আল্লাহ তাআলার আরশে ইস্তিওয়া ও সৃষ্টিকুল থেকে সুউচ্চ হওয়া বিষয়ে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের সালাফুস সালিহীনের আকীদাহ পর্ব: ১

بسم الله الرحمن الرحيم

এই প্রবন্ধটিতে আল্লাহ তাআলার দুটি সিফাত “ইস্তিওয়া আলা আরশ” বা আরশে সমুন্নত হওয়া এবং علو الله على خلقه তথা তিনি যে সৃষ্টিকুল হতে সুউচ্চ- এই বিষয়ে সালাফুস সালিহীন বা আমাদের নেককার পূর্বসুরিদের আকিদাহ কয়েকটি পয়েন্টে আলোচিত হবে। তাঁদেরকে আহলুল আসার ও আসহাবুল হাদিসও বলা হয়। আর তাঁরাই হচ্ছেন আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মূল। কাজেই তাঁদের আকিদাহই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকিদাহ বলে বিবেচ্য। 

সালাফ তথা আহলুস সুন্নাহর ইমামগণের আকিদাহ:

১) আল্লাহ আযযা ওয়া জাল আরশ, আসমানসমূহ এবং সকল সৃষ্টিকুলের ঊর্ধে। 

কুরআন থেকে প্রমান:

আল্লাহ তাআলা বলেন,  الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى

“দয়াময় আরশে সমুন্নত”।

আর আরশ হচ্ছে সর্বোচ্চ মাখলুক। আরশ সকল মাখলুক এবং আসমানসমূহেরও ওপরে। এথেকে বোঝা যায় যে আল্লাহ আযযা ওয়া জাল সকল মাখলুক থেকে ঊর্ধে। 

২) আল্লাহ তাআলা বলেন: يَخَافُونَ رَبَّهُمْ مِنْ فَوْقِهِمْ وَيَفْعَلُونَ مَا يُؤْمَرُونَ

“তারা তাদের উপরস্থ রবকে ভয় করে এবং তাদেরকে যা নির্দেশ দেয়া হয়, তারা তা করে”। 

৩) তিনি বলেন: تَعْرُجُ الْمَلائِكَةُ وَالرُّوحُ إِلَيْهِ فِي يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُهُ خَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍ

“ফেরেশতা এবং রূহ আল্লাহ্‌র দিকে উর্ধ্বগামী হয় এমন এক দিনে, যার পরিমাণ পঞ্চাশ হাজার বছর”।

এই আয়াতে আসা العروج শব্দটির অর্থ হচ্ছে الصعود বা ঊর্ধে গমন, আরোহণ। এর মানে হচ্ছে ফেরেশতারা আল্লাহ আযযা ওয়া জাল-এর দিকে ঊর্ধ্বগামী হয়। কেননা তিনি ঊর্ধে রয়েছেন।

৪) আল্লাহ তাআলা বলেন: 

وَقَوْلِهِمْ إِنَّا قَتَلْنَا الْمَسِيحَ عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ رَسُولَ اللَّهِ وَمَا قَتَلُوهُ وَمَا صَلَبُوهُ وَلَكِنْ شُبِّهَ لَهُمْ وَإِنَّ الَّذِينَ اخْتَلَفُوا فِيهِ لَفِي شَكٍّ مِنْهُ مَا لَهُمْ بِهِ مِنْ عِلْمٍ إِلَّا اتِّبَاعَ الظَّنِّ وَمَا قَتَلُوهُ يَقِينًا * بَلْ رَفَعَهُ اللَّهُ إِلَيْهِ

“আর আমরা আল্লাহর রাসূল মারইয়াম তনয় ‘ঈসা মসীহকে হত্যা করেছি’ তাদের এ উক্তির জন্য। অথচ তারা তাঁকে হত্যা করেনি এবং ক্রুশবিদ্ধও করেনি; বরং তাদের জন্য (এক লোককে) তাঁর সদৃশ করা হয়েছিল। আর নিশ্চয় যারা তাঁর সম্বন্ধে মতভেদ করেছিল, তারা অবশ্যই এ সম্বন্ধে সংশয়যুক্ত ছিল; এ সম্পর্কে অনুমানের অনুসরণ ছাড়া তাদের কোন জ্ঞানই ছিল না। আর এটা নিশ্চিত যে, তারা তাঁকে হত্যা করেনি; বরং আল্লাহ তাঁকে তাঁর নিকট তুলে নিয়েছেন”।

ইমাম আবুল হাসান আশআরী [রাহ.] লিখেছেন, وأجمعت الأمة على أن الله عز وجل رفع عيسى إلى السماء

“গোটা উম্মাহ এই বিষয়ে একমত যে আল্লাহ আযযা ওয়া জাল ঈসা [আ.] কে আসমানে তুলে নিয়েছেন”।

কাজেই বোঝা গেল যে আল্লাহ আযযা ওয়া জাল যেহেতু ঈসা [আ.] কে তাঁর কাছে তথা আসমানের ওপরে তুলে নিয়েছেন, সেহেতু তিনি আসমানসমূহের ঊর্ধে রয়েছেন। এজন্য ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল [রাহ.] এই আয়াত দিয়ে জাহমিয়াদের দাবি খণ্ডন করেছেন এবং আল্লাহ তাআলার সুউচ্চতাকে সত্যায়ন করেছেন।

৫) আল্লাহ আযযা ওয়া জাল বলেন: أَأَمِنْتُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ أَنْ يَخْسِفَ بِكُمُ الْأَرْضَ فَإِذَا هِيَ تَمُورُ

যিনি আসমানে আছেন, তিনি তোমাদের সহ যমীন ধসিয়ে দেয়া থেকে কি তোমরা নিরাপদ হয়ে গেছ, অতঃপর আকস্মিকভাবে তা থর থর করে কাঁপতে থাকবে?”

নিশাপুরের শাফিঈ মাযহাবের প্রখ্যাত ফকীহ এবং ইমাম হাকিমের [রাহ.] উস্তায ইমাম আবু বাকর আহমাদ আস সিবগী রাহ. [মৃত্যু ৩৪২ হি.] বলেন, “আরবরা “على” এর প্রয়োগস্থলে “في” প্রয়োগ করে থাকে। যেমন আল্লাহ আযযা ওয়া জাল বলেন: فَسِيحُوا فِي الْأَرْضِ

“তোমরা জমিনের ওপর বিচরণ করো”

তিনি আরও বলেন, وَلَأُصَلِّبَنَّكُمْ فِي جُذُوعِ النَّخْلِ

“আমি তোমাদেরকে খেজুর গাছের কান্ডে শূলিবিদ্ধ করবই”।

উভয় আয়াতে (ফী দ্বারা) উদ্দেশ্য হচ্ছে  على الأرض وعلى النخل অর্থাৎ জমিনের ওপরে এবং খেজুর কান্ডের ওপর (ভেতরে নয়)। একইভাবে في السماء এর অর্থ হচ্ছে على العرش فوق السماء আসমানের ওপরে আরশের ঊর্ধে (আসমানের ভেতরে নয়), যেমনটা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত সহিহ হাদিস থেকে জানা যায়”। 

সংক্ষেপের জন্য এটুকু ব্যাখ্যাই যথেষ্ট। في السماء শব্দজোড়ের ব্যাখ্যায় উলামাদের অবস্থান অন্য একটি নিবন্ধে ইন শা আল্লাহ বিস্তারিত আলোচিত হবে। 

৬) আল্লাহ তাআলা বলেন: هُوَ الأوَّلُ وَالآخِرُ وَالظَّاهِرُ وَالْبَاطِنُ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ

 “তিনিই প্রথম ও শেষ; তিনিই যাহির ও তিনিই বাতিন, আর তিনি সবকিছু সম্পর্কে সম্যক অবগত”।

এই আয়াতে আসা শব্দসমূহের ব্যাখ্যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই করে দিয়েছেন। তিনি বিছানায় শয়ন করার জন্য একটি দুআ শিখিয়েছেন, যার একটি অংশ হচ্ছে-

اللَّهُمَّ أَنْتَ الْأَوَّلُ فَلَيْسَ قَبْلَكَ شَيْءٌ، وَأَنْتَ الْآخِرُ فَلَيْسَ بَعْدَكَ شَيْءٌ، وَأَنْتَ الظَّاهِرُ فَلَيْسَ

فَوْقَكَ شَيْءٌ، وَأَنْتَ الْبَاطِنُ فَلَيْسَ دُونَكَ شَيْءٌ

“হে আল্লাহ, আপনিই প্রথম, আপনার পূর্বে কিছু ছিল না। আপনিই শেষ, আপনার পরেও কিছু থাকবে না। আপনি যাহির (সুউচ্চ-প্রকাশ্য), আপনার ওপরে কিছু নেই, আর আপনিই বাতিন (আপ্রকাশ্য), আপনার চেয়ে অধিক নিকটবর্তী কেউ নেই”। 

এই হাদিসে دونك শব্দের মানে হচ্ছে أقرب বা সর্বাধিক নিকটবর্তী। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা স্বীয় ইলমের মাধ্যমে বান্দার সর্বাধিক নিকটবর্তী। 

ইমাম ইবন জারির আত তাবারী রাহ. [মৃত্যু: ৩১০ হি.] আল্লাহ তাআলার এই সিফাতসমূহের ব্যাখ্যায় লিখেছেন, “আল্লাহর বাণী, وَالظَّاهِر এর ব্যাখ্যা হচ্ছে, যেমন বলা হয়ে থাকে, ‘সে তাঁর নিচের সব কিছুর ওপর যাহির, মানে সে সকল কিছুর ঊর্ধে সুউচ্চ। তাঁর চেয়ে উচ্চ কিছু নেই। 

আর وَالْبَاطِنُ বাতিন মানে হচ্ছে, যেমন বলা হয় সে সকল কিছুর চেয়ে বাতিন। অর্থাৎ সে কোনো বস্তুর যত নিকটে রয়েছে, কোনো কিছুই তার অতটা নিকটবর্তী নয়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন: وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيدِ

‘আর আমরা তার গ্ৰীবাস্থিত ধমনীর চেয়েও নিকটতর’”।

ইমাম তাবারী [রাহ.] এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, بالعلم بما تُوَسْوس به نفسه.

“অর্থাৎ ইলমের বা জ্ঞানের মাধ্যমে তিনি নিকটতর হয়ে জানেন যে ব্যক্তির নফস তাকে কী কী কুমন্ত্রণা দিয়ে থাকে”।

ইমাম ইবন আবি যামানীন রাহ. [মৃত্যু: ৩৯৯ হি.] এর ব্যাখ্যায় লিখেছেন, “আয যাহির অর্থাৎ তিনি সকল সৃষ্টিকুলের ঊর্ধে। আর আল বাতিন মানে হচ্ছে তিনি স্বীয় সৃষ্টিকুলের সকল বিষয়ের পূর্ণ জ্ঞান রাখেন। যেমনটা তিনি বলেছেন- وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ ‘আর তিনি সব বিষয়ে সম্পর্কে সম্যক অবগত’”।

এছাড়াও অন্যান্য আয়াতে এ বিষয়ক প্রমাণাদি বিদ্যমান। 

হাদিস থেকে প্রমাণ: 

১) হাদিসুল জারিয়াহ বা বিখ্যাত দাসীর হাদিস: 

সাহাবী মুওয়াবিয়াহ বিন আল হাকাম [রা.] বলেন, আমার একজন দাসী ছিল, সে উহুদ ও জাওয়্যানিয়্যাহ এলাকায় আমার মেষ চড়াত। একদিন আমি জানতে পারলাম যে বাঘ তার মেষগুলো থেকে একটি বকরিকে তুলে নিয়ে গেছে। আমি তো অন্যান্য আদম সন্তানের মতো একজন মানুষ। (এমন খবর শুনলে) আর সবাই যেমন দুঃখিত ও রাগান্বিত হত আমিও তেমনটাই হলাম। তবে আমি (রাগের চোটে) তাকে প্রচণ্ড এক চড় মারলাম। 

পরে বিষয়টা আমার কাছে অনেক গুরুতর মনে হওয়ায় আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি কি তাকে মুক্ত করে দেব?

তিনি বললেন, তাকে আমার কাছে নিয়ে এসো।। 

আমি তাকে নিয়ে এলাম। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন, أَيْنَ اللَّهُ

“আল্লাহ কোথায়?”

সে উত্তরে বলল, فِي السَّمَاءِ “আসমানে”

এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, مَنْ أَنَا ؟ (বলতো) আমি কে?”

সে উত্তর দিল, أَنْتَ رَسُولُ اللَّهِ, “আপনি আল্লাহর রাসূল”।

তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, أَعْتِقْهَا فَإِنَّهَا مُؤْمِنَةٌ

“তাকে স্বাধীন করে দাও, কেননা সে মু’মিনাহ”।

২) বিদায় হজ্বের দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, 

قَدْ تَرَكْتُ فِيكُمْ مَا لَنْ تَضِلُّوا بَعْدَهُ إِنْ اعْتَصَمْتُمْ بِهِ كِتَابُ اللَّهِ وَأَنْتُمْ تُسْأَلُونَ عَنِّي فَمَا أَنْتُمْ قَائِلُونَ؟ 

“আমি তোমাদের মাঝে এমন এক জিনিস রেখে যাচ্ছি যদি তোমরা তাকে আঁকড়ে ধর, তাহলে এরপর আর কিছুতেই গোমরাহ হবে না। সেটা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব। তোমরা আমার সম্পর্কে (আখিরাতে) জিজ্ঞাসিত হবে। তখন তোমরা কী জবাব দেবে?”

সাহাবীরা [রা.] উত্তরে বললেন, نشْهَدُ أَنَّكَ قَدْ بَلَّغْتَ وَأَدَّيْتَ وَنَصَحْتَ

“আমরা এই সাক্ষ্য দেব যে, আপনি (রিসালাতের দায়িত্ব) সঠিকভাবে পৌঁছে দিয়েছেন, (এই আমানত) সঠিকভাবে আদায় করেছেন, আর (উম্মাহকে) উত্তমভাবে সদুপদেশ দিয়েছেন”।

 বর্ণনাকারী বলেন, فَقَالَ بِإِصْبَعِهِ السَّبَّابَةِ يَرْفَعُهَا إِلَى السَّمَاءِ وَيَنْكُبهَا إِلَى النَّاسِ

“এরপর তিনি শাহাদাৎ আঙুল তুলে আসমানের দিকে ইশারা করার পর সমবেত লোকদের দিকে নামিয়ে আনলেন”

অতঃপর তিনবার বললেন, اللَّهُمَّ اشْهَدْ اللَّهُمَّ اشْهَدْ

“হে আল্লাহ, আপনি সাক্ষী থাকুন; হে আল্লাহ, আপনি সাক্ষী থাকুন”।

আসমানের দিকে আঙুল তোলার ঘটনাগুলোর ব্যাপারে অনেকে বলে থাকেন, আসমান হচ্ছে দুআর কিবলা, এজন্য আসমানের দিকে আঙ্গুল তোলা হয় বা আসমানমুখী করে হাতের তালু রাখা হয়। এই ঘটনার ক্ষেত্রে সেই ব্যাখ্যার সুযোগ নেই। কেননা এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তাআলাকে সাক্ষী হিসেবে গ্রহণ করতে আসমানের দিকে আঙুল তুলে ইশারা করেছেন, যা আল্লাহ তাআলার সুউচ্চ হবার সাক্ষ্য দেয়। 

৩) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, 

الْمَلاَئِكَةُ يَتَعَاقَبُونَ ، مَلاَئِكَةٌ بِاللَّيْلِ وَمَلاَئِكَةٌ بِالنَّهَارِ ، وَيَجْتَمِعُونَ فِى صَلاَةِ الْفَجْرِ وَالْعَصْرِ ، ثُمَّ يَعْرُجُ إِلَيْهِ الَّذِينَ بَاتُوا فِيكُمْ ، فَيَسْأَلُهُمْ وَهْوَ أَعْلَمُ ، فَيَقُولُ كَيْفَ تَرَكْتُمْ عِبَادِى فَيَقُولُونَ تَرَكْنَاهُمْ يُصَلُّونَ ، وَأَتَيْنَاهُمْ يُصَلُّونَ

“(দুনিয়ায়)ফেরেশতারা এক দলের পেছনে আরেক দল (কর্তব্য পালনে) আসতে থাকেন। একদল ফেরেশতা রাতে আসেন, আরেকদল ফেরেশতা দিনে আসেন। ফজর ও আসরের সালাতের সময় তাঁরা একত্রিত হন (অর্থাৎ তাঁদের উভয় দলের মাঝে সাক্ষাৎ হয়)। এরপর যারা (অর্থাৎ যেসকল ফেরেশতা) তোমাদের সাথে রাত্রিযাপন করেছেন (অর্থাৎ রাতের কর্তব্য পালন করেছেন) তাঁরা (আল্লাহর কাছে) ঊর্ধ্বে উঠে যান। 

অতঃপর আল্লাহ তাঁদেরকে জিজ্ঞেস করেন, যদিও তিনি (সব বিষয়ে) সর্বাধিক অবগত। তিনি জিজ্ঞেস করেন, তোমরা আমার বান্দাদেরকে কোন অবস্থায় ছেড়ে এসেছ? 

উত্তরে ফেরেশতারা বলেন, আমরা তাঁদেরকে সালাতরত অবস্থায় ছেড়ে এসেছি। আর আমরা যখন তাঁদের কাছে পৌঁছেছিলাম তখনও তাঁরা সালাতরতই ছিলেন”। 

এই হাদিস থেকে এটা বোঝা যায় যে, আল্লাহ তাআলা বান্দাদের ঊর্ধ্বে রয়েছেন, আরশে সমুন্নত রয়েছেন। এজন্য ফেরেশতারা বান্দাদের কাছে স্বীয় কর্তব্য পালন শেষে আল্লাহর কাছে ঊর্ধ্বে উঠে যান। 

এই বিষয়ে সালাফুস সালিহ ও উম্মার ইমামগণের বক্তব্য ইন শা আল্লাহ এই নিবন্ধের পরবর্তী দুই পর্বে উল্লেখ করা হবে। 

২) আল্লাহ তাআলা স্বীয় আরশে সমুন্নত।

এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন: 

الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى

“দয়াময় আরশে সমুন্নত হয়েছেন”।

তিনি আরো বলেন, ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْش

“অতঃপর তিনি আরশে সমুন্নত হলেন”।

প্রখ্যাত তাবিঈ ও মুফাসসিরদের ইমাম, রইসুল মুফাসসিরিন ইবন আব্বাসের [রা.] ছাত্র,  ইমাম মুজাহিদ রাহ. [মৃত্যু: ১০২ হি:]  বলেন, এই আয়াতে اسْتَوَى ইস্তাওয়া শব্দের মানে হচ্ছে علا على العرش “আরশের ওপর ওঠা”।

ইমাম, হাফিযে হাদিস, ইকরিমা ও শু’বা বিন হাজ্জাজের [রাহ.] ছাত্র, ইমাম ইসহাক বিন রাহওয়াই ও ইমাম যুহলীর [রাহ.] উস্তায ইমাম বিশর বিন উমার আয যাহরানী রাহ. [মৃত্যু: ২০৭ হি:] বলেন, “আমি একাধিক মুফাসসিরকে বলতে শুনেছি যে ‘দয়াময় আরশে ইস্তাওয়া করলেন’-মানে হচ্ছে ارتفع অর্থাৎ তিনি ওপরে উঠলেন/উন্নত হলেন”। 

আরবি ভাষার প্রখ্যাত ভাষাবিদ, ব্যকরণবিদ, ইমাম আবুল আব্বাস সা’লাব রাহ. [মৃত্যু: ২৯১ হি.] বলেন, {استوى على العرش}: علا “আরশে ইস্তাওয়া করা মানে ওপরে ওঠা/ উঁচু হওয়া”।

ইমাম ইবনা জারির আত তাবারী [রাহ.] প্রথমে উল্লেখিত সূরা ত্বা হা-এর আয়াতটির ব্যাখ্যা লিখেছেন, الرحمن على عرشه ارتفع وعلا

“অর্থাৎ দয়াময় স্বীয় আরশে সমুন্নত ও সুউচ্চ হলেন”। 

আর পরের আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন, 

يعني: علا عليه

“অর্থাৎ তার ওপর (আরশের ওপর) সুউচ্চ হলেন”।

৩) আল্লাহ তাআলা স্বীয় আরশে সমুন্নত হয়েছেন, কেননা فَعّـالٌ لِمَا يُرِيد “তিনি যা ইচ্ছে তা করেন”। তিনি কোনো প্রয়োজনের তাগিদে আরশে সমুন্নত হননি; বরং আল্লাহ তো আরশ এবং এছাড়া অন্য সব কিছুরই অমুখাপেক্ষী।

আল্লাহ তাআলা বলেন, إِنَّ اللَّهَ لَغَنِيٌّ عَنِ الْعَالَمِينَ

“আল্লাহ তো সৃষ্টিকুল থেকে অমুখাপেক্ষী”।

هُوَ الْغَنِيُّ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ

“তিনি অমুখাপেক্ষী। আসমানসমূহ ও যমীনে যা রয়েছে তা তাঁরই”।

يَا أَيُّهَا النَّاسُ أَنْتُمُ الْفُقَرَاءُ إِلَى اللَّهِ وَاللَّهُ هُوَ الْغَنِيُّ الْحَمِيدُ

“হে মানুষ, তোমরা আল্লাহর প্রতি মুখাপেক্ষী আর আল্লাহ অমুখাপেক্ষী ও প্রশংসিত”।

ইমাম আবু জা’ফার আত তাহাউই রাহ. [মৃত্যু ৩২১ হি.] তাঁর প্রসিদ্ধ আকিদাহ বিষয়ক পুস্তিকায় লিখেছেন, 

وهو مستغن عن العرش وما دونه. محيط بكل شيء وفوقه

“তিনি আরশ ও আরশ ব্যতীত যা আছে-সব কিছু থেকেই অমুখাপেক্ষী। প্রতিটি বস্তুত তাঁর পরিবেষ্টনে রয়েছে এবং তিনি সবকিছুর উর্ধে”।

৪) আল্লাহ তাআলা স্বীয় সৃষ্টিকুল থেকে পৃথক (بائن) আছেন: 

অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা স্বীয় সৃষ্টিকুল থেকে বিচ্ছিন্ন/পৃথক/আলাদা আছেন। তাঁর সত্ত্বায় মাখলুকের কোনো বৈশিষ্ট্য বা অংশ যেমন নেই ঠিক তেমনি কোনো মাখলুকের মধ্যে তাঁর সুমহান সত্ত্বার কোনো বৈশিষ্ট্য বা অংশ নেই। কোনো সৃষ্টি তাঁকে আয়ত্ত বা পরিবেষ্টন করতে পারে না। 

আল্লাহ তাআলা বলেন: الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى

“দয়াময় আরশে সমুন্নত হয়েছেন”। 

কাজেই সকল সৃষ্টি আরশের নিচে। আর আল্লাহ আরশের ওপর সমুন্নত এবং তিনি সৃষ্টিকুল থেকে পৃথক সত্ত্বা। 

হাদিসের প্রখ্যাত ইমাম ও ফকীহ, ইবনুল মুবারাক রাহ. [ মৃত্যু ১৮১ হি.] কে জিজ্ঞেস করা হল, “আমরা আমাদের রবকে কিভাবে চিনবো?”

উত্তরে তিনি বলেন, بأنه فوق السماء السابعة على العرش، بائن من خلقه

“(আমরা তাঁকে এভাবে চিনবো যে) তিনি স্বীয় সৃষ্টি থেকে পৃথক হয়ে সাত আসমানের ওপারে আরশের ওপর সমুন্নত”। 

ইমাম হারব আল কিরমানী [রাহ.] হাদিস ও ফিকহের প্রসিদ্ধ ইমাম ইসহাক বিন রাহওয়াইহকে রাহ. [মৃত্যু ২৩৮ হি.] জিজ্ঞেস করলেন, 

“আল্লাহ তাআলা যে বলেন, مَا يَكُونُ مِنْ نَجْوَى ثَلَاثَةٍ إِلَّا هُوَ رَابِعُهُمْ ‘তিন ব্যক্তির মধ্যে এমন কোন গোপন পরামর্শ হয় না যাতে চতুর্থ জন হিসেবে তিনি থাকেন না’।– এর ব্যাপারে আপনি কী বলেন?”

ইমাম ইসহাক [রাহ.] উত্তরে বলেন, حيث ما كنت فهو أقرب إليك من حبل الوريد، وهو بائن من خلقه

“তুমি যেখানেই থাকো না কেন, তিনি তোমার গ্রীবাস্থিত ধমনীর চেয়েও বেশি কাছে। তবে তিনি সৃষ্টি থেকে পৃথক আছেন”। 

এরপর তিনি ইবনুল মুবারাক [রাহ.] এর বক্তব্য উল্লেখ করেন যে তিনি বলেছেন, هُوَ على عَرْشه بَائِن من خلقه

“আল্লাহ সৃষ্টিজগৎ থেকে পৃথক হয়ে আরশে সুউচ্চ আছেন”। 

এরপর বললেন, এ বিষয়ে সবচাইতে উচ্চমার্গীয় ও শক্তিশালী প্রমাণ হচ্ছে আল্লাহর বাণী- ‘দয়াময় আরশে সমুন্নত হয়েছেন’”।

ইমাম ইবন বাত্তাহ [রাহ.] অতিরিক্ত বর্ণনা করেছেন, যে ইমাম হারব [রাহ.] ইমাম ইসহাককে [রাহ.] জিজ্ঞেস করেন, الْعَرْشُ بِحَدٍّ؟ 

“তিনি কি সুনির্দিষ্টভাবে আরশে আছেন?”

ইমাম ইসহাক [রাহ.] উত্তরে বলেন, “হ্যাঁ”। 

হাদিসের প্রসিদ্ধ ইমাম, ইমাম আবু সাঈদ আদ দারিমী রাহ. [মৃত্যু ২৮০ হি.] বলেন, 

‌أَنَّ ‌الْأُمَّةَ كُلَّهَا وَالْأُمَمَ السَّالِفَةَ قَبْلَهَا لَمْ يَكُونُوا يَشُكُّونَ فِي مَعْرِفَةِ اللَّهِ تَعَالَى أَنَّهُ فَوْقَ السَّمَاءِ، بَائِنٌ مِنْ خَلْقِهِ

“গোটা উম্মাহ এবং পূর্ববর্তী উম্মতগুলোও আল্লাহ তাআলাকে চেনার ব্যাপারে এই ক্ষেত্রে সন্দিহান ছিল না যে, আল্লাহ তাআলা আসমানের ওপারে সৃষ্টিজগৎ থেকে পৃথক রয়েছেন”। 

৫) আল্লাহ আযযা ওয়া জাল-এর আরশে সমুন্নত হওয়া মাখলুকের ওপরে ওঠার মত কোনো ব্যাপার নয়। আমরা বিশ্বাস করি যে আল্লাহ আরশে স্বীয় মহিমা মোতাবেক সমুন্নত, যা মাখলুকের ওপরে ওঠার মত বা অনুরূপ নয়: 

কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন: لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ

“কোনো কিছুই তাঁর মত নয়, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা”।

তিনি আরও বলেন, وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ

“তাঁর সমকক্ষ/সমতুল্য কেউ নেই”।

সমকক্ষ কেউ নেই মানে তাঁর সদৃশ/অনুরূপ কেউ নেই। 

৬) আল্লাহ আযযা ওয়া জাল-এর আরশে সমুন্নত হবার ধরণ বা স্বরূপ আমাদের জানা নেই। আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে এর বিস্তারিত জ্ঞান শেখান নি। কাজেই আল্লাহ তাআলার সিফাতের স্বরূপ বা ধরণ সম্পর্কে প্রশ্ন করা বিদআত। কেবল আল্লাহ জানেন যে তাঁর আরশে সমুন্নত হবার ধরণ বা স্বরূপ আসলে কেমন। আমাদের জন্য ওয়াজিব হচ্ছে আমরা এর ওপর ঈমান আনব বা বিশ্বাস করব এবং সর্বান্তকরণে তা মেনে নেব। 

ইমাম মালিকের রাহ. [মৃত্যু ১৭৯ হি.] কাছে যখন জিজ্ঞেস করা হল যে, আল্লাহ তাআলা কিভাবে সমুন্নত হলেন? তখন তিনি এর উত্তরে বললেন, الإستواء غير مجهول، والكيف غير معقول، والسؤال عنه بدعة، والإيمان به واجب

“ইস্তিওয়া বা সমুন্নত হওয়া (শব্দ হিসেবে) আমাদের অজ্ঞাত নয় (আমরা এটা জানি)। তবে (আল্লাহর ক্ষেত্রে) এর স্বরূপ বা ধরণ আমাদের বোধের ঊর্ধে। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা বিদআত আর ঈমান রাখা ওয়াজিব”। 

ইমাম ওয়াকী ইবনুল জাররাহ রাহ. [মৃত্যু ১৯৭ হি.] আল্লাহ তাআলার সিফাত বিষয়ক হাদিসসমূহের ব্যাপারে বলেন, 

نُسلِّم هذه الأحاديث كما جاءت ، ولا نقول كيف هذا؟ ولم جاء هذا ؟

“এই হাদিসগুলো যেভাবে এসেছে আমরা ঠিক সেভাবেই মেনে নেই। আমরা এটা বলি না যে এটা কেমন/কিরূপ/কিভাবে। আমরা এটাও বলি না যে এটা (এসব বর্ণনা) কেন এলো”। 

জুরজানের প্রসিদ্ধ শাফিঈ ফকীহ ও মুহাদ্দিস ইমাম আবু বাকর আল ইসমাঈলী রাহ. [মৃত্যু ৩৭১ হি.] বলেন,

وأنه عز وجل استوى على العرش، بلا كيف، فإن الله تعالى انتهى من ذلك إلى أنه استوى على العرش ‌ولم ‌يذكر ‌كيف ‌كان ‌استواؤه

“আল্লাহ আযযা ওয়া জাল আরশে সমুন্নত হয়েছে কোনো স্বরূপ ব্যতীত (তা আমাদের মানতে হবে)। কেননা আল্লাহ তাআলা (আমাদেরকে) এটুকু জানিয়েই ক্ষান্ত হয়েছেন যে তিনি আরশে সমুন্নত হয়েছেন। এরপর (আমাদেরকে) জানাননি যে তিনি কিভাবে সমুন্নত হলেন”।

এই বিষয়ে সালাফুস সালিহীন ও আহলুস সুন্নাতের ইমামগণের বক্তব্য ইন শা আল্লাহ পরবর্তী দুই পর্বে আলোচনা করা হবে। 

References:

1 এই নিবন্ধটি প্রাবন্ধিকা উম্মু আব্দিল্লাহ আল মীসাউইর প্রবন্ধ: عقيدة السلف الصالح

أهل السنة والجماعة

في صفة الاسْتِوَاء وعُلُوِّ الله على خَلْقِه-কে মূল ধরে রচিত।

2  সূরা ত্বা হা: ৫

3  সূরা আন নাহল: ৫০, এটি সিজদার আয়াত।

4  সূরা আল মাআরিজ: ৪

5  ইমাম খালীল বিন আহমাদ (রাহ.), কিতাবুল আঈন: ১/২২৩, وعَرَجَ يعرُجُ عُروجاً أي صَعِد.