত হয়েছে। 

এই গ্রন্থে তিনি এক স্থানে লিখেছেন,

مِنْ خَلْقِهِ بَائِنًا مِنْهُمْ، عِلْمُهُ فِي خَلْقِهِ لَا يَخْرُجُونَ مِنْ عِلْمِهِ فَهُوَ فَوْقَ السَّمَاوَاتِ وَفَوْقَ الْعَرْشِ بِذَاتِه مُتَخَلِّصًا 

“তিনি সৃষ্টিকুল থেকে আলাদা ও পৃথকভাবে আসমানসমূহের ওপারে আরশের ওপরে সত্তাগতভাবে রয়েছেন। সৃষ্টিকুলের মাঝে তাঁর জ্ঞান বিরাজমান, তারা তাঁর জ্ঞানের পরিসীমার বাইরে যেতে পারে না”।

৩১) ইমাম আমর বিন উসমান আল মাক্কী [রাহ.]: তিনি ছিলেন ইমাম, আল্লাহওয়ালা, দুনিয়াবিমুখ ব্যক্তি এবং সুফীকুল শিরোমণি। এছাড়া ফিকহ ও উসূলে ফিকহেও পারদর্শী ছিলেন। তাঁর সময়কালে হুসাইন বিন মানসুর আল হাল্লাজ নামক ভ্রান্ত সুফীর আত্মপ্রকাশ ঘটে। তিনি তার বিরোধীতায় ছিলেন সরব। তিনি ২৯৭ হিজরিতে মারা যান। 

তিনি তাসাউফের পথের পথিকদের আদাব সম্পর্কে أداب المريدين والتعرف لأحوال العبّاد নামক গ্রন্থ রচনা করেন। বান্দা যখন তাওবাহ করে আল্লাহর পথে আসে তখন শয়তান তাকে যেসব ওয়াসওয়াসা দেয় সে সম্পর্কে আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি

আল্লাহ তাআলার পরিচয় উল্লেখ করেন, তিনি বলেন, 

المستوي على عرشه بعظمة جلاله دون كل مكان

“তিনি তাঁর সুমহান বড়ত্বের সাথে স্বীয় আরশের ওপর সমুন্নত আছেন, সব স্থানে নন”। 

সালাফের যুগের পরেও যেসকল আলিম এসেছেন তাঁরাও এই সাক্ষ্যই দিয়েছেন যে এই আকিদাই সালাফের আকিদাহ, মুসলিমদের আকিদাহ, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকিদাহ: 

৩০১ থেকে ৫০০ হিজরি পর্যন্ত: 

৩২) ইমাম আবুল হাসান আল আশআরী [রাহ.]: আশআরী আকিদাকে ইমাম আবুল হাসান আশআরীর দিকেই সম্পৃক্ত করা হয়। কাজেই তাঁর পরিচয় প্রদান নিষ্প্রয়োজন। তিনি ৩২৪ হিজরিতে মারা যান।

 ইমাম আশআরীর আকিদা যখন পড়া হয় তখন দেখা যায় তা বর্তমান আশআরীদের থেকে ভিন্ন। ইমাম আবুল হাসান [রাহ.] এর প্রসিদ্ধ লেখনী যেমন “মাকালাতুল ইসলামিয়্যিন”, “আল ইবানাহ”-ইত্যাদিতে এর সাক্ষ্য বিদ্যমান। ইমাম আবুল হাসানের নিজের লেখনী আশআরীদের বর্তমান অবস্থানের বিরুদ্ধে। তবে তারা তাঁকে নিজেদের দিকে দাবি করে থাকে। এক্ষেত্রে তারা ইমাম সাহেবের কোনো কিতাবকে উদ্ধৃত করতে ব্যর্থ, উদাহরণস্বরূপ তারা বলতে পারে না যে ইমাম সাহেব “মাকালাতুল ইসলামিয়্যিন” আমাদের আকিদার স্বপক্ষে লিখেছেন। অর্থাৎ তাদের নিজেদের স্বপক্ষে যা আছে তা হল মৌখিক দাবি, অন্যদিকে ইমাম সাহেবের নিজের লেখা ভিন্ন দিকে ইশারা করে। আমরা তেমন কিছু উদ্ধৃতি দেখব। 

তিনি আহলুস সুন্নার আকিদাহ লিখতে গিয়ে বলেন, 

وقال أهل السنة وأصحاب الحديث: ليس بجسم ولا يشبه الأشياء ‌وأنه ‌على ‌العرش كما قال عز وجل: {الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى}

“আহলুস সুন্নাহ ও আসহাবুল হাদিসগণ বলেন যে, আল্লাহ কোনো জিসম বা দেহ নন, তিনি কোনো কিছুর সদৃশ নন, আর তিনি আরশের ওপর রয়েছেন, যেমনটা আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্ল বলেছেন- ‘দয়াময় আরশে সমুন্নত হয়েছেন’”।

পরের লাইনেই বলেন, بل نقول استوى بلا كيف

“বরং আমরা বলব তিনি কোনো ধরণ/স্বরূপ ছাড়াই সমুন্নত হয়েছেন”।

এই বইয়ে আরেক স্থানে তিনি আহলুস সুন্নাহ ও আসহাবুল হাদিস তথা মুহাদ্দিসীনদের আকিদাহ উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, 

‌وأن ‌الله – ‌سبحانه! – ‌على ‌عرشه كما قال: {الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى}

“আর আল্লাহ সুবহানাহ স্বীয় আরশের ওপর রয়েছেন, যেমনটা তিনি বলেছেন, ‘দয়াময় আরশে সমুন্নত হয়েছেন’”।

উল্লেখ্য যে আধুনিক আশআরীরা আল্লাহর ইস্তিওয়াকে ইস্তাওলা দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে থাকে, অথচ ইমাম আবুল হাসান [রাহ.] এটাকে মু’তাযিলাদের আকিদাহ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, 

وقالت المعتزلة: أن الله استوى على عرشه بمعنى استولى

“আর মু’তাযিলারা বলে, আল্লাহ স্বীয় আরশে ইস্তিওয়া করেছেন মানে ইস্তাওলা করেছেন (অর্থাৎ প্রভাব বিস্তার করেছেন)”।

দুঃখজনকভাবে তাঁর অনুসারীরা আজ সেই মু’তাযিলাদের আকিদার অনুসরণ করছে, যাদের খণ্ডন তিনি নিজেই করেছেন! 

তিনি অপর গ্রন্থ رسالة إلى أهل الثغر بباب الأبواب এও এই বিষয়টা সামনে এনেছেন। তিনি যেসকল বিষয়ে আহলুস সুন্নাহর ইজমা রয়েছে সেগুলোর আলোচনার এক পর্যায়ে বলেন, 

وأنه تعالى فوق سماواته على عرشه دون أرض

“আর আল্লাহ তাআলা আসমানসমূহের ওপারে স্বীয় আরশের ওপরে রয়েছেন, তিনি যমিনে নেই”।

একটু পরে তিনি ইস্তিওয়াকে ইস্তাওলা অনুবাদ করা বা ব্যাখ্যা করাকে আহলুল কাদর নামক ভ্রান্ত ফির্কার আকিদাহ বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, 

وليس استواؤه على العرش استيلاء كما قال أهل القدر

“আল্লাহর আরশে সমুন্নত হওয়া বা ইস্তিওয়া এর মানে ইস্তীলা বা প্রভাব বিস্তার করা নয়, যেমনটা আহলুল কাদর বলে থাকে”।

এছাড়া ইমাম আবুল হাসান [রাহ.] তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ “আল  ইবানাতেও” এ সংক্রান্ত প্রচুর আলোচনা করেছেন। কিন্তু আমাদের আশআরী-মাতুরিদী ভাইরা যেহেতু আল- ইবানার গ্রহণযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন তোলেন, এজন্য এমন দুটি কিতাবের উদ্ধৃতি দেয়া হল যেগুলো উনার গ্রন্থ হিসেবে প্রমাণিত হওয়ার ব্যাপারে উনাদের মাঝে মোটাদাগে তেমন ইখতিলাফ নেই। 

৩৩) ইমাম আবু বাকর আল আজুররী [রাহ.]: তিনি ছিলেন ইমাম, মুহাদ্দিস, অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব, হারাম শরীফের ইমাম। তিনি ৩৬০ হিজরিতে মারা যান। 

তিনি বলেন, 

وَالَّذِي يَذْهَبُ إِلَيْهِ أَهْلُ الْعِلْمِ: أَنَّ اللَّهَ عز وجل سُبْحَانَهُ عَلَى عَرْشِهِ فَوْقَ سَمَاوَاتِهِ ، وَعِلْمُهُ مُحِيطٌ بِكُلِّ شَيْءٍ

“আহলুল ইলমগণ যে মত গ্রহণ করেছেন তা হচ্ছে, আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্ল, সুবহানাহ- আসমানসমূহের ওপারে স্বীয় আরশের ওপরে রয়েছেন। আর তাঁর জ্ঞান সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে রয়েছে”।

৩৪) ইমাম ইবন আবি যাইদ আল কাইরাওয়ানী আল মালিকী [রাহ.]: তিনি ছিলেন মালিকী মাযহাবের ইমাম, আল্লামা, অনুসরণীয় আদর্শ, ফকীহ, আহলুল মাগরিব তথা উত্তর পশ্চিম আফ্রিকার ইমাম। মালিকী ফিকহে তাঁর ব্যাপক জ্ঞানের কারণে তাঁকে مالك الأصغر বা খুদে ইমাম মালিক বলা হত। 

তিনি লিখেছেন, 

فيما ‌أجمعت ‌عليه ‌الأمة من أمور الديانة، ومن السنن التي خلافها بدعة وضلالة: أن الله تبارك اسمه له الأسماء الحسنى والصفات العلى

“দ্বীনি বিশ্বাসের যেসকল বিষয়ের ব্যাপারে উম্মাহ ইজমা করেছে, যেসকল সুন্নাতের বিরোধিতা করা বিদআত ও পথভ্রষ্টতা তার মধ্যে রয়েছে যে, বরকতময় নামের অধিকারী আল্লাহর অনেকগুলো সুন্দর সুন্দর নাম ও সুমহান সিফাত রয়েছে”। 

এরপর আহলুস সুন্নাহর ঐকমত্যভিত্তিক আকিদাগুলো তিনি আলোচনা করতে থাকেন, এক পর্যায়ে বলেন, 

وأنه فوق سماواته على عرشه دون أرضه، وأنه في كل مكان بعلمه

“তিনি আসমানসমূহের ওপারে স্বীয় আরশের ওপরে রয়েছেন, তিনি যমিনে নন। আর সর্বত্র তিনি স্বীয় জ্ঞান দ্বারা বিরাজমান”।

আকিদাহ বিষয়ক এই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা শেষে তিনি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, 

وكل ما قدمنا ذكره فهو قول أهل السنة وأيمة الناس في الفقه والحديث على ما بيناه، ‌وكله ‌قول ‌مالك، فمنه منصوص من قوله، ومنه معلوم من مذهبه

“যেসব বিষয়ের আলোচনা আমি উপস্থাপন করেছি, এসবই আহলুস সুন্নাহর মতামত, এবং আমি যা বর্ণনা করেছি ফিকহ ও হাদিসের ইমামগণ সে মতের ওপরই ছিলেন। এসবই ইমাম মালিকের [রাহ.] বক্তব্য। এর কিছু সরাসরি উনার উক্তি হিসেবে বর্ণিত আছে, আর কিছু তাঁর মাযহাব থেকে জানা গেছে”।

তাঁর বক্তব্য থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, এই আকিদাহ কেবল তাঁর একার নয়, আহলুস সুন্নাহর ফিকহ ও হাদিসের ইমামগণের আকিদাহ, বিশেষ করে ইমাম মালিকের [রাহ.] আকিদাহ। আর এজন্য মাগরিবের মালিকীরা আগে আসারি ছিলেন। ইবন তুমার্ত তরবারির জোরে মাগরিবের মালিকীদের আশআরী বানানোর আগ পর্যন্ত তারা স্বতঃস্ফুর্তভাবে আশআরী হন নি। অন্তত ইমাম ইবন যাইদের [রাহ.] সময় পর্যন্ত তো নয়ই। মাগরিবের আকিদায় আশআরী ও ফিকহে যাহিরী “আল মুওয়াহহিদ” আন্দোলন একটি পৃথক আলোচ্য বিষয় হতে পারে। 

৩৫) ইমাম ইবন বাত্তাহ আল উকবারী [রাহ.]: তিনি ছিলেন ইমাম, অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব, ইবাদাতগুজার, হাম্বলী ফকীহ, মুহাদ্দিস, ইরাকের শাইখ। তিনি ৩৮৭ হিজরিতে মারা যান। আকিদাহ বিষয়ক তাঁর একটি অসাধারণ সঙ্কলন হচ্ছে “আল ইবানাতুল কুবরা”। 

তিনি বলেন, 

وأجمع المسلمون من الصحابة والتابعين، وجميع أهل العلم من المؤمنين أن الله تبارك وتعالى ‌على ‌عرشه، ‌فوق ‌سماواته بائن من خلقه، وعلمه محيط بجميع خلقه، لا يأبى ذلك ولا ينكره إلا من انتحل مذاهب الحلولية

“সাহাবা ও তাবিঈদের মত মুসলিমরা এবং সকল মু’মিন আলিম এই বিষয়ে একমত (তাঁদের ইজমা রয়েছে) যে আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তাআলা স্বীয় আরশের ওপর রয়েছেন, আসমানসমূহের ওপারে রয়েছেন, সৃষ্টিজগৎ থেকে পৃথক রয়েছেন, তাঁর জ্ঞান সকল সৃষ্টিকে পরিবেষ্টন করে রয়েছে, হুলুলী মাযহাবের অনুসারী ব্যতীত অপর কেউ এই আকিদাহ না অস্বীকার করতে পারে, আর না প্রত্যাখ্যান করতে পারে”।

৩৬) ইমাম ইবন আবি যামানীন আল মালিকী [রাহ.]: তিনি ছিলেন ইমাম, অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব, দুনিয়াবিমুখ, শাইখু কুরতুবাহ বা ইসলামিক আন্দালুসের কুরতুবার শাইখ, যা আধুনিক যুগে স্পেনের Córdoba শহর। মালিকী ফিকহের প্রসিদ্ধ আলিম হওয়ার পাশাপাশি তিনি একজন প্রসিদ্ধ মুফাসসিরও। তিনি ৩৯৯ হিজরিতে মারা যান। 

তিনি “উসূলুস সুন্নাহ” নামে আহলুস সুন্নাহর আকিদার একটি গ্রন্থ লিখেছেন। এতে তিনি লিখেছেন, 

وَمِنْ قَوْلِ أَهْلِ اَلسُّنَّةِ: أَنَّ اَللَّهَ عز وجل ‌خَلَقَ ‌اَلْعَرْشَ وَاخْتَصَّهُ بِالْعُلُوِّ وَالِارْتِفَاعِ فَوْقَ جَمِيعِ مَا خَلَقَ، ثُمَّ اِسْتَوَى عَلَيْهِ كَيْفَ شَاءَ، كَمَا أَخْبَرَ عَنْ نَفْسِهِ فِي قَوْلِهِ: اَلرَّحْمَنُ عَلَى اَلْعَرْشِ اِسْتَوَى

“আহলুস সুন্নাহর বক্তব্য হচ্ছে, আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্ল আরশকে সৃষ্টি করেছেন। সুউচ্চতা ও সমুন্নতির মাধ্যমে একে সকল সৃষ্টির ওপরে বিশিষ্টতা দান করেছেন। এরপর তিনি যেভাবে চেয়েছেন, সেভাবে এর ওপর সমুন্নত হয়েছেন, যেমনটা তিনি নিজের ব্যাপারে (আমাদেরকে) জানিয়েছেন, ‘দয়াময় আরশে সমুন্নত হলেন’”।

একটু সামনে এগিয়ে তিনি বলেন, 

وَمِنْ قَوْلِ أَهْلِ اَلسُّنَّةِ أَنَّ اَللَّهَ عز وجل ‌بَائِنٌ ‌مِنْ ‌خَلْقِهِ، مُحْتَجِبٌ عَنْهُمْ بِالْحُجُبِ

“আর আহলুস সুন্নাহর বক্তব্য হচ্ছে, আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্ল স্বীয় সৃষ্টি হতে পৃথক, আবরণসমূহের মাধ্যমে তিনি সৃষ্টিকুলের অন্তরালে রয়েছেন”।

৩৭) ইমাম আবু বাকর মুহাম্মাদ বিন মাউহাব আল মালিকী [রাহ.]: তিনি ছিলেন ইমাম, আল্লামা, আর ছিলেন ইমাম ইবন আবি যাইদের [রাহ.] ছাত্র। ইমাম ইবন আবি যাইদের “রিসালাহ”-এর ব্যাখ্যা লিখে মালিকীদের কাছে তিনি প্রসিদ্ধ। তাঁর আরেকটি পরিচয় হল প্রসিদ্ধ মালিকী ইমাম কাদ্বী আবুল ওয়ালিদ আল বাজী [রাহ.] তাঁর নাতী। 

ইমাম ইবন আবি যাইদ [রাহ.] “রিসালায়” লিখেছেন, إِنَّه فَوق عَرْشه الْمجِيد بِذَاتِهِ

“তিনি সত্তাগতভাবে মহান আরশের ওপরে রয়েছেন”। 

এর স্বপক্ষে ইমাম ইবনুল মাউহাব [রাহ.] লিখেছেন, فَمَعْنَى فَوق وعَلى عِنْد جَمِيع الْعَرَب وَاحِد

“فَوق আর عَلى এর অর্থ সকল আরবের কাছে একই (সেটা হচ্ছে ওপরে)”। 

তিনি এই কথাটি বলে বোঝাতে চেয়েছেন যে কুরআনে আরশের ওপর ইস্তিওয়া করার ক্ষেত্রে যে عَلى এর প্রয়োগ হয়েছে, এর অর্থ فَوق-ই, কেননা উভয়ের অর্থ এক। কাজেই ইমাম ইবন আবি যাইদ [রাহ.] এর শব্দচয়ন ঠিক আছে। 

এর স্বপক্ষে দলিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, 

وَفِي الْكتاب وَالسّنة تَصْدِيق ذَلِك وَهُوَ قَوْله تَعَالَى {ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ}

“এর সত্যায়ন কুরআন ও হাদিসেই পাওয়া যায়, যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অতঃপর তিনি আরশে সমুন্নত হলেন’”। 

এর তিনি এক্ষেত্রে “ফী” এর প্রয়োগ সম্পর্কে লেখেন, 

وَقد تَأتي لَفْظَة فِي فِي لُغَة الْعَرَب بِمَعْنى فَوق كَقَوْلِه {فَامْشُوا فِي مناكبها} و {فِي جُذُوع النّخل} و {أَأَمِنْتُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ} قَالَ أهل التَّأْوِيل يُرِيد فَوْقهَا وَهُوَ قَول مَالك مِمَّا فهمه عَمَّن أدْرك من التَّابِعين مِمَّا فهموه عَن الصَّحَابَة مِمَّا فهموه عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم أَن الله فِي السَّمَاء يَعْنِي فَوْقهَا وَعَلَيْهَا

“আরবি ভাষায় فِي (preposition) টি فَوق বা ওপরে অর্থে আসে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘অতএব তোমরা এর দিক-দিগন্তে বিচরণ কর’, ‘খেজুর গাছের কান্ডে’, ‘তোমরা কি এ থেকে নিৰ্ভয় হয়েছ যে, যিনি আসমানে রয়েছেন’। 

ব্যাখ্যাকারগণ বলেন, এসব আয়াতে (ফী দ্বারা) উদ্দেশ্য হচ্ছে এর “ওপরে”। 

এটাই ইমাম মালিকের [রাহ.] কথা, তিনি যেসব তাবিঈদের পেয়েছেন, তাঁদের থেকে তিনি এই বুঝ গ্রহণ করেছেন। সেসব তাবিঈরা যেসকল সাহাবীদের [রা.] পেয়েছেন, তাঁরা তাঁদের থেকে এই বুঝ গ্রহণ করেছেন। আর সাহাবারা [রা.] এই বুঝ গ্রহণ করেছেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে, যে আল্লাহ আসমানে রয়েছে, মানে আসমানের ওপরে ও ঊর্ধ্বে রয়েছেন”।

৩৮) ইমাম আবুল কাসিম আল লালিকাঈ আশ শাফিঈ [রাহ.]: ইমাম আবুল কাসিম হিবাতুল্লাহ আল লালিকাঈ বা লালকাঈ আত তাবারী [রাহ.] ছিলেন শাফিঈ ফিকহের ইমাম, হাফিযুল হাদিস ও আকিদার ইমাম। আকিদাহ বিষয়ে সালাফের বাণীর অসাধারণ সংকলন “শারহু উসূলি ই’তিক্বাদ আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামাআত” নামক অবিস্মরণীয় গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন, যার দ্বারা যুগ যুগ ধরে মানুষ উপকৃত হচ্ছে। তিনি ৪১৮ হিজরিতে মারা যান।

তিনি বলেন, 

سياق ما روي في قوله تعالى {الرحمن على العرش استوى} [طه: 5] وأن الله على عرشه في السماء وقال: عز وجل {إليه يصعد الكلم الطيب والعمل الصالح يرفعه} [فاطر: 10]

 وقال: {أأمنتم من في السماء أن يخسف بكم الأرض} [الملك: 16] وقال: {وهو القاهر فوق عباده ويرسل عليكم حفظة} [الأنعام: 61] فدلت هذه الآيات أنه تعالى في السماء وعلمه بكل مكان من أرضه وسمائه. وروى ذلك من الصحابة: عن عمر، وابن مسعود، وابن عباس، وأم سلمة ومن التابعين: ربيعة بن أبي عبد الرحمن، وسليمان التيمي، ومقاتل بن حيان وبه قال من الفقهاء: مالك بن أنس، وسفيان الثوري، وأحمد بن حنبل

“আল্লাহ তাআলার বাণী, ‘দয়াময় আরশে সমুন্নত হয়েছেন’- সম্পর্কে যা বর্ণিত হয়েছে তার আলোচনা। 

আল্লাহ আসমানে স্বীয় আরশের ওপরে রয়েছেন। তিনি আযযা ওয়া জাল্ল বলেন, ‘তাঁরই পানে উত্থিত হয় ভাল কথা আর নেক আমল তা উন্নীত করে’,

তিনি আরও বলেন, ‘যিনি আসমানে আছেন, তিনি তোমাদের সহ যমীন ধসিয়ে দেয়া থেকে কি তোমরা নিরাপদ হয়ে গেছ?’

তিনি বলেন, ‘আর তিনিই নিজ বান্দাদের উপর ক্ষমতাবান এবং তোমাদের উপর প্রেরণ করেন হিফাযতকারীদেরকে’।

এসকল আয়াত প্রমাণ করে যে আল্লাহ তাআলা আসমানে রয়েছেন, আর তাঁর জ্ঞান যমিন থেকে আসমান পর্যন্ত সর্বত্র বিরাজমান। 

এই মত বর্ণিত আছে বিভিন্ন সাহাবী থেকে, যেমন উমার, ইবন মাসঊদ, ইবন আব্বাস ও উম্মু সালামাহ [রা.]। এছাড়া বিভিন্ন তাবিঈ থেকেও বর্ণিত রয়েছে, যেমন রাবীআহ বিন আবি আব্দির রাহমান, সুলাইমান আত তাইমী ও মুক্বাতিল বিন হাইয়্যান [রাহ.]। এছাড়া ফকীহদের থেকেও বর্ণিত আছে, যেমন মালিক বিন আনাস, সুফইয়ান আস সাওরী ও আহমাদ বিন হাম্বল [রাহ.] থেকে অনুরূপ মত বর্ণিত আছে। 

৩৯) ইমাম আবু উমার আত তালামানকী আল মালিকী [রাহ.]: তিনি ছিলেন ইমাম, হাফিযুল হাদিস, মুহাক্কিক, মুহাদ্দিস ও আসারী। তিনি ছিলেন তাফসির ও ইলমের কিরাআতেরও ইমাম। আন্দালুসে তিনিই প্রথম ক্বিরাতশাস্ত্র নিয়ে যান। তিনি ৪২৯ হিজরিতে মারা যান। 

তিনি স্বীয় গ্রন্থ “আল উসুল ইলা মা’রিফাতিল উসূলে” বলেন, 

أجمع الْمُسلمُونَ من أهل السّنة على أَن معنى قَوْله {وَهُوَ مَعكُمْ أَيْن مَا كُنْتُم} وَنَحْو ذَلِك من الْقُرْآن أَنه علمه وَأَن الله تَعَالَى فَوق السَّمَوَات بِذَاتِهِ مستو على عَرْشه كَيفَ شَاءَ

وَقَالَ أهل السّنة فِي قَوْلِهِ {الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى} أَن الاسْتوَاء من الله على عَرْشه على الْحَقِيقَة لَا على الْمجَاز

“আহলুস সুন্নাহর অনুসারী মুসলিমরা এই বিষয়ে একমত (তাঁদের ইজমা রয়েছে) যে, আল্লাহর বাণী, ‘তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, তিনি তোমাদের সাথে রয়েছেন’, এরকম আরও যেসকল আয়াত কুরআনে রয়েছে, তার মানে হচ্ছে আল্লাহর ইলম বা জ্ঞান (বান্দার) সাথে রয়েছে। আর আল্লাহ তাআলা নিজে সত্তাগতভাবে আসমানসমূহের ওপারে স্বীয় আরশের ওপরে রয়েছেন, তিনি যেভাবে চেয়েছেন সেভাবেই রয়েছেন।

আহলুস সুন্নাহ আল্লাহর বাণী ‘দয়াময় আরশে সমুন্নত হয়েছেন’- এর ব্যাপারে বলে থাকে, আল্লাহ স্বীয় আরশে হাকীকীভাবেই বা বাস্তব অর্থেই সমুন্নত হয়েছেন, ইস্তিওয়া শব্দটি মাজাযী বা রূপকার্থে ব্যবহৃত হয়নি”।

৪০) ইমাম আবু নুআঈম আল আসবাহানী [রাহ.]: তিনি ছিলেন ইমাম, হাফিযুল হাদিস, নির্ভরযোগ্য রাবী, শাইখুল ইসলাম ও সুপ্রসিদ্ধ “হিলইয়াতুল আউলিয়া” গ্রন্থ প্রণেতা। মৃত্যু ৪৩০ হিজরিতে।

শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়াহ [রাহ.] বলেন,

وقال الحافظ أبو نعيم في كتابه ” محجة الواثقين ومدرجة الوامقين ” تأليفه: ” وأجمعوا أن الله فوق سمواته عال على عرشه مستو عليه لا مستول عليه كما تقول الجهمية إنه بكل مكان

“হাফিয আবু নুআঈম স্বপ্রণিত কিতাব ‘মাহাজ্জাতুল ওয়াসিক্বীন ওয়া মাদরাজুল ওয়ামিক্বীন’-এ বলেন, ‘এ বিষয়ে সবাই ইজমা করেছে বা একমত হয়েছে যে আল্লাহ আসমানসমুহের ওপারে রয়েছে, স্বীয় আরশের ওপরে সুউচ্চ রয়েছেন, এর ওপর সমুন্নত রয়েছেন। জাহমিয়্যারা যেমন বলে থাকে (অর্থ করে থাকে) যে তিনি এর ওপর প্রভাব বিস্তারকারী হয়েছেন এমন নয়, আবার তারা যেমনটা বলে থাকে যে তিনি সর্বত্র বিরাজমান-তেমনও নয়”। 

 ইমাম যাহাবী [রাহ.] আবু নুআঈম [রাহ.] থেকে উদ্ধৃতি উল্লেখ করেন, তিনি বলেন, 

إن الأحاديث التي ثبتت عن النبي صلى الله عليه وسلم في العرش، واستواء الله عليه، يثبتونها، من غير تكييف، ولا تمثيل، وأن الله تعالى بائن من خلقه، والخلق بائنون منه، لا يحل فيهم ولا يمتزج [بهم] ، وهو مستو على عرشه في سمائه دون أرضه

“আরশ ও তার ওপর আল্লাহর সমুন্নত হওয়া বিষয়ে যেসকল হাদিস নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে হাদিস প্রমাণিত, সালাফগণ সেগুলো সব্যস্ত করেন। তাঁরা এর কাইফ অর্থাৎ স্বরূপ বা প্রকৃতি বর্ণনা করেন না এবং একে সৃষ্টির সাথে সদৃশ মনে করেন না। 

আল্লাহ তাআলা স্বীয় সৃষ্টি থেকে পৃথক, আর সৃষ্টিকুলও তাঁর থেকে পৃথক। তিনি সৃষ্টির ভেতর প্রবেশ করেন না, সৃষ্টির মাঝে মিশে যান না। তিনি আসমানে স্বীয় আরশের ওপরে রয়েছেন, যমিনে নন”। 

৪১) ইমাম আবু নাসর আস সিজযী [রাহ.]: তিনি ছিলেন ইমাম, হাফিযুল হাদিস, শাইখুস সুন্নাহ, শাইখুল হারাম তথা হারাম শরীফের শাইখ, প্রসিদ্ধ হানাফী আলিম। তিনি ৪৪৪ হিজরিতে মারা যান। তিনি তাঁর আকিদাহ বিষয়ক কিতাব “আস সুন্নাহ”-তে বলেন, 

أَئِمَّتنَا كسفيان الثَّوْريّ وَمَالك وَحَمَّاد بن سَلمَة وَحَمَّاد بن زيد وسُفْيَان بن عُيَيْنَة والفضيل وَابْن الْمُبَارك وَأحمد وَإِسْحَاق متفقون على أَن الله سُبْحَانَهُ بِذَاتِهِ فَوق الْعَرْش وَعلمه بِكُل مَكَان

“আমাদের ইমামগণ যেমন সুফইয়ান আস সাওরী, মালিক, হাম্মাদ বিন সালামাহ, হাম্মাদ বিন যাইদ, সুফইয়ান বিন উয়াইনাহ, ফুদ্বাইল, ইবনুল মুবারাক, আহমাদ ও ইসহাক [রাহ.] এই বিষয়ে একমত যে আল্লাহ সুবহানাহ সত্তাগতভাবে আরশের ওপর রয়েছেন। আর তাঁর জ্ঞান সর্বত্র বিরাজমান”।

৪২) ইমাম আবু উসমান আস সাবূনী আশ শাফিঈ [রাহ.]: তিনি ছিলেন ইমাম, আল্লামা, অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব, মুফাসসির, মুহাদ্দিস, আকিদার ইমাম ও শাইখুল ইসলাম। তিনি ৪৪৯ হিজরিতে মারা যান।  আকিদাহ বিষয়ে তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হচ্ছে “আকিদাতুস সালাফ ওয়া আসহাবিল হাদিস”। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রসিদ্ধ গ্রন্থ। এই গ্রন্থে তিনি বলেন, 

ويعتقد أصحاب الحديث ويشهدون أن الله سبحانه فوق سبع سماواته على عرشه مستوٍ كما نطق به كتابه

“মুহাদ্দিসগণ এই আকিদাহ পোষণ করেন এবং এই সাক্ষ্য দেন যে আল্লাহ সুবহানাহ সাত আসমানের ওপারে স্বীয় আরশের ওপরে সমুন্নত রয়েছেন, যেমনটা তাঁর কিতাব (অর্থাৎ কুরআন) বলেছে”। এরপর তিনি এর স্বপক্ষে বেশ কিছু আয়াতের উদ্ধতি দেন। অতঃপর বলেন, 

وعلماء الأمة وأعيان الأئمة من السلف رحمهم الله لم يختلفوا في أن الله تعالى على عرشه، وعرشه فوق سماواته

“এই উম্মতের আলিমগণ ও সালাফের নেতৃস্থানীয় ইমামগণ রাহ. এই বিষয়ে কখনো ইখতিলাফ করেন নি যে, আল্লাহ তাআলা স্বীয় আরশের ওপর রয়েছেন, আর আরশ রয়েছে আসমানসমূহের ওপারে”।

৪৩) ইমাম ইবন আব্দিল বারর আল মালিকী [রাহ.]: তিনি ছিলেন মালিকী ফিকহের প্রসিদ্ধতম ইমামগণের একজন, হাফিযুল মাগরিব তথা মাগরিবের প্রধানতম হাফিযে হাদিস, শাইখুল ইসলাম। “আত তামহিদ”, “আল ইসতিযকার”, “আল ইস্তিআবের” মত প্রসিদ্ধ গ্রন্থসমূহের প্রণেতা। তিনি ৪৬৩ হিজরিতে মারা যান। 

সূরা আল মুজাদালার ৭ নং আয়াতটি হচ্ছে: 

مَا يَكُونُ مِنْ نَجْوَى ثَلاثَةٍ إِلَّا هُوَ رَابِعُهُمْ وَلا خَمْسَةٍ إِلَّا هُوَ سَادِسُهُمْ وَلا أَدْنَى مِنْ ذَلِكَ وَلا أَكْثَرَ إِلَّا هُوَ مَعَهُمْ أَيْنَ مَا كَانُوا

“তিন জনের কোন গোপন পরামর্শ হয় না যাতে চতুর্থজন হিসেবে আল্লাহ থাকেন না, আর পাঁচ জনেরও হয় না, যাতে ষষ্ঠজন হিসেবে তিনি থাকেন না। এর চেয়ে কম হোক কিংবা বেশি হোক, তিনি তো তাদের সঙ্গেই আছেন, তারা যেখানেই থাকুক না কেন”।

এর ব্যাখ্যায় ইমাম ইবন আব্দিল বারর [রাহ.] বলেন, 

لأنَّ علماءَ الصحابةِ والتابعينَ الذين حُمِلت عنهم التآويلُ في القرآن قالوا – في تأويل هذه الآية -: هو على العرش، وعلمُه في كلِّ مكانٍ

“সাহাবা ও তাবিঈদের যেসকল আলিমদের থেকে কুরআনের ব্যাখ্যা গ্রহণ করা হয় তাঁরা বলেছেন, এই আয়াতের ব্যাখ্যা হল: আল্লাহ আরশের ওপর রয়েছে, আর তাঁর জ্ঞান সর্বত্র বিরাজমান”।

আল্লাহ তাআলার দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করা বা নুযুল বিষয়ক হাদিসের ব্যাখ্যায় তিনি লিখেছেন, 

وفيه دليلٌ على أنَّ الله عز وجل ‌في ‌السَّماءِ ‌على ‌العرشِ ‌من ‌فوقِ ‌سبعِ ‌سماواتٍ، كما قالت الجماعةُ. وهو من حُجَّتِهم على المعتزلةِ والجهميّةِ في قولهم: إنَّ الله عز وجل في كلِّ مكانٍ وليس على العرشِ

“এতে এ বিষয়ের দলিল রয়েছে যে আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্ল সাত আসমানের ওপারে স্বীয় আরশের ওপরে রয়েছেন-যেমনটা আল জামাআত (অর্থাৎ আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআত) বলেছে। মুতাযিলা আর জাহমিয়্যারা যে বলে, আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্ল আরশে নন বরং সর্বত্র বিরাজমান-এই  মতের বিরুদ্ধে এই হাদিসটি এসকল আলিমের স্বপক্ষে দলীল”।  

এই হাদিসের ব্যাখ্যায় অপর গ্রন্থে তিনি বলেন, 

وَفِي هَذَا الْحَدِيثِ دَلِيلٌ عَلَى أَنَّ اللَّهَ عز وجل ‌فِي ‌السَّمَاءِ ‌عَلَى ‌الْعَرْشِ مِنْ فَوْقِ سَبْعِ سَمَاوَاتٍ وَعِلْمُهُ فِي كُلِّ مَكَانٍ كَمَا قَالَتِ الْجَمَاعَةُ أَهْلُ السُّنَّةِ أَهْلُ الْفِقْهِ وَالْأَثَرِ

“এই হাদিসে এই বিষয়ের দলীল রয়েছে যে, আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্ল সাত আসমানের ওপরে আরশে রয়েছেন। আর তাঁর জ্ঞান সর্বত্র বিরাজমান- যেমনটা সুন্নাতের অনুসারী, ফিকহ ও আসারের অনুসারী জামাআত বলে থাকে”।

৫০১ থেকে ৭৫০ হিজরি পর্যন্ত আলিমদের বক্তব্য: 

৪৪) মুহিউস সুন্নাহ আল হুসাইন আল বাগাউই আশ শাফিঈ [রাহ.]: তিনি ছিলেন ইমাম, আল্লামা, অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব, হাফিযুল হাদিস, শাইখুল ইসলাম, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও শাফিঈ ফকীহ। প্রসিদ্ধ তাফসির “মাআলিমুত তানযীল” ও উপমহাদেশের হাদিস বিষয়ক প্রসিদ্ধ পাঠ্য মিশকাতুল মাসাবিহ গ্রন্থের মূল “মাসাবিহুস সুন্নাহ” তাঁর প্রসিদ্ধ কীর্তি। তিনি ৫১০ হিজরিতে মারা যান। 

তিনি ইস্তিওয়া বিষয়ক আয়াত এবং আল্লাহ তাআলার অন্যান্য সিফাত বিষয়ক বেশ কিছু আয়াত ও হাদিস উল্লেখ করার পর লেখেন, 

فَهَذِهِ وَنَظَائِرُهَا صِفَاتٌ لِلَّهِ عز وجل، وَرَدَ بِهَا السَّمْعُ، يَجِبُ الإِيمَانُ بِهَا، وَإِمْرَارُهَا عَلَى ظَاهِرِهَا مُعْرِضًا فِيهَا عَنِ التَّأْوِيلِ، مُجْتَنِبًا عَنِ التَّشْبِيهِ، مُعْتَقِدًا أَنَّ الْبَارِي سبحانه وتعالى لَا يُشْبِهُ شَيْءٌ مِنْ صِفَاتِهِ صِفَاتِ الْخَلْقِ، كَمَا لَا تُشْبِهُ ذَاتُهُ ذَوَاتِ الْخَلْقِ، قَالَ اللَّهُ سبحانه وتعالى: {لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ} [الشورى: 11]

وَعَلَى هَذَا مَضَى سَلَفُ الأُمَّةِ وَعُلَمَاءُ السُّنَّةِ، تَلَقَّوْهَا جَمِيعًا بِالإِيمَانِ وَالْقَبُولِ، وَتَجَنَّبُوا فِيهَا عَنِ التَّمْثِيلِ وَالتَّأْوِيلِ

“এগুলো এবং এদের মত আরও যা এসেছে, এ সবই আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্ল-এর সিফাত। কুরআন-হাদিসে এগুলো বর্ণিত হয়েছে। এদের ওপর ঈমান না তথা বিশ্বাস করা আবশ্যক। এগুলোকে বাহ্যিক অর্থেই চালিয়ে দিতে হবে, তাবিল তথা অপব্যাখ্যা থেকে বিরত থাকতে হবে, সৃষ্টির সাথে তাশবিহ বা সাদৃশ্য দেয়া থেকেও বেঁচে থাকতে হবে। এই আকিদাহ রাখতে হবে যে, আল বারী সুবহানাহ ওয়া তাআলা তাঁর কোনো সিফাত বা বৈশিষ্ট্যেই সৃষ্টির বৈশিষ্ট্যের অনুরূপ নন। যেভাবে তাঁর সত্তাও সৃষ্টিসমূহের সত্তার মত নয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন, ‘তাঁর মত কিছুই নেই, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা’। আর এ আকিদাহ লালন করেই এই উম্মতের সালাফ ও সুন্নাতের আলিমগণ গত হয়েছেন। তাঁরা এসবের ওপরই ঈমানে এনে এদের গ্রহণ করে নিয়েছেন এবং এসকল সিফাতের ক্ষেত্রে তামসিল তথা সৃষ্টির সাদৃশ্য গ্রহণ ও তাবিল বা অপব্যাখ্যা উভয়টা থেকেই দূরে থেকেছেন”।

৪৫) ইমাম ইয়াহইয়া বিন সালিম আল ইমরানী আশ শাফিঈ [রাহ.]: তিনি ছিলেন প্রখ্যাত শাফিঈ ফকীহ এবং ইয়ামানের শাফিঈদের শাইখ। ৫৫৮ হিজরিতে মারা যান। আকিদাহ, ফিকহ, আত্মশুদ্ধি প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর লেখনী পাওয়া যায়। তিনি মু’তাযিলা ও কাদরিয়্যাদের খণ্ডন করে, الانتصار في الرد على المعتزلة القدرية الأشرار নামক একটি পৃথক গ্রন্থই লিখেছেন। এটি সৌদির আরবের রিয়াদ থেকে ড. সাঊদ বিন আব্দিল আযীযের তাহকীকে ৩ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। এই গ্রন্থে তিনি বলেন, 

عند أصحاب الحديث والسنة ‌أن ‌الله ‌سبحانه ‌بذاته بائن عن خلقه، على العرش استوى فوق السموات، غير مماس له، وعلمه محيط بالأشياء كلها

“আসহাবুল হাদিস ওয়াস সুন্নাহ তথা আহলুস সুন্নাহর মতে আল্লাহ সুবহানাহ স্বত্ত্বাগতভাবে সৃষ্টি থেকে পৃথক, আসমানসমূহের ওপারে আরশকে স্পর্শ করা ব্যতীত আরশের ওপর সমুন্নত। আর তাঁর জ্ঞান সব কিছুকে পরিবেষ্টন করে রয়েছে”।

৪৬) ইমাম মুওয়াফফাকুদ দ্বীন ইবন কুদামাহ আল মাকদিসী আল হাম্বলী [রাহ.]: তিনি ছিলেন ফকীহ, মুহাদ্দিস, যাহিদ, আবিদ। তিনি ছিলেন হাম্বলী ফিকহের সবচাইতে বড় ফকীহদের একজন। তাঁর রচিত “আল মুগনী” কেবল হাম্বলী ফিকহেরই নয়, ফিকহে মুকারানার জন্য ইসলামের সকল মাযহাবের কাছেই অত্যন্ত সমাদৃত গ্রন্থ। এটি ছাড়াও “আল মুক্বনী”, “আল কাফী” ও “উমদাতুল ফিকহের” মত প্রসিদ্ধ গ্রন্থ তাঁর রচনা। উসূলে ফিকহে লিখেছেন “রাউদ্বাতুন নাযির”, আকিদায় লিখেছে, “লুমআতুল ই’তিক্বাদ”, ‘যাম্মুত তাউইল”, “তাহরিমুন নাযর ফি কুতুবিল কালাম”-এর মত গ্রন্থ। উত্তরকালের হাম্বলী ফিকহ বহুলাংশে তাঁকে ঘিরেই আবর্তিত। তিনি ৬২০ হিজরিতে মারা যান। 

আল্লাহ তাআলার সুউচ্চতার বিষয়ে তিনি إثبات صفة العلو নামক একটি গ্রন্থই প্রণয়ন করেছেন। এই গ্রন্থের শুরুতেই তিনি বলেন, 

‌فإن ‌الله ‌تعالى ‌وصف ‌نفسه بالعلو في السماء، ووصفه بذلك محمد خاتم الأنبياء، وأجمع على ذلك جميع العلماء من الصحابة الأتقياء والأئمة من الفقهاء، وتوارترت الأخبار بذلك على وجه حصل به اليقين، وجمع الله تعالى عليه قلوب المسلمين

“আল্লাহ তাআলা নিজেকে আসমানে সুউচ্চ থাকার সিফাত দ্বারা বিভূষিত করেছেন। খাতামুল আম্বিয়া মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও তাঁকে এই গুণে বিভূষিত বলে ঘোষণা করেছেন। এই বিষয়ে মুত্তাকী সাহাবাদের সকল আলিম ও সকল ফকীহ ইমাম একমত পোষণ করেছেন। এই বিষয়ক বর্ণনাসমূহ তাওয়াতুরের সাথে এভাবে পাওয়া গিয়েছে যে তাতে ইয়াকীন বা দৃঢ় বিশ্বাস অর্জিত হয়। আল্লাহ তাআলা মুসলিমদের অন্তরসমূহকে এই কথার ওপর একমত করে দিয়েছেন”। 

৪৭) ইমাম আবুল হাসান আল কারাজী আশ শাফিঈ [রাহ.]: তিনি ছিলেন ইমাম আবু ইসহাক আশ শিরাজীর [রাহ.] ছাত্র, শাফিঈ ফকীহ, কারাজের শাফিঈদের শাইখ ও মুফতী। এই কারাজ হচ্ছে ইসলামী জুর্জান রাজ্য, এটি আধুনিক জর্জিয়ায় লীন হয়েছে। তিনি ৫৩২ হিজরিতে মারা যান। তিনি কবি হিসেবেও প্রসিদ্ধ ছিলেন।

তিনি আসহাবুল হাদিস তথা আহলুস সুন্নাহর আকিদাহ কাব্যাকারে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, 

عقائدهم أن الإله بذاته … على عرشه مَعْ علمه بالغوائب

“তাঁদের আকিদাহ হল ইলাহ স্বীয় আরশের ওপর আছেন সত্তাগতভাবে, সকল গায়েবী বিষয়ের ব্যাপারেই তাঁর ইলম রয়েছে”।

৪৮) ইমাম ইবনুস সালাহ আশ শাফিঈ [রাহ.]: তিনি ছিলেন ইমাম, আল্লামা, হাফিযুল হাদিস, শাইখুল ইসলাম, শাফিঈ আলিম এবং উলুমুল হাদিসের প্রসিদ্ধতম আলিমদের একজন। তাঁর রচিত “উলুমুল হাদিস” বা “মা’রিফাতু আনওয়াই উলুমিল হাদিস” বা “মুকাদ্দিমাতু ইবনিস সালাহ” গ্রন্থটি উলুমুল হাদিসের অন্যতম মৌলিক গ্রন্থ। তিনি ৬৪৩ হিজরিতে মারা যান। 

ইমাম যাহাবী [রাহ.] উল্লেখ করছেন যে, ওপরে উল্লেখিত ইমাম আবুল হাসান আল কারাজীর [রাহ.] আকিদাহ বিষয়ক রচনাটি ইমাম ইবনুস সালাহর [রাহ.] হস্তলিখিত কপিতে বিদ্যমান ছিল। যার শুরুতে ইমাম ইবনুস সালাহর [রাহ.] স্বহস্তে লিখিত ছিল-

هذه عقيدة أهل السنة وأصحاب الحديث

“এটা হচ্ছে আহলুস সুন্নাহ ও আসহাবুল হাদিসের আকিদাহ”।

এথেকে বোঝা যায় যে ইমাম ইবনুস সালাহও [রাহ.] একই আকিদাহ পোষণ করতেন। 

৪৯) ইমাম আবু আব্দিল্লাহ আল কুরতুবী [রাহ.]: তিনি ছিলেন প্রখ্যাত মালিকী ফকীহ, মুফাসসির, প্রসিদ্ধ তাফসির “আল জামি লি আহকামিল কুরআনের” লেখক। তিনি ৬৭১ হিজরিতে মারা যান।

তিনি বলেন, 

ما تظاهرت عليه الآي والأخبار أن الله سبحانه على عرشه كما أخبر في كتابه وعلى لسان نبيه بلا كيف، بائن من جميع خلقه هذا جملة مذهب السلف الصالح فيما نقل عنهم الثقات

“আয়াতসমূহ ও হাদিস থেকে এটা প্রতীয়মান হয়ে যে আল্লাহ সুবহানাহ স্বীয় আরশের ওপর রয়েছেন, যেমনটা তিনি স্বীয় কিতাবে জানিয়েছেন, এবং স্বীয় নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জবানীতে জানিয়েছেন। এটা মানতে হবে কোনো ধরণ বা স্বরূপ নির্ধারণ ব্যতীত। তিনি সৃষ্টিকুল থেকে পৃথক রয়েছেন। এটা এক কথায় সালাফুস সালিহ বা নেককার পূর্বসুরিদের মাযহাব, যা তাঁদের থেকে নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীগণ বর্ণনা করেছেন”।

অন্যত্র তিনি লিখেছেন, 

وقد كان السلف الأول رضي الله عنهم لا يقولون بنفي الجهة ولا ينطقون بذلك، بل نطقوا هم والكافة بإثباتها لله تعالى كما نطق كتابه وأخبرت رسله. ولم ينكر أحد من السلف الصالح أنه استوى على عرشه حقيقة. وخص العرش بذلك لأنه أعظم مخلوقاته، وإنما جهلوا كيفية الاستواء فإنه لا تعلم حقيقته. قال مالك رحمه الله: الاستواء معلوم- يعني في اللغة- والكيف مجهول، والسؤال عن هذا بدعة

“প্রথম দিককার পূর্বসুরিগণ, আল্লাহ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান, (আল্লাহর জন্য) দিককে অস্বীকার করে কিছু বলতেন না (অর্থাৎ তাঁরা বলতেন না যে আল্লাহ ওপরের দিকে নেই), আর না তাঁরা এই বিষয়ে কথা বলতেন; বরং তাঁরা যখন (এই বিষয়ে) বলতেন তখন আল্লাহ তাআলার জন্য অতটুকু সাব্যস্ত করাই যথেষ্ট মনে করতেন যতটুকু আল্লাহর কিতাব বলেছে এবং তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জানিয়েছেন। সালাফুস সালিহের কেউ এই কথা অস্বীকার করেনি যে আল্লাহ হাকীকী বা প্রকৃত অর্থেই আরশে সমুন্নত হয়েছেন। 

তিনি আরশকে বিশেষভাবে বেছে নিয়েছেন এজন্য যে এটি সবচাইতে বড় সৃষ্টি।  

সালাফগণ সমুন্নত হবার ধরণ সম্পর্কে জানতেন না, কারণ এর স্বরূপ জানা যায় না। ইমাম মালিক [রাহ.] বলেছেন, ‘ইস্তিওয়া বা সমুন্নত হওয়া জ্ঞাত’, অর্থাৎ আরবি ভাষায় এর অর্থ জ্ঞাত, ‘তবে (আল্লাহর ক্ষেত্রে) এর স্বরূপ অজ্ঞাত। আর এই বিষয়ে প্রশ্ন করা বিদআত’”।

৫০) ইমাম শামসুদ্দীন আয যাহাবী [রাহ.]: তিনি ছিলেন হাফিযুল হাদিস, ঐতিহাদিস, ফকীহ, মুহাদ্দিস ও আকিদার ইমাম। “সিয়ারু আ’লামিন নুবালা”, “তাযকিরাতুল হুফফায”, “মীযানুল ই’তিদাল”, “আল কাশিফ”, “আল কাবাইর” ও “তারিখুল ইসলামের” মত প্রসিদ্ধ গ্রন্থসমূহের লেখক । তিনি ৭৪৮ হিজরিতে মারা যান। 

ইমাম আয যাহাবী [রাহ.] আল্লাহ তাআলার উলু বা সুউচ্চ হওয়া বিষয়ে পৃথক একটি গ্রন্থই প্রণয়ন করেছেন, যার নাম “আল উলূ লি আলিয়্যিল গাফফার”। এই গ্রন্থে তিনি আল্লাহ তাআলার উলূ বিষয়ে আয়াত, হাদিস এবং সালাফের প্রচুর বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। 

এছাড়া জাহমিয়্যারা আল্লাহ তাআলার আরশে সমুন্নত হওয়াকেও অস্বীকার করে বিধায় তিনি আরশ সম্পর্কেও একটি পৃথক গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন, এর নাম “আল আরশ”। এই গ্রন্থে কুরআন, হাদিস, সাহাবা ও তাবিঈদের বক্তব্যের আলোকে আরশ কী এবং আল্লাহ তাআলার আরশে সমুন্নত হবার মাসআলা সম্পর্কে পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা স্থান পেয়েছে।

তিনি আল উলূ গ্রন্থে বলেন, 

‌وَالله ‌فَوق ‌عَرْشه ‌كَمَا ‌أجمع ‌عَلَيْهِ الصَّدْر الأول وَنَقله عَنْهُم الْأَئِمَّة

“আল্লাহ স্বীয় আরশের ওপরে রয়েছেন, এই বিষয়ে ইসলামের প্রথম যুগের ব্যক্তিবর্গ একমত ছিলেন, এবং তাঁদের থেকে ইমামগণ তা বর্ণনা করেছেন”।

তিনি অপর গ্রন্থ আল আরশে বলেন, 

‌الدليل ‌على ‌أن ‌الله ‌تعالى ‌فوق ‌العرش، فوق المخلوقات، مباين لها، ليس بداخل في شيء منها، على أن علمه في كل مكان.

الكتاب، والسنة، وإجماع الصحابة، والتابعين، والأئمة المهديين

“আল্লাহ তাআলা আরশের ওপরে রয়েছেন, সকল মাখলুকের ওপরে রয়েছেন, মাখলুক থেকে পৃথক রয়েছে, তিনি কোনো মাখলুকের মাঝে প্রবিষ্ট নন, আর তাঁর ইলম বা জ্ঞান সর্বত্র বিরাজমান- এই আকিদার দলিল হচ্ছে কুরআন, হাদিস, সাহাবা, তাবিঈ ও হিদায়াতপ্রাপ্ত ইমামগণের ইজমা”।

পেছনের আলোচনা থেকে এটা সুস্পষ্টরূপেই প্রতীয়মান যে, আল্লাহ তাআলা যে আরশে সমুন্নত, সৃষ্টি থেকে পৃথক এবং সৃষ্টিকুল হতে সুউচ্চ- এই আকিদাহ সালাফ ও এরপর সুদীর্ঘ কাল পর্যন্ত উলামায়ে কিরামের সমন্বিত আকিদাহ ছিল। প্রথম যুগে জাহমিয়্যারা এর বিরোধিতা করতো। এক পর্যায়ে নিজেদের আহলুস সুন্নাহ দাবিদার কিছু দলের অনুসারীরাও এই আকিদার বিরোধী হয়ে যায়। অথচ সালাফের যুগ থেকে এই আকিদাই ছিল আহলুস সুন্নাহ-এর আকিদাহ।

মূল আলোচনাকে সংক্ষিপ্ত রাখার লক্ষ্যে এই নিবন্ধে মোট ৫০ জন ব্যক্তির উদ্ধৃতি উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন যুগের ইমাম। এই তালিকায় সাহাবা-তাবিঈ থেকে শুরু করে পরের যুগের ফকীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির, আরবিভাষাবিদ, ঐতিহাসিক- সকল শাস্ত্রেরই বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য স্থান পেয়েছে।

খেয়াল করলে দেখা যাবে যে এর মধ্যে হানাফী, শাফিঈ, হাম্বলী ও মালিকী অর্থাৎ ৪ মাযহাবের নির্ভরযোগ্য ইমামগণের বক্তব্যই স্থান পেয়েছে। অর্থাৎ উত্তরকালে এই আকিদাহ কেবল হাম্বলীরা একা পোষণ করেছে, এটি ভুল ধারণা। একথা সত্য যে কালক্রমে শাফিঈ-মালিকীদের মধ্যে আশআরী এবং হানাফীদের মধ্যে মাতুরিদীদের প্রাধান্য এতটা বেড়ে যায় যে আকিদার ক্ষেত্রে এটাই তাদের অফিসিয়াল মাযহাবে পরিণত হয়, কিন্তু আমরা দেখেছি যে পূর্বে বিষয়টা মোটেও এমন ছিল না। 

মনে রাখতে হবে, এই বিষয়ে চাইলে আরও অনেক আলিমের উদ্ধৃতি উল্লেখ করা সম্ভব, ইমাম যাহাবী [রাহ.] “আল আরশে” ২৮৪ জন, আর “আল উলূ”তে ৫৯৫ জন মহান ব্যক্তিত্বের উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছেন। এসকল আলিমগণ তাঁর পূর্বের ব্যক্তিত্ব। অর্থাৎ ৭ম হিজরি শতকের আগের। এরপরেও যুগে যুগে আলিমগণ এই আকিদাকে অনুসরণ করেছেন। তাঁরা সবাই ছিলেন ইমাম। 

সে হিসেবে এই নিবন্ধকে কেবল tip of the iceberg বলা চলে। তবে ইন শা আল্লাহ, হিদায়াত প্রত্যাশীদের জন্য এটুকুই যথেষ্ট। 

References:

এই নিবন্ধটি প্রাবন্ধিকা উম্মু আব্দিল্লাহ আল মীসাউইর প্রবন্ধ: عقيدة السلف الصالح

أهل السنة والجماعة

في صفة الاسْتِوَاء وعُلُوِّ الله على خَلْقِه-কে মূল ধরে রচিত।

2 সূরা আলে ইমরান: ১৪৪

3 ইমাম ইবন আবি শাইবাহ (রাহ.), আল মুসান্নাফ, হা: ৩৯৭৯৮; ইমাম বাযযার (রাহ.), আল মুসনাদ, হা; ১০৩; ইমাম যাহাবী (রাহ.), আল উলু, হা; ১৬৫; ইমাম যাহাবী (রাহ.) ও শাইখ সা’দ আশ শাসরীর (হাফি.) মতে সহিহ।