ইস্তিগাসা: অর্থ, বিধান এবং শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহহাবের [রাহ.] অবস্থান- একটি পর্যালোচনা 

 بِسْمِ اللَّـهِ الرَّحْمَـٰنِ الرَّحِيمِ

শাইখ ইবন আব্দিল ওয়াহহাব [রাহ.]- এর বিরোধী পক্ষ বলে থাকে যে বেশ কিছু মাসআলায় শাইখ [রাহ.] উম্মাহর মূল মতের বিরোধী অবস্থান নিয়েছেন, এবং বেশ কিছু ক্ষেত্রে নাকি অত্যন্ত বাড়াবাড়ি করেছেন, যা গুলু ফিদ দ্বীন বা দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ির অন্তর্ভুক্ত । এরকম একটা বিষয় হচ্ছে “ইস্তিগাসাহ”- বিষয়ে শাইখের ও তাঁর অনুসারীদের অবস্থান। 

এজন্য এই নিবন্ধে আমরা ইস্তিগাসাহ কী, এর পরিচিতি, বিধান, শাইখের অবস্থান এবং উম্মতের অন্যান্য নির্ভরযোগ্য আলিমদের সাথে তার কোনো মিল আছে নাকি নেই তা নিয়ে ইন শা আল্লাহ আলোচনা করতে যাচ্ছি। 

ইস্তিগাসাহ: আরবি ইস্তিগাসাহ (‌الاستغاثة) শব্দটির আভিধানিক অর্থ হচ্ছে সাহায্য প্রার্থনা, সাহায্যের আবেদন, ফরিয়াদ। এর উৎপত্তি হয়েছে আরবি শব্দ গাওয়াসা (غَوَثَ) থেকে। আরবি ভাষার ইমাম আহমাদ বিন ফারিস [রাহ.] এর অর্থ বলেছেন, “এর মানে হচ্ছে কঠিন পরিস্থিতিতে সাহায্য-সহায়তা ও সমর্থন প্রার্থনা করা”।  শরঈভাবেও শব্দটি এর আভিধানিক অর্থই বহন করে থাকে।

অর্থাৎ ব্যক্তি যখন কোনো মুসিবতে বা কঠিন পরিস্থিতিতে কাউকে ডাকে বা আহ্বান করে তখন এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ইস্তিগাসাহ। 

এর কাছাকাছি আরেকটি শব্দ হচ্ছে ইস্তিআনাহ (الاِسْتِعَانَةُ), এর আভিধানিক অর্থও সাহায্য প্রার্থনা, (act or instance of) seeking help (ب with, from, in)।

আরেকটি শব্দ হচ্ছে ইস্তিআযাহ (الاِسْتِعَاذَةُ), এর আভিধানিক অর্থ আশ্রয় চাওয়া, আশ্রয় লওয়া, আত্মরক্ষা করা। 

এই শব্দ তিনটি প্রায় সমার্থক, এদের মাঝে খুব সামান্য অর্থগত পার্থক্য রয়েছে। যদি অর্থগত পার্থক্য ধরা হয় সেক্ষেত্রে এদেরকে এভাবে পৃথক করা যায়:

ক) ইস্তিআনাহ: ইস্তিআনাহ মানে হচ্ছে দ্বীনি ও দুনিয়াবী বিষয়ে কারও সাহায্য প্রার্থনা করা এবং নিজের অবস্থার পরিবর্তনের জন্য পুরোপুরি তার ওপর নির্ভর করা। আর অবশ্যই এটা আল্লাহর ওপরই করতে হবে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন:

وَٱسۡتَعِینُوا۟ بِٱلصَّبۡرِ وَٱلصَّلَوٰةِۚ

“তোমরা সবর ও সালাতের মাধ্যমে (আল্লাহর কাছেই) সাহায্য চাও”। 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‌وَإِذَا ‌اسْتَعَنْتَ ‌فَاسْتَعِنْ ‌بِاللَّهِ

“যখন তুমি সাহায্য চাইবে তখন আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাইবে”।

খ) ইস্তিগাসাহ: এর মানে হচ্ছে প্রচণ্ড দুঃখ-কষ্ট, মুসিবতে কারও কাছে উদ্ধার পেতে সাহায্য চাওয়া। বদরের যুদ্ধের দিন সাহাবীদের সংখ্যা স্বল্পতা দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই মুসিবত থেকে বিজয় লাভের মাধ্যমে উদ্ধার পেতে আল্লাহ আযযা ওয়া জাল-এর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। এর উল্লেখ করে আল্লাহ তাআলা বলেন: 

إِذْ تَسْتَغِيثُونَ رَبَّكُمْ فَاسْتَجَابَ لَكُمْ

“(স্মরণ করুন) যখন তোমরা তোমাদের রবের কাছে উদ্ধারের জন্য সাহায্য প্রার্থনা করেছিলে, তখন তিনি তোমাদের ফরিয়াদে সাড়া দিয়েছিলেন”।

গ) ইস্তিআযাহ: ইস্তিআযাহ মানে হচ্ছে ক্ষতিকর বিষয় যেন দূরে থাকে বা তা থেকে বেঁচে থাকা যায় সেজন্য কারও কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা। এটাও আল্লাহর কাছেই করণীয়। আল্লাহ তাআলা বলেন:

فَإِذَا قَرَأْتَ الْقُرْآنَ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ

“সুতরাং যখন আপনি কুরআন পাঠ করবেন তখন অভিশপ্ত শয়তান হতে আল্লাহর কছে আশ্রয় প্রার্থনা করুন।”

কখনও কখনও মানুষের কাছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আশ্রয় নিতে হতে পারে, সেটাও হবে আল্লাহর নামে কারও কাছে আশ্রয় প্রার্থনা। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, من استعاذ بالله فأعيذوه

“যে ব্যক্তি আল্লাহর নামে আশ্রয় চায় (নিরাপত্তা চায়) তাকে আশ্রয় দাও”।

আর এই ৩টি শব্দের মূলভাব একই, সেটা হচ্ছে আল্লাহর ওপর নির্ভর করে তাঁকে আঁকড়ে ধরা, তাঁর সাহায্য চাওয়া, তাঁরই আশ্রয় নেয়া। যেহেতু শব্দগুলো সমার্থক ও প্রাসঙ্গিক এজন্য একত্রে আলোচনা করা হল। এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যে সালাফের অনেকেই এই মূল বিষয়টিকে সম্বোধন করতে গিয়ে উপরের ৩ শব্দের যেকোনো একটিকে ব্যবহার করেছেন। যেহেতু এদের মূলভাব ও প্রয়োগ প্রায় একই ক্ষেত্রে হয়ে থাকে, এজন্য এক শব্দের আলোচনা অপর শব্দকে অন্তর্ভুক্ত করবে ইন শা আল্লাহ। 

এবার আমরা সাহায্য প্রার্থনা নিয়ে আলোচনা করতে পারি। সাধারণত আমরা আমাদের জীবনের সকল ক্ষেত্রেই বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সাহায্যের জন্য কাউকে কাউকে আহ্বান করে থাকি, কারও না কারও সাহায্য নিয়ে থাকি। যে কোনো বিপদে মু’মিন প্রথমত আল্লাহ তাআলার কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করে, এরপর ইসলাম সমর্থিত পন্থায় দুনিয়াবী বিভিন্ন মাধ্যম গ্রহণ করার মাধ্যমে বিপদ থেকে মুক্ত হতে চেষ্টা করে। এছাড়া কিছু বিষয় এমন থাকে যেগুলোতে দুআ ব্যতীত অপর কোনো উপায়ই বান্দার হাতে থাকে না, যেমন মুমূর্ষ ব্যক্তির জীবনরক্ষা করা। 

এসব বিষয়কে সামনে রেখে ইস্তিগাসাকেও দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা: 

১) এমন বিষয়ে উপস্থিত জীবিত মাখলুকের সাহায্য প্রার্থনা করা, যে বিষয়ে সে সাহায্য করতে সক্ষম। এখানে খেয়াল রাখা জরুরি যে, মাখলুকের উপস্থিত থাকা মানে সামনাসামনি উপস্থিত থাকা হতে পারে, কিন্তু হয়তো অন্য দেশে রয়েছে, তাকে ফোন করে বা ই-মেইল পাঠিয়ে বা এসব মাধ্যম ব্যবহার করে সহায়তা চাওয়ার ব্যাপারে জানানো। 

আর সক্ষমতার মানে হচ্ছে, একজন মানুষের পক্ষে এমন কাজে সাহায্য করা সম্ভবপর হওয়া। যেমন একজন বিপদে পড়ে অপর কাউকে ফোন দিয়ে বলল আমাকে এক লাখ টাকা পাঠান। ঐ ব্যক্তির কাছে তখন ঐ পরিমাণ অর্থ না থাকলেও মানবীয়ভাবে এটা সম্ভব। কাজেই তার কাছে চাওয়াটা এই প্রকরণের অন্তর্ভুক্ত। 

এরকম সহায়তা চাওয়া উম্মতের সকলের মতেই জায়েয। আল্লাহ তাআলা মূসা [আ.] এর ঘটনা বর্ণনা করেছেন:  

فَاسْتَغَاثَهُ الَّذِي مِنْ شِيعَتِهِ عَلَى الَّذِي مِنْ عَدُوِّهِ

“তখন তাঁর নিজের দলের লোকটি তার শত্রুদলের লোকটির বিরুদ্ধে তার কাছে সাহায্য চাইল।”

উপমহাদেশের উলামা এই ধরণের সাহায্য প্রার্থনাকে বলে থাকেন, ما تحت الاسباب, আসবাবের অধীন সাহায্য চাওয়া। 

২) এমন বিষয়ে, এমন ভাবে এবং এমন অবস্থায় মাখলুকের কাছে সাহায্য চাওয়া যে বিষয়ে, যে ভাবে, যে অবস্থায় কেবল আল্লাহ আযযা ওয়া জাল সাহায্য করতে সক্ষম। এটা হতে পারে জীবিত কোনো ব্যক্তিকে দূর থেকে কোনো মাধ্যম ব্যতীত ডাকা, অথচ এভাবে ডাকলে কেবল আল্লাহ তাআলাই শোনেন। এটা হতে পারে কোনো মৃত ব্যক্তিকে ডাকা, অথচ তারা মৃত। আল্লাহ তাআলা না চাইলে তাদের পক্ষে কখনোই শোনা সম্ভব হবে না। এরকম ব্যক্তি নেককার হতে পারে, বদকারও হতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন ক্ষমতা পাবার জন্য জ্বীন শয়তানের কাছে সাহায্য চাওয়া। আরও আছে সন্তান চাওয়া, রিযক চাওয়া, সুস্থতা চাওয়া ইত্যাদি। 

এটা এভাবে চাওয়া হতে পারে, যেমন কেউ বিপদে পড়ে বলল, হে অমুক (কোনো মৃত নেককার ব্যক্তি), আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করুন, সাহায্য করুন। কিংবা শুধু হে অমুক। যেমন শীআরা বলে থাকে, ইয়া হুসাইন। 

উপমহাদেশের আলিমগণ এই প্রকার সাহায্য চাওয়াকে বলেন ما فوق الاسباب বা আসবাবের ঊর্ধে সাহায্য চাওয়া। 

এই প্রকারের ইস্তিগাসা হচ্ছে আমাদের মূল আলোচ্য। অর্থাৎ এই ধরণের ইস্তিগাসা সম্পর্কে শাইখ ইবন আব্দিল ওয়াহহাব [রাহ.] নিজে কী বলেছেন আর উনার দেয়া মতের অনুরূপ মতামত অন্যান্য আলিমগণের মাঝে কে কে দিয়েছেন, নাকি এই বিষয়ে তিনি একদমই স্বতন্ত্র ছিলেন?

শাইখের অবস্থান: 

শাইখ তাঁর প্রসিদ্ধ রিসালাহ “সালাসাতুল উসুলে” ইবাদাতের প্রকার সম্পর্কে বলতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন, والاستعانة، والاستعاذة، والاستغاثة “ইস্তিআনাহ, ইস্তিআযাহ ও ইস্তিগাসাহ”। অর্থাৎ তাঁর মতে এগুলো অবশ্যই ইবাদাতের অন্তর্ভুক্ত। আর ইবাদাত কেবল আল্লাহর প্রাপ্য। আল্লাহর প্রাপ্য ইবাদাত অন্য কারও উদ্দেশ্যে করাই শির্ক। কাজেই এরপর তিনি বলছেন-

فمن صرف منها شيئا لغير الله فهو مشرك كافر

“কাজেই যে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও জন্য এই ইবাদাতগুলোর কোনোটা করলো সে মুশরিক কাফির”।

অর্থাৎ এই ধরণের আমলের ফলে ব্যক্তি এমন শির্কে লিপ্ত হচ্ছে যা তাকে ইসলাম থেকে বের করে মুশরিক ও কাফির বানিয়ে দেয়।

তাঁর প্রসিদ্ধ কিতাব “কিতাবুত তাওহিদে” তিনি একটি অধ্যায়ের নামকরণ করেছেন: ‌‌باب من الشرك الاستعاذة بغير الله

“আল্লাহ ব্যতীত অপর কারও আশ্রয় প্রার্থনা বিষয়ক শির্ক শীর্ষক অধ্যায়”।

এই অধ্যায়ে তিনি দলিল হিসেবে উল্লেখ করেছেন আল্লাহ তাআলার বাণী:

وَأَنَّهُ كَانَ رِجَالٌ مِنَ الأِنْسِ يَعُوذُونَ بِرِجَالٍ مِنَ الْجِنِّ فَزَادُوهُمْ رَهَقاً

“আর নিশ্চয় কতিপয় মানুষ কতিপয় জিনের আশ্রয় নিত, ফলে তারা তাদের অহংকার বাড়িয়ে দিয়েছিল”।

আর রাসূলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিস: তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন-

তোমাদের কেউ যদি কোনো স্থানে অবতরণ করে সে যেন বলে-

أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ

“আমি আল্লাহর পরিপূর্ণ কালিমাসমূহের মাধ্যমে তিনি যা সৃষ্টি করেছেন সেসকল সৃষ্টির অনিষ্ট থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি”

(এরপর) যতক্ষণ সে অন্য কোথাও চলে না যাচ্ছে ততক্ষণ কোনো কিছু তার ক্ষতি করতে পারবে না।

জাহিলি যুগে মানুষ যখন কোনো উপত্যকায় বা বিরান এলাকায় যেত, তারা সেখানকার দুষ্টু জ্বীনের অনিষ্ট থেকে বড় বড় সর্দার জ্বীনের আশ্রয় প্রার্থনা করতো। আল্লাহ তাআলা সূরা জ্বীনের উল্লেখিত আয়াতে এর নিন্দা করেছেন, আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই হাদিসে এর বিকল্প জানিয়ে দিয়েছেন। 

এ থেকে বোঝা গেল আশ্রয় কেবল আল্লাহর কাছেই চাইতে হবে। যদিও এসব উপত্যকায় জ্বীনদের অস্তিত্ব থাকা সম্ভব। তবুও তাদের আশ্রয় না নিয়ে কেবল আল্লাহর আশ্রয়ই নিতে হবে। এর বিপরীত কর্ম মানুষকে শির্কের দিতে ধাবিত করে। 

এরপরের অধ্যায়টি হচ্ছে باب من الشرك أن يستغيث بغير الله أو يدعو غيره “আল্লাহ ব্যতীত অপর কারও কাছে সাহায্য প্রার্থনা কিংবা আল্লাহ ব্যতীত অপর কাউকে আহ্বান করা (অপরের কাছে দুআ করা) বিষয় শির্ক শীর্ষক অধ্যায়”। 

এই অধ্যায়ে তিনি দলিল হিসেবে উল্লেখ করেছেন আল্লাহ তাআলার বাণী-

وَلا تَدْعُ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لا يَنْفَعُكَ وَلا يَضُرُّكَ فَإِنْ فَعَلْتَ فَإِنَّكَ إِذاً مِنَ الظَّالِمِينَ وَإِنْ يَمْسَسْكَ اللَّهُ بِضُرٍّ فَلا كَاشِفَ لَهُ إِلَاّ هُوَ

“আর আপনি আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ডাকবেন না, যা আপনার উপকারও করে না, অপকারও করে না, কারণ এটা করলে তখন আপনি অবশ্যই যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবেন। আর যদি আল্লাহ আপনাকে কোন ক্ষতির স্পর্শ করান, তবে তনি ছাড়া তা মোচনকারী আর কেউ নেই” 

আল্লাহ তাআলা আরও বলেন:  فَابۡتَغُوۡا عِنۡدَ اللّٰهِ الرِّزۡقَ وَ اعۡبُدُوۡهُ

“কাজেই তোমরা আল্লাহর কাছেই রিযিক চাও এবং তারই ইবাদাত কর”

তিনি আরও বলেন: وَمَنۡ أَضَلُّ مِمَّن یَدۡعُوا۟ مِن دُونِ ٱللَّهِ مَن لَّا یَسۡتَجِیبُ لَهُۥۤ إِلَىٰ یَوۡمِ ٱلۡقِیَـٰمَةِ وَهُمۡ عَن دُعَاۤىِٕهِمۡ غَـٰفِلُونَ

“তার চেয়ে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে, যে আল্লাহর পরিবর্তে এমন কাউকে ডাকে, যে কিয়ামত দিবস পর্যন্তও তার ডাকে সাড়া দেবে না? আর তারা তাদের আহবান সম্পর্কে উদাসীন”।

أَمَّنْ يُجِيبُ الْمُضْطَرَّ إِذَا دَعَاهُ وَيَكْشِفُ السُّوءَ

“বরং তিনি, যিনি নিরুপায়ের আহবানে সাড়া দেন এবং বিপদ দূরীভূত করেন” 

এই আয়াতসমূহ এ বিষয়ে উজ্জ্বল সাক্ষী যে আল্লাহ ব্যতীত কেউই দুঃখ-দুর্দশা দূর করতে পারেনা, রিযক দিতে পারেনা, সুস্থতা দিতে পারেনা, কাজেই আল্লাহকে বাদ দিয়ে বান্দা অন্য কাউকে কেনই বা ডাকবে। অথবা সে কেন ভাববে অমুককে ডাকি তিনি আল্লাহকে ডাকবেন। আল্লাহ তো সব শোনেন। বরং অমুকের মাধ্যমে আল্লাহকে ডাকার চিন্তার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর শানের খেলাফ চিন্তা করে ফেলে। আল্লাহ তো নিজেই বলেছেন  ٱدۡعُونِیۤ أَسۡتَجِبۡ لَكُمۡۚ “তোমরা আমাকে (সরাসরি) ডাক, আমি তোমাদের আহবানে/দুআয় সাড়া দেব”।

কাজেই এই বিষয়গুলোয় আল্লাহর সাহায্য চাইতে হবে, তাঁর কাছেই আশ্রয় নিতে হবে; অপরের কাছে সাহায্য চাইলে, অপরের আশ্রয় নিলে তা শির্ক হবে। 

এর পাশাপাশি তিনি একটি হাদিস উল্লেখ করেছেন। একবার একজন মুনাফিক সাহাবীদের কষ্ট দিচ্ছিল। তখন উবাদাহ বিন সামিত [রা.] আবু বাকর [রা.] কে বললেন, আপনারা উঠুন, আমরা এই মুনাফিকের বিরুদ্ধে রাসূলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে/মাধ্যমে সাহায্য চাইবো। 

সব শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‌إِنَّهُ ‌لَا ‌يُسْتَغَاثُ ‌بِي، إِنَّمَا يُسْتَغَاثُ بِاللَّهِ عز وجل

“আমার মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করা যাবেনা ; বরং আল্লাহ আযযা ওয়া জাল-এর কাছে সাহায্য চাইতে হবে”।

সুতরাং এসকল দলিলের মাধ্যমে বোঝা গেল যে ইস্তিগাসাহ কেবল আল্লাহর কাছেই করতে হবে। 

অপর এক স্থানে তিনি লিখেছেন, 

فمن أشرك مخلوقاً فيها من ملك مقرب، أو نبي مرسل، أو وليّ، أو صحابي وغيره، أو صاحب قبر أو جني، أو غيره، أو استغاث به، أو استعان به فيما لا يُطلب إلا من الله، أو نذر له أو ذبح له، أو توكل عليه أو رجاه، أو دعاه دعاء استغاثة أو استعانة، أو جعله واسطة بينه وبين الله لقضاء حاجته، أو لجلب نفع أو كشف ضر، فقد كَفَرَ كُفْر عبّاد الأصنام

“যে আল্লাহর তাওহিদে কোনো মাখলুককে শরিক করলো, তা সে মাখলুক হতে পারে কোনো নৈকট্যধন্য ফেরেশতা,বা কোনো প্রেরিত নবী, বা আল্লাহর কোনো ওলী, বা কোনো সাহাবী বা অন্য কেউ, কিংবা কোনো কবরওয়ালা, বা কোনো জ্বীন, বা অন্য কিছু; তার মাধ্যমে ইস্তিগাসাহ করলো, বা ইস্তিআনাহ করলো এমন বিষয়ে, যা আল্লাহ ব্যতীত অপর কারও কাছে চাওয়া যায় না; কিংবা তার উদ্দেশ্যে মানত করলো, বা কোনো প্রাণী জবাই করলো, কিংবা তার ওপর তাওয়াক্কুল করলো, তার আকাঙ্ক্ষা করলো, কিংবা ইস্তিগাসাহ বা ইস্তিআনাহ হিসেবে তার কাছে দুআ করলো (আহ্বান জানালো); কিংবা হাজত বা প্রয়োজন পূরণের জন্য বা কোনো উপকার পেতে বা ক্ষতি থেকে বাঁচতে তাকে আল্লাহ ও নিজের মাঝে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করলো- সে অবশ্যই মূর্তিপূজারীদের কুফরের মত কুফর করলো”।

শাইখের বক্তব্য থেকে স্পষ্টভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে, 

১) তিনি গাইরুল্লাহর কাছে ইস্তিগাসাহ ও ইস্তিআনাকে মূর্তিপূজারীদের কুফরের মত কুফর মনে করেন, 

২) এক্ষেত্রে কারও মাকসূদ বা উদ্দেশ্য যার কাছে ইস্তিগাসা করা হচ্ছে যেমন ধরুন হুসাইন [রা.] বা আব্দুল কাদির জিলানী [রাহ.] তিনি নিজেই; নাকি মূল মাকসূদ আল্লাহ তাআলা, কিন্তু ডাকা হচ্ছে এসব ব্যক্তিকে যেন তাঁরা মাধ্যম হিসেবে কাজ করেন, উভয় ক্ষেত্রে বিধানগত পার্থক্য তিনি গ্রহণ করেন না; বরং তাঁর মতে উভয়টাই মূর্তিপূজারীদের মত কুফর বা শির্ক। 

কেননা মূর্তিপূজারীরাও একই রকম যুক্তি দিত এবং এখনও দেয় যে, আমরা তো আসলে মূল মূর্তিদের পূজা করি না, তাঁদের মধ্যস্থতায় ঈশ্বর, স্রষ্টা, ভগবান বা বুদ্ধকে ডেকে থাকি। আল্লাহ তাআলা তাদের বক্তব্য উল্লেখ করে বলেন:

مَا نَعۡبُدُهُمۡ إِلَّا لِیُقَرِّبُونَاۤ إِلَى ٱللَّهِ زُلۡفَىٰۤ

“আমরা কেবল এজন্যই তাদের ‘ইবাদাত করি যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেবে”।

এই আয়াত পড়ে কারও মনে হতে পারে যে, এখানে ইবাদাতের কথা বলা হয়েছে, দুআ বা আহ্বানের কথা তো নেই। ইস্তিগাসাহ, ইস্তিআনাহ ও ইস্তিআযাহ তো মূলত দুআই। 

এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে ইসলামী শরীআতে দুআ নিজেই এক ধরণের ইবাদাত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই এই ব্যাখ্যা দিয়ে গিয়েছেন। তিনি বলেছেন, 

«‌الدُّعَاءُ ‌هُوَ ‌العِبَادَةُ»

“দুআই হচ্ছে ইবাদাত”। 

এরপর তিনি এর স্বপক্ষে তিলাওয়াত করলেন এই আয়াত:

 وَقَالَ رَبُّكُمُ ٱدۡعُونِیۤ أَسۡتَجِبۡ لَكُمۡۚ إِنَّ ٱلَّذِینَ یَسۡتَكۡبِرُونَ عَنۡ عِبَادَتِی سَیَدۡخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِینَ

“আর তোমাদের রব বলেছেন, তোমরা আমাকে ডাক (আহ্বান করও, দুআ করও), আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব। নিশ্চয় যারা অহংকারবশে আমার ইবাদাত থেকে বিমুখ থাকে, তারা অচিরেই জাহান্নামে প্রবেশ করবে লাঞ্ছিত হয়ে”।

কাজেই বিপদে পড়ে কাউকে যদি ডাকতে হয় তো আল্লাহকেই ডাকতে হবে, কোনো অনুপস্থিত কিংবা মৃত নেককার ব্যক্তিকে ডাকলে চলবে না। এই ইবাদাত আল্লাহ তাআলার প্রাপ্য, তাঁর জায়গায় অন্য কাউকে দেয়া হলে তা নিঃসন্দেহে শির্ক হবে। 

স্বাভাবিক বিশুদ্ধ মানবীয় ফিতরাও এই ধরণে আমলকে বিশুদ্ধ বলতে পারেনা। যদি এমন বলা হয় যে শাইখ [রাহ.] পৃথিবীর প্রথম ব্যক্তি যিনি ইস্তিগাসাকে শির্ক বলেছেন , তাহলে অবাক হয়ে ভাবতে হবে যে, যেই ইসলাম শির্ক-কুফর থেকে মুক্ত করে মানব জাতিকে তাওহিদের ছায়ায় আশ্রয় দিতে এসেছিল, তার অনুসারী এত এত মহান আলিমদের কেউ-ই কি একে শির্ক বলেন নি? সেক্ষেত্রে ইসলাম ও অন্যান্য আরও কিছু ধর্মের মাঝে তাওহিদের বোধে পার্থক্য রইলো কোথায়?

আসলে অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে বিপুল পরিমাণ মহান ইমাম ও আলিম এ বিষয়ে আগেও কথা বলেছেন, পরেও কথা বলেছেন। ইন শা আল্লাহ শীঘ্রই এ বিষয়ে তাঁদের অবস্থান আমরা তুলে ধরবো। মনে রাখতে হবে যে, সমাজে আলিম উপাধিধারী ব্যক্তি হাজারো হতে পারে, কিন্তু অনুসরণীয় ও বরণীয় আলিম কমই হয়ে থাকেন। এজন্য আমরা যখন যে কোনো ইসলামী সাইন্সের গ্রন্থ পাঠ করি, আমরা গুটিকয়েক ব্যক্তির নামই সেখানে আবর্তিত হতে দেখি। মূলত উনারাই সেসব অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। ফলে এরকম একজন ব্যক্তির মতামত মানে আসলে একজন ব্যক্তির মতামত নয়; বরং অনুসরণকারী হাজারও আলিমের মতামতও বৈকি। এছাড়া এসব মত একটা যুগ, দেশ ও কালের মতামতেরও প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। এজন্য আমরা এমন কতিপয় আলিমের মতামত তুলে ধরবো ইন শা আল্লাহ। 

এক্ষেত্রে পাঠককে এটাও মনে করিয়ে দিচ্ছি যে, ইস্তিআযাহ, ইস্তিআনাহ ও ইস্তিগাসাহ- এই সব প্রকারের আলোচনাই আমরা একত্রে উল্লেখ করব, কেননা এক্ষেত্রে মূল ভাব ও আলোচ্য একই। এটাও মনে রাখতে হবে যে একদম সালাফদের যুগে এক সংক্রান্ত আলোচনা পাওয়াটা বিরল, কেননা তখনও মুসলিমদের মাঝে এ ধরণের গোমরাহীর প্রচার হয়নি। 

বিভিন্ন আলিমদের মতামত: 

১) ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল [রাহ.]: ইমামু আহলিস সুন্নাহ ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল [রাহ.] ছিলেন ইসলামের সকল শাস্ত্রের ইমাম। প্রসিদ্ধ ৪ মাযহাবের একটি, হাম্বলী মাযহাব, তাঁর ইলমের ওপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত। 

তিনি বলেছেন, “এটা জায়েয নেই যে কেউ বলবে, আমি নবীর (সা.) বা পাহাড়ের, বা নবীদের [আ.], বা ফেরেশতাদের, বা আরশের, বা জমিনের  বা আল্লাহর অন্য কোনো মাখলুকের মাধ্যমে তোমার থেকে আশ্রয় প্রার্থনা (ইস্তিআযাহ) করছি। আল্লাহ তাআলা এবং তাঁর কালিমাসমূহ ব্যতীত অন্য কোনো কিছুর মাধ্যমে আশ্রয় প্রার্থনা করবে না”। 

ইমাম সাহেবের কথা থেকে এটা পরিষ্কার যে আশ্রয় কেবল আল্লাহ কাছেই চাইতে হবে, তাঁর কালিমাসমূহের মাধ্যমে চাইতে হবে। 

২) ইমাম ইবন খুযাইমাহ [রাহ.]: ইমাম আবু বাকর ইবন খুযাইমাহ [রাহ.] ছিলেন হাদিসের ইমাম, ফকীহ, শাইখুল ইসলাম ও ইমামুল আইম্মাহ তথা ইমামদের ইমাম। তিনি স্বীয় প্রসিদ্ধ কিতাব “আত তাওহিদে” এক প্রসঙ্গে লিখেছেন, 

هل سمعتم عالما يجيز، أن يقول الداعي: أعوذ بالكعبة من شر خلق الله

“আপনি কখনো শুনেছেন যে কোনো আলিম এটা জায়েয বলবে, যে কেউ বলুক, আমি কাবার মাধ্যমে আল্লাহর সৃষ্টির অনিষ্ট থেকে আশ্রয় চাইছি?” 

এরপর তিনি আরও কিছু উদাহরণ উল্লেখ করে বলেন, هذا لا يقوله ولا يجيز القول به مسلم يعرف دين الله، محال أن يستعيذ مسلم بخلق الله من شر خلقه

“এটা কোনো আলিম বলবেও না, আর এটা আল্লাহর দ্বীন সম্পর্কে জানে এমন কোনো মুসলিম এ ধরণের কথাকে জায়েযও বলবে না। এটা অসম্ভব যে কোনো মুসলিম সৃষ্টির অনিষ্ট থেকে আল্লাহর অপর কোনো সৃষ্টির কাছে আশ্রয় চাইবে”।

অর্থাৎ কেউ এমন করতে পারে এটাকেও ইমাম ইবন খুযাইমাহ [রাহ.] অসম্ভব মনে করছেন, তাঁর মৃত্যু হয়েছিল ৩১১ হিজরিতে। অর্থাৎ তখন পর্যন্ত এটা অসম্ভব ছিল বটে, কিন্তুর দুঃখের বিষয় যে এখন আমাদেরকে এরকম একটা বিষয় নিয়েই আলোচনা করতে হচ্ছে। 

খেয়াল রাখতে হবে যে, ইস্তিআযার এই প্রকারটা হচ্ছে আমাদের পেছনে আলোচিত ঐ নিষিদ্ধ প্রকরণ।

৩) ইমাম কুরতুবী [রাহ.]: ইমাম শামসুদ্দীন আবু আব্দিল্লাহ আল কুরতুবী [রাহ.] ছিলেন প্রখ্যাত মালিকী ফকীহ, মুফাসসির ও আরবি বালাগাতের ইমাম। তাঁর মৃত্যু ৬৭১ হিজরিতে। তিনি স্বীয় প্রসিদ্ধ তাফসিরে লিখেছেন, 

ولا خفاء ‌أن ‌الاستعاذة بالجن دون الاستعاذة بالله كفر وشرك

“এটা কোনো গোপন বিষয় নয় যে, আল্লাহ ব্যতীত জ্বীনের মাধ্যমে (বা কাছে) আশ্রয় প্রার্থনা করা কুফর ও শির্ক”।

এখানে মূল বিষয়টি হচ্ছে আল্লাহ ব্যতীত গাইবে থাকা সত্ত্বার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা। একইভাবে কেউ যদি বিপদে পড়ে বলে, হে আব্দুল কাদির জিলানী, বা হে বাবা ভাণ্ডারী, হে হুসাইন আমি এই সমস্যা থেকে আপনার আশ্রয় চাই- তাহলে সেটাও শির্ক ও কুফর হবে।

৪) ইমাম আবুল ওয়াফা ইবনু আক্বীল [রাহ.]: ইমাম আবুল ওয়াফা আলী ইবনু আক্বীল [রাহ.] ছিলেন আল্লামা, ইমাম, জ্ঞানসাগর ও হাম্বলীদের শাইখ, মৃত্যু ৫১৩ হিজরিতে। হাম্বলীদের মূলধারার আকিদাগত অবস্থান তথা আসারিয়াতের বিপরীতে তিনি মুতাকাল্লিম বা আহলে কালাম ছিলেন। কিন্তু এরপরও তিনি এই ধরণের শির্ক-কুফরের বিরুদ্ধে শক্ত বক্তব্য প্রদান করেছেন। তাঁর নিজ ধারার অর্থাৎ হাম্বলী মুতাকাল্লিম ধারার ইমাম ইবনুল জাওযী [রাহ.] তাঁর বক্তব্য উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, 

وهم كفار عندي بهذه الأوضاع مثل تعظيم القبور وإكرامها بما نهى الشرع عنه من إيقاد النيران وتقبيلها وتخليفها وخطاب الموتى بالألواح وكتب الرقاع فيها يا مولاي أفعل بي كذا وكذا وأخذ التراب تبركا وإفاضة الطيب على القبور وشد الرحال اليها وإلقاء الخرق على الشجر أقتداء بمن عبد اللات والعزى

“তারা যে অবস্থা গ্রহণ করেছে সে মোতাবেক আমার কাছে এরা সব কাফির। উদাহরণস্বরূপ, এই যে কবরকে সম্মান করা, শরীআত নিষিদ্ধ পন্থায় তাকে সম্মান দেখানো যেমন কবরে আলো জ্বালানো, একে চুমু দেয়া, কবর থেকে পিছিয়ে প্রস্থান করা, ফলক বা পাতে মৃতকে সম্বোধন করে চিরকুট লেখা, তাতে এরকম লেখা যে, হে আমার মাওলা, আমার এটা এটা করে দেন। কবরের মাটিকে বরকত হিসেবে গ্রহণ করা, কবরের ওপর সুগন্ধি লাগানো, কবরের উদ্দেশ্যে সফর করা, (কবরের এলাকার) গাছে কাপড়ের টুকরা লাগানো। যারা লাত ও উযযার ইবাদাত করতো, তাদেরকে অনুসরণ করে এসব কাজ করা হয়” 

৫) ইমাম ফখরুদ্দীন আর রাযী [রাহ.]: ইমাম ফখরুদ্দীন আর রাযী [রাহ.] ছিলেন প্রসিদ্ধ মুফাসসির, কালাম শাস্ত্রবিদ ও শাফিঈ ফকীহ। তিনি স্বীয় প্রসিদ্ধ তাফসিরে সূরা ইউনুসের ১৮ নং আয়াতের তাফসির করতে গিয়ে মুশরিকরা যেসব মূর্তি ইবাদাত করতো এবং যাদেরকে আল্লাহর কাছে শাফাআতকারী মনে করতো, যেগুলো আসলে কী ছিল তার ব্যাখ্যায় বেশ কিছু মত উল্লেখ করেছেন, এর মধ্যে একটি হচ্ছে:

أنهم وضعوا هذه الأصنام والأوثان على صور أنبيائهم وأكابرهم، وزعموا أنهم متى اشتغلوا بعبادة هذه التماثيل، فإن أولئك الأكابر تكون شفعاء لهم عند الله تعالى، ونظيره في هذا الزمان اشتغال كثير من الخلق بتعظيم ‌قبور ‌الأكابر، على اعتقاد أنهم إذا عظموا قبورهم فإنهم يكونون شفعاء لهم عند الله

“তারা এসব মূর্তি ও প্রতিমাগুলোকে মূলত তাদের নবীগণ ও আকাবিরদের চেহারা অনুযায়ী বানিয়েছে। তারা এই দাবি করে যে, তারা যদি এসব মূর্তির ইবাদাতে মশগুল হয় তাহলে এসকল আকাবির (বড় ব্যক্তিত্বরা) তাদের জন্য আল্লাহ তাআলার কাছে সুপারিশকারী হবে। 

(তাদের এই কার্যক্রমের) উদাহরণ বর্তমান যুগেও (আছে), (সেটা হচ্ছে) ঐসব লোক যারা আকাবিরদের কবরকে প্রচুর সম্মান করে। তারা এটা বিশ্বাস করে যে তারা যদি আকাবিরদের কবরকে সম্মান করে তাহলে আকাবিররা এসব লোকের জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশকারী হবে”।

আমরা দেখতে পাই যাই এসব বিশ্বাস বর্তমান যুগেও রয়েছে। ইস্তিগাসাহ, ইস্তিআযাহ, ইস্তিআনাহ ও কবরের তাযিম আসলে একই সূত্রে গাঁথা। কবরওয়ালাকে শক্তিশালী ও আল্লাহর কাছে মর্যাদাবান ভেবে প্রথমে কবর সংরক্ষণ করা হয়, এরপর তার তাযিম করা হয়, এরপর কবরওয়ালার কাছে ইস্তিগাসাহ, ইস্তিআনাহ ও ইস্তিআযাহ করা হয়। 

৬) শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবন তাইমিয়াহ [রাহ.]: শাইখুল ইসলাম ইমাম আহমাদ বিন আব্দিল হালীম তাকিউদ্দীন ইবন তাইমিয়াহ [রাহ.] ছিলেন ইমাম, আল্লামা, জ্ঞান সাগর, আকিদাহ, তাফসির, হাদিস, ফিকহ, উসুল, আরবি ভাষা, জারহ ওয়াত তা’দিলের ইমাম, ছিলেন ইমামুল আইম্মাহ। তাঁর মৃত্যু ৭২৮ হিজরিতে। হাম্বলী ফিকহের এই প্রসিদ্ধ আলিম ছিলেন মুজতাহিদ ফিল মাযহাব, অনেক গবেষকের মতে তাঁর মাঝে মুজতাহিদে মুতলাক হবার যোগ্যতা ছিল। 

শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহহাব [রাহ.] শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়াহ [রাহ.] ও তস্য ছাত্র ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম, ইবন রাজাব, ইবন কাসির, যাহাবী [রাহ.] প্রমুখের ইলম দ্বারা অত্যন্ত প্রভাবিত ছিলেন। এছাড়া হাম্বলী ফিকহের যে ধারা তিনি অনুসরণ করতেন, অর্থাৎ ইমাম মুসা আল হাজ্জাউইর [রাহ.] ধারা, তাও শাইখুল ইসলামের [রাহ.] মাধ্যমে অত্যন্ত প্রভাবিত ছিল, যার উদাহরণ ইমাম হাজ্জাউইর কিতাব “আল ইক্বনা”-এর পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে। 

শাইখুল ইসলাম [রাহ.] ইস্তিগাসাহ বিষয়ক শির্ক ও ভুল ধারণা অপনোদন করতে একটি কিতাবই লিখেছেন, নাম “আল ইস্তিগাসাহ ফির রাদ্দি আলাল বাকরী”, ৪৯৫ পৃষ্ঠার গ্রন্থটি এ বিষয়ে একটি চমৎকার লেখনী। এ বিষয়ে তাঁর বিপুল লেখনী থেকে একটি উদ্ধৃতি আমরা যোগ করছি:

وَمِنْ الشِّرْكِ أَنْ يَدْعُوَ الْعَبْدُ غَيْرَ اللَّهِ كَمَنْ يَسْتَغِيثُ فِي الْمَخَاوِفِ

وَالْأَمْرَاضِ والفاقات بِالْأَمْوَاتِ وَالْغَائِبِينَ. فَيَقُولُ: يَا سَيِّدِي الشَّيْخُ فُلَانٌ لِشَيْخِ مَيِّتٍ أَوْ غَائِبٍ فَيَسْتَغِيثُ بِهِ وَيَسْتَوْصِيه وَيَطْلُبُ مِنْهُ مَا يَطْلُبُ مِنْ اللَّهِ مِنْ النَّصْرِ وَالْعَافِيَةِ؛ فَإِنَّ هَذَا مِنْ الشِّرْكِ الَّذِي حَرَّمَهُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ بِاتِّفَاقِ الْمُسْلِمِينَ

“এটা শির্কের অন্তর্ভুক্ত যে বান্দা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে সেভাবে আহ্বান করবে যেভাবে ভীতিকর অবস্থা, অসুস্থতা ও দারিদ্র্যে মানুষ মৃতদের ও গাইব তথা অনুপস্থিত সত্ত্বার মাধ্যমে ইস্তিগাসাহ করে থাকে। সে মৃত বা গাইব তথা অনুপস্থিত শাইখকে বা পীরকে এভাবে সম্বোধন করে, ইয়া সায়্যিদী (হে আমার সর্দার), আশ শাইখ অমুক, অতঃপর সেই শাইখের কাছে ইস্তিগাসাহ তথা সাহায্য প্রার্থনা করে, তার কাছে মঙ্গল কামনা করে, আর তার কাছে সেই সাহায্য ও নিরাপত্তা-সুস্থতা কামনা করে যা কি না আল্লাহর কাছে কামনা করার কথা। 

এটা ঐ শির্ক, যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হারাম করেছে, এ বিষয়ে সকল মুসলিমই একমত”।

৭) ইমাম ইবন আব্দিল হাদী [রাহ.]: ইমাম শামসুদ্দীন আবু আব্দিল্লাহ মুহাম্মাদ বিন আহমাদ বিন আব্দিল হাদী আল হাম্বলী [রাহ.] ছিলেন শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়াহ ও ইমাম যাহাবীর [রাহ.] ছাত্র, প্রসিদ্ধ হাম্বলী আলিম, ফকীহ, উসূলবিদ ও হাদিসশাস্ত্রজ্ঞ এবং একজন হাফিযে হাদিস।

তিনি লিখেছেন, ولو جاء إنسان إلى سرير الميت يدعوه من دعوه من دون الله ويستغيث به، كان ‌هذا ‌شركاً ‌محرماً بإجماع المسلمين

“যদি মানুষ মৃতের খাটিয়ার কাছে এসে তাঁর কাছে দুআ করে, যে আল্লাহকে বাদ দিয়ে তার কাছে দুআ করে, তার মাধ্যমে ইস্তিগাসাহ করে, তাহলে এটা মুসলিমদের ইজমা মোতাবেক শির্ক-হারাম”।

যদি মাইয়্যিতের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর কাছে দুআ করা, ইস্তিগাসা করা, ইস্তিআনাহ করা শির্ক হয়, তাহলে দূর থেকে মৃতকে ডাকা, ইস্তিগাসাহ- ইস্তিআনাহ করাও শির্কই হবে। 

৮) ইমাম আল বুহুতী [রাহ.]: ইমাম মানসূর বিন ইউনুস আল বুহুতী আল হাম্বলী [রাহ.] ছিলেন মিসরের শাইখুল হানাবিলাহ। তাঁর মৃত্যু ১০৫১ হিজরিতে। ইমাম বুহুতী তাঁর কিতাবসমূহে যেসব মন্তব্য উল্লেখ করেছেন সাধারণত তা হাম্বলী মাযহাবের মুফতাহ বিহি কওল হিসেবে গণ্য, অর্থাৎ এর ওপর ফাতাওয়া, এটাই মাযহাবের মূল মত। তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ: উমদাতুত তালিব, শারহুল মুন্তাহাল ইরাদাত, আর রাউদ্বুল মুরবি ও কাশশাফুল ক্বিনা। 

ইমাম আল বুহুতী [রাহ.] এই মাসআলায় শাইখুল ইসলামের [রাহ.] মত উল্লেখ করে এরপর নিজস্ব মন্তব্য যুক্ত করেছেন, আর এটাই হাম্বলী মাযহাবের মূল মত হিসেবে গণ্য। নিচের উদ্ধৃতিতে

أو جعل بينه وبين الله وسائط يتوكَّل عليهم، ويدعوهم ويسألهم إجماعًا. انتهى) أي: كفر؛ لأن ذلك كفعل عابدي الأصنام قائلين: {‌مَا ‌نَعْبُدُهُمْ إلا لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللَّهِ زُلْفَى

 “(শাইখুল ইসলাম বলেন) অথবা যদি ব্যক্তি নিজের ও আল্লাহর মাঝে মাধ্যম স্থির করে তাদের ওপর তাওয়াক্কুল তথা নির্ভর করে, তাদের কাছে দুআ করে (অর্থাৎ বিপদে তাদের আহ্বান করে), তাদের কাছে (মনবাঞ্ছা পূরণার্থে) চায় তাহলে ইজমাগতভাবে (শাইখের উক্তি শেষ), (ইমাম বুহুতীর মন্তব্য শুরু) অর্থাৎ (ইজমাগতভাবে) কুফর হবে। কেননা এটা তো মূর্তিপূজকদের অনুরূপ কাজ, যেমন তারা বলতো, ‘আমরা কেবল এজন্যই তাদের ‘ইবাদাত করি যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেবে’”

অর্থাৎ ইস্তিগাসাহ- ইস্তিআনার এই ধরণটি শির্ক হবার বিষয়টি কেবল শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহহাবের [রাহ.] কিংবা তাঁর পূর্বসুরি শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়ার [রাহ.] একক অবস্থান  নয়; বরং এটা হাম্বলী ফিকহের মূল অবস্থান এবং হাম্বলী আলিমগণ এর স্বপক্ষে ইজমার দাবি করে থাকেন। 

৯) ইমাম আল মারদাউই [রাহ.]: ইমাম আলাউদ্দীন আবুল হাসান আল মারদাউই আল হাম্বলী [রাহ.] ছিলেন মুতাআখখির হাম্বলী ফকিহগণের অন্যতম। হাম্বলী মাযহাবের ভিত্তি যেসব কিতাবের ওপর দাঁড়িয়ে আছে তন্মধ্যে দুটি কিতাব তিনি প্রণয়ন করেছেন, “আল ইনসাফ ফি মা’রিফাতির রাজিহ মিনাল খিলাফ” ও “তাসহীহুল ফুরু”। তাঁর মৃত্যু ৮৮৫ হিজরিতে।

ইমাম আল মারদাউই [রাহ.] এই বিষয়ে উপরে উল্লেখিত শাইখুল ইসলামের [রাহ.] মন্তব্য উল্লেখ করে দেয়াই যথেষ্ট মনে করেছেন। ফলে এতে তাঁর ঐকমত্য সুস্পষ্ট। দেখুন- আল ইনসাফ: ২৭/১০৮ 

১০) ইমাম আর রুহাইবানী [রাহ.]:  ইমাম মুস্তাফা বিন সাঈদ আর রুহাইবানী আল হাম্বলী [রাহ.] ছিলেন দামেস্কের হাম্বলীদের মুফতী। হাম্বলী মাযহাবের মুফতাবিহী কওলের কিতাব “গায়াতুল মুন্তহা”-এর প্রসিদ্ধতম ব্যাখ্যা “মাতালিবু উলিন নুহা”-এর রচয়িতা তিনি। ১২৪৩ হিজরি মোতাবেক ১৮২৭ খৃষ্টাব্দে মারা যান। 

ইমাম আর রুহাবানী [রাহ.] স্বীয় কিতাবে باب حكم المرتد ।“মুরতাদদের বিধান বিষয়ক অধ্যায়”-এ যারা আল্লাহ ও বান্দার মাঝে মাধ্যম স্থির করে তাদের বিধান উল্লেখ করতে গিয়ে লিখেছেন, 

(أو جعل بينه وبين الله وسائط يتوكل عليهم ويدعوهم ويسألهم) كفر (إجماعا قاله الشيخ) تقي الدين

“(অথবা যদি সে নিজের ও আল্লাহর মাঝে মাধ্যম স্থির করে, এরপর সেই মাধ্যমের ওপর তাওয়াক্কুল বা নির্ভর করে, তাদের উদ্দেশ্যে দুআ বা আহ্বান করে, তার কাছে চায়) তাহলে সে কাফির হবে (ইজমা অনুযায়ী, এটা বলেছেন আশ শাইখ) অর্থাৎ তাকিউদ্দীন।” 

এই অনুবাদে () এর ভেতরের বক্তব্য গায়াতুল মুন্তাহার, আর ব্র্যাকেট ছাড়া লেখাটুকু ইমাম রুহাইবানীর [রাহ.]। এটা বেশ আশ্চর্যের বিষয়ে যে, ১৯ শতকের শুরুর দিকে, যখন ওয়াহাবী বিরোধী সেন্টিমেন্ট হিজাজ, শাম, ইরাক ও মিসরে তুঙ্গে ঠিক সেসময় ইমাম আর রুহাইবানী [রাহ.] এরকম মাসআলায় ঠিক একই মত দিচ্ছেন, তাও শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়ার [রাহ.] মতকে সমর্থন করে!

বাস্তবতা হচ্ছে হক্বের প্রদীপ নিভু নিভু করে হলেও সর্বদাই জ্বলন্ত থাকে। 

১১) ইমাম ইবন দ্বুইয়্যাহ (‌‌‌ابن ‌ضُوَيَّان) [রাহ.]: ইমাম ইব্রাহীম বিন মুহাম্মাদ বিন সালিম বিন দ্বুইয়্যান [রাহ.] ছিলেন নজদের প্রখ্যাত হাম্বলী ফকীহ, বংশলতিকা বিশেষজ্ঞ ও ঐতিহাসিক। তিনি ১৩৫৩ হিজরিতে মারা যান। নজদ এলাকার লোক হিসেবে উনার মত শাইখের অনুরূপ হওয়াই আমরা স্বাভাবিক ধরে নিলাম। কিন্তু উনার গ্রন্থ মানারুস সাবীল শরহুদ দালীল, হাম্বলী ফিকহের প্রসিদ্ধতম মতনসমূহের একটি “দালীলুত তালিব”-এর বেশ প্রখ্যাত ব্যাখ্যা। এছাড়া হাম্বলী ফিকহের মাসাইলের দলীল খুঁজতে এই গ্রন্থটি সর্বাধিক সহায়ক হিসেবে বিবেচ্য। যে কারণে আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী [রাহ.] এই গ্রন্থের হাদিসসমূহের তাখরিজ ও তাহকীক করেছেন, “ইরওয়াউল গালীল ফি তাখরিজি আহাদিসি মানারিস সাবীল”-নামে। এজন্য এই গ্রন্থে উনার মন্তব্যটি সমর্থক হিসেবে আমরা উল্লেখ করছি। তিনি লিখেছেন, 

أوجعل بينه وبين الله وسائط يتوكل عليهم، ويدعوهم ويسألهم: كفر إجماعا

“অথবা যদি ব্যক্তি নিজের ও আল্লাহর মাঝে মাধ্যম স্থির করে, সেই মাধ্যমদের ওপর তাওয়াক্কুল বা নির্ভর করে, তাদের কাছে দুআ করে, তাদের কাছে চায়- তাহলে ইজমা মোতাবেক সে কুফর করেছে বা কাফির হয়েছে”।

১২) ইমাম আয যাহাবী [রাহ.]: ইমাম আবু আব্দিল্লাহ মুহাম্মাদ বিন আহমাদ শামসুদ্দীন আয যাহাবী [রাহ.] ছিলেন হাফিযে হাদিস, ঐতিহাসিক, আল্লামা, মুহাক্কিক ও ইমামুল আইম্মাহ। তাঁর মৃত্যু ৭৪৮ হিজরিতে। ইসলামের ইতিহাস ও হাদিস শাস্ত্রে তিনি এক অবিস্মরণীয় নাম। এই দুই শাস্ত্র যেসব মহান ব্যক্তির কর্মের ওপর ভিত্তিশীল তাঁদের মাঝে ইমাম যাহাবী অন্যতম। 

ইমাম যাহাবী তাঁর প্রখ্যাত জীবনীকোষ “সিয়ারু আ’লামে” সায়্যিদাহ নাফিসাহ বিনতে হুসাইনের [রাহ.] জীবনী আলোচনার এক পর্যায়ে তাঁর কবরে সঙ্ঘটিত বিভিন্ন শির্ক সম্পর্কে উল্লেখ করে লিখেছেন, 

ولجهلة المصريين فيها اعتقاد يتجاوز الوصف، ولا يجوز مما فيه من الشرك، ويسجدون لها، ويلتمسون منها المغفرة، ‌وكان ‌ذلك ‌من ‌دسائس دعاة العبيدية

“অজ্ঞতার কারণে মিসরীয়রা এতে আকিদাগতক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন করে থাকে, আর এর মধ্যে যেসব শির্ক রয়েছে তা মোটেও জায়েয নয়, (যেমন) তারা তাঁর কবরে সিজদা করে থাকে, তাঁর কাছ থেকে মাগফিরাত অন্বেষণ করে! এগুলো সব উবাইদী প্রচারকদের ষড়যন্ত্রের ফসল”।

বোঝা যাচ্ছে যে কবর কেন্দ্রিক এসব তাওহিদ বিরোধী কর্মকাণ্ডকে ইমাম যাহাবী [রাহ.] শির্ক বলেই মনে করছেন। 

১৩) ইমাম মুহাম্মাদ সানাউল্লাহ পানিপথী [রাহ.]: ইমাম সানাউল্লাহ পানিপথী [রাহ.] ভারতের প্রসিদ্ধতম আলিমদের একজন। ছিলেন হানাফী ফকিহ ও মুফাসসির। সেকালের রীতি অনুযায়ী তরিকামতে তাসাউফ চর্চা করতেন। ছিলেন নকশবন্দী তরিকাভুক্ত। তাঁর পীর ছিলেন আরেক প্রসিদ্ধ আলিম মির্জা মাযহার জানে জানা [রাহ.]। তিনি আকিদায় মাতুরিদী ধারা অনুসরণ করতেন। তাঁর প্রসিদ্ধ কীর্তি হচ্ছে তাফসিরে মাযহারী। তাঁর মৃত্যুহয় ১২২৫ হিজরিতে।

ইমাম পানিপথী [রাহ.] তাসাউফের তালিবদের জন্য একটা ছোট্ট পুস্তিকা লিখেছেন, এতে এ প্রসঙ্গে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা স্থান পেয়েছে, নাম: ইরশাদুত তালিবীন।

আমাদের আলোচনার সাথে প্রাসঙ্গিক বেশকিছু মাসআলা এই পুস্তিকায় আলোচিত হয়েছে, যেমন:

১) আউলিয়াদের ইলমে গায়েব থাকে না,

২) গাইরুল্লাহর কাছে প্রয়োজন পূরণে আহ্বান করা কুফর।

৩) গাইরুল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া জায়েয নেই। 

৪) গাইরুল্লাহর কাছে দুআ করা জায়েয নয়। 

৫) কোনো মৃত বা গাইবে থাকা ওলীর উদ্দেশ্যে বলা, হে অমুক আল্লাহর জন্য আমাকে এটা দিন, এটা বলা কুফর। 

এই আলোচনার মাধ্যমে তাসাউফের নামে যেসব শির্ক-কুফরের প্রচলন হয়েছিল, তিনি তা দূর করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। 

তিনি লিখেছেন, “যদি কেউ বলে, এই কথার ব্যাপারে খোদা ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাক্ষী, তাহলে তা কুফর হবে। আউলিয়ায়ে কেরাম অস্তিত্বহীনকে সৃষ্টি করতে আর মজুদ জিনিসকে ধ্বংস করতে সক্ষম নন। এজন্য সৃষ্টি করা, ধ্বংস করা, রিযক পৌঁছানো, সন্তানাদি দেয়া, অসুস্থকে সুস্থতা দেয়া ইত্যাদি বিষয়ে তাঁদের কাছে সাহায্য চাওয়া কুফর, যেমনটা আল্লাহ তাআলা কুরআন কারিমে বলেন, 

قُل لَّاۤ أَمۡلِكُ لِنَفۡسِی نَفۡعࣰا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَاۤءَ ٱللَّهُۚ

‘বলুন, আল্লাহ যা ইচ্ছে করেন তা ছাড়া আমার নিজের ভাল-মন্দের উপরও আমার কোন অধিকার নেই’।“

অতঃপর তিনি বলেন, “খোদা ব্যতীত অপর কারও ইবাদাত করা জায়েয নয়, একইভাবে খোদা ব্যতীত অপর কারও কাছে মদদ বা সাহায্য চাওয়াও জায়েয নয়। إِیَّاكَ نَعۡبُدُ وَإِیَّاكَ نَسۡتَعِینُ, অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা বান্দাদেরকে এই শিক্ষা দিচ্ছেন যে, তারা যেন এভাবে বলে, হে আমাদের ইলাহ, আমরা খাসভাবে কেবল আপনার ইবাদাত করি, আর আপনার কাছেই সাহায্য চাই। (আয়াতের) শব্দ إِیَّاكَ সীমিতকরণের জন্য প্রয়োগ করা হয়েছে। কাজেই আউলিয়ায়ে কিরামের উদ্দেশ্যে মানত করা জায়েয নয়। কেননা মানত ইবাদাত। যদি কেউ এমন মানত করে, তাহলে সে এই মানত পূরণ করবে না। কেননা সামর্থমত গুনাহ থেকে বাঁচা ওয়াজিব। একইভাবে কবরের তাওয়াফ করাও জায়েয নয়”। 

এরপর তিনি লিখেছেন, “মৃত্য বা জীবিত আউলিয়া বা আম্বিয়া তথা নবীগণের কাছে দুআ করা জায়েয নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, الدُّعَاءُ هُوَ العِبَادَةُ  ‘দুআই হচ্ছে ইবাদাত’, অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ করা ইবাদাত। এরপর তিনি (সা.) এই আয়াত তিলাওয়াত করেন, ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِي سَيَدْخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِينَ

‘তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব। নিশ্চয় যারা অহংকারবশে আমার ইবাদাত থেকে বিমুখ থাকে, তারা অচিরেই জাহান্নামে প্রবেশ করবে লাঞ্ছিত হয়ে’” ।

ইমাম পানিপথীর [রাহ.] আলোচনা থেকে এটা সুস্পষ্ট যে মৃত ও দূরে থাকা আউলিয়া ও সলেহিনদের কাছে ইস্তিগাসাহ, ইস্তিআনাহ ও ইস্তিআযাহ করাকে নিষিদ্ধ কেবল আসারিরাই মনে করে, এমন না; বরং মাতুরিদীরাও এর ব্যতিক্রম ভাবেন না। এছাড়া এর আগে আমরা আশআরী আলিমদের উক্তিও দেখেছি। আসলে আকিদার সকল ঘরানার আলিমগণই এটা না-জায়েযই মনে করেন। আর এই না-জায়েয বলাটা কোনো একক মাযহাবেও সীমাবদ্ধ নয়, কেননা এখন পর্যন্ত আমরা হাম্বলী, শাফিঈ, মালিকী ও হানাফী আলিমদের অবস্থান দেখেছি। এমনকি বিশুদ্ধ আকিদার সূফীগণও যে একে গ্রহণ করেন না তাতো ইমাম পানিপথীর আলোচনার সুস্পষ্ট। তিনি ছিলেন নকশবন্দীদের যুগের ইমাম। অথচ আজকাল এমন নকশবন্দীও দেখা যায়, যারা একে মুস্তাহাব মনে করে! সুবহানআল্লাহ! 

১৪) ইমাম তাহির পাটনী [রাহ.]: ইমাম জামালুদ্দীন মুহাম্মাদ তাহির পাটনী গুজরাতী আল হিন্দী [রাহ.]। তিনি ছিলেন ভারতের প্রসিদ্ধতম ইমামগণের অন্যতম। হাদিসে মহান আলিম। স্বীয় যুগে তাঁকে মালিকুল মুহাদ্দিসীন বা মুহাদ্দিসদের বাদশাহ বলা হত। তিনি ৯৮৬ হিজরিতে মারা যান। 

তিনি স্বীয় গ্রন্থে কবর যিয়ারাত সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন, 

‌فإن ‌منهم من قصد بزيارة قبور الأنبياء والصلحاء أن يصلي عند قبورهم ويدعو عندها ويسألهم الحوائج، وهذا لا يجوز عند أحد من علماء المسلمين، فإن العبادة وطلب الحوائج والاستعانة حق لله وحده

“তাদের অনেকে আম্বিয়া (নবীগণ) ও সালিহীনদের (নেককারদের) কবর এজন্য যিয়ারাত করতে যেতে চায় যে, তারা সেখানে তাঁদের কবরের কাছে সালাত আদায় করবে, এর কাছে দুআ করবে, নিজের হাজত তথা প্রয়োজন পূরণার্থে তাঁদের কাছে চাইবে; এসব কাজ মুসলিমদের কোনো আলিমের নিকটই বৈধ বা জায়েয নয়। কেননা ইবাদাত, প্রয়োজন পূরণের অভিলাষ এবং ইস্তিআনাহ কেবল আল্লাহ তাআলার হক”।

ইমাম পাটনী [রাহ.] পুরো বিষয়টি অত্যন্ত চমৎকারভাবে স্বল্প কথায় বিশ্লেষণ করে দিয়েছেন। 

১৫) ইমাম মুহিউদ্দীন মুহাম্মাদ আফেন্দী আল বিরকাউই [রাহ.]: ইমাম মুহাম্মাদ আফেন্দী আল বিরকাউই বা আল বিরকিলী আর রুমী [রাহ.] ছিলেন উসমানী সাম্রাজ্যের প্রসিদ্ধ আলিমদের একজন। এই হানাফী আলিম ছিলেন আরবি ভাষা, ব্যাকরণ ও তাজউইদের বিশেষজ্ঞ। তাঁর মৃত্যু ৯৮১ হিজরিতে।

ইমাম বিরকাউই [রাহ.] ছিলেন প্রসিদ্ধ ওয়ায়েজ। সেকালের মুলহিদীন বা ধর্মদ্রোহীদের ব্যাপারে সতর্কতামূলক ওয়াজ যেমন করেছেন, তেমনি গ্রন্থও রচনা করেছেন। কবর যিয়ারত সংক্রান্ত শির্ক-বিদআতকে তুলে ধরে খণ্ডন করতে তিনি লিখেছেন, “যিয়ারাতুল কুবুর আশ শারঈয়্যাহ ওয়াশ শিরকিয়্যা”, ৬১ পৃষ্ঠার এই সংক্ষিপ্ত পুস্তিকাটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় আলোচনায় পূর্ণ। এই পুস্তিকায় তিনি শরঈভাবে বৈধ কবর যিয়ারত আর শির্কী কবর যিয়ারতের মধ্যকার পার্থক্য তুলে ধরেছেন। 

এক পর্যায়ে শির্কী যিয়ারতকারীদের অবস্থা তুলে ধরে তিনি লিখেছেন, 

“এদের কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্য হয়ে গেছে মৃতের মাধ্যমে শির্ক করা, তার কাছে দুআ করা, প্রয়োজন পূরণের অভিলাষ জানানো, আর তার থেকে বরকত অর্জন করা”। 

তাঁর আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট যে মৃতের কাছে প্রয়োজন পূরণের আকাঙ্ক্ষা জানানোকে তিনি শির্ক মনে করেন, যার মধ্যে ইস্তিগাসাহ-ইস্তিআনাহ শামিল।

১৬) ইমাম দামাদ আফেন্দী [রাহ.]: শাইখুল ইসলাম দামাদ আফেন্দী [রাহ.] ছিলেন হানাফী ফিকহের প্রসিদ্ধ ইমাম ও মুফাসসির। হানাফী ফিকহের প্রসিদ্ধ গ্রন্থসমূহের একটি “মাজমাউল আনহুর শারহু মুলতাকাল আবহুরের” রচয়িতা তিনি। তাঁর মৃত্যু হয় ১০৭৮ হিজরিতে।

ইস্তিগাসাহ-ইস্তিআনাহ ও ইস্তিআযার ক্ষেত্রে ক্রিয়াশীল একটি মৌলিক বিশ্বাস হচ্ছে নেককারদের রূহসমূহ ঘুরে বেড়ায়, বা আহ্বানের সময় উপস্থিত থাকে, তাঁরা আর্তের আহ্বান শোনেন ও সাড়া দেন।

এই বিশ্বাসের ভিত্তি উৎখাত করে তিনি লিখেছেন, 

ويكفر بقوله أرواح المشايخ حاضرة، تعلم

“মাশাইখদের রূহসমূহ (সর্বত্র) উপস্থিত, তাঁরা সবকিছু জানেন- এটা বললে ব্যক্তিকে কাফির হবে”। 

১৭) ইমাম ইবন আবিদীন আশ শামী [রাহ.]: ইমাম মুহাম্মাদ আমীন বিন উমার, যিনি ইবন আবিদীন আশ শামী নামে প্রসিদ্ধ, বাংলাদেশে তাঁর পরিচিতি অনাবশ্যক। হানাফী ফিকহের এই প্রসিদ্ধ ইমামের কিতাব “রাদ্দুল মুহতার” বা ফাতাওয়ায়ে শামী আমাদের অঞ্চলেই শুধু নয়, গোটা পৃথিবীতে হানাফী ফিকহের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ হিসেবে পরিগণিত হয়। তাঁর মৃত্যু ১২৫২ হিজরিতে।

যারা ইস্তিগাসাহ-ইস্তিআনাহ ও ইস্তিআযাহ করে থাকে, তারা এই বিশ্বাস থেকেই এই কাজ করে থাকে যে, মৃত নেককার ব্যক্তি বোধহয় দুনিয়ার জীবনে হস্তক্ষেপ করতে বা সাহায্য করতে সক্ষম। সাহায্য করতে সক্ষম না ভাবলে তো কেউ এভাবে সাহায্য চাইতো না। এই বিশ্বাসের মূলে আঘাত করে ইমাম ইবন আবিদীন [রাহ.] লিখেছেন, 

إن ظن أن الميت يتصرف في الأمور دون الله تعالى واعتقاده ذلك كفر

“যদি কেউ এটা ধারণা করে যে আল্লাহ তাআলার পরিবর্তে কোনো মৃত ব্যক্তি বিভিন্ন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে- তাহলে তার এই বিশ্বাস কুফর”।

১৮) ইমাম তাহতাউই [রাহ.]: ইমাম আহমাদ বিন মুহাম্মাদ আত তাহতাউই [রাহ.] ছিলেন প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ। মারাকিল ফালাহ ও আদ দুররুল মুখতারে তাঁর লিখিত হাশিয়া সারা দুনিয়ার হানাফী আলিমগণের নিকট সমাদৃত। তিনি ১২৩১ হিজরিতে মিসরের কায়রোয় মারা যান। 

তিনি স্বীয় কিতাবে ইমাম আশ শামীর [রাহ.] উপরোল্লেখিত উদ্ধৃতিটির অনুরূপ বক্তব্য উল্লেখ করার মাধ্যমে একই মতামত জ্ঞাপন করেন।  

১৯) আল্লামা শিহাবুদ্দীন আলুসী [রাহ.]: ইমাম শিহাবুদ্দীন মাহমুদ আল আলুসী [রাহ.] ছিলেন প্রসিদ্ধ মুফাসসির, ফকীহ ও মুহাদ্দিস। প্রসিদ্ধ এই আলিমের মৃত্যু হয় ১২৭০ হিজরিতে। তাফসির: “রূহুল মাআনী”- তাঁর সুপ্রসিদ্ধ কীর্তি। 

তিনি লিখেছেন, 

أن الناس قد أكثروا من دعاء غير الله تعالى من الأولياء الأحياء منهم والأموات

وغيرهم، مثل يا سيدي فلان أغثني، وليس ذلك من التوسل المباح في شيء، واللائق بحال المؤمن عدم التفوه بذلك وأن لا يحوم حول حماه، وقد عدّه أناس من العلماء شركا وأن لا يكنه، فهو قريب منه ولا أرى أحدا ممن يقول ذلك إلا وهو يعتقد أن المدعو الحي الغائب أو الميت المغيب يعلم الغيب أو يسمع النداء ويقدر بالذات أو بالغير على جلب الخير ودفع الأذى وإلا لما دعاه ولا فتح فاه، 

“বর্তমানে মানুষ আল্লাহ তাআলাকে বাদ দিয়ে জীবিত ও মৃত আউলিয়াদেরকে ডাকায় অধিক পরিমাণে লিপ্ত হয়ে গেছে। যেমন, তারা ডাকে, ইয়া সায়্যিদ অমুক, আমাকে রক্ষা করুন (ইস্তিগাসাহ)। এটা মোটেও মুবাহ তথা বৈধ তাওয়াসসুল (বা উসিলা দিয়ে ডাকা) নয়। এতে জড়িয়ে না পড়াই মুমিনের জন্য উপযুক্ত, অর্থাৎ সে সংরক্ষিত এলাকায় সীমানার কাছাকাছি ঘুরাঘুরি করবে না। 

অনেক আলিমই এই বিষয়টাকে শির্ক বলেছেন; যদি এটা শির্ক নাও হয়, তবুও শির্কের কাছাকাছি বিষয়। 

যারা এভাবে বলে দুআ করে বা ডাকে তারা এটাই বিশ্বাস করে যে, আহূত ব্যক্তি জীবিত তবে গাইব অর্থাৎ দূরে আছেন, কিংবা অনুপস্থিত মৃত ব্যক্তি যে কি না গাইব জানে, কিংবা সে এই আহ্বান শুনতে পায়, সেই সত্ত্বা নিজেই কল্যাণ দানে ও কষ্ট দুরীকরণে সাহায্য করতে সক্ষম কিংবা অপর কারও মাধ্যমে সে সাহায্য করতে সক্ষম। এটা বিশ্বাস না করলে তো সে ঐ সত্ত্বাকে ডাকতও না, আর এজন্য তার মুখও খুলতো না”। 

আল্লামা আলুসীর [রাহ.] আলোচনা সুস্পষ্ট যে অনেক আলিমই এ ধরণের আমলকে শির্ক মনে করেন, আর এটা কোনো বিচ্ছিন্ন মত নয়। আর এক্ষেত্রে যেসকল মানসিকতা ক্রিয়া করে থাকে, তিনি সেগুলোও বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছেন, এগুলোর সবগুলোই শির্কের বাহন। 

২০) ইমাম শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী [রাহ.]: ইমাম আহমাদ বিন আব্দির রাহীম আল ফারুকী আদ দিহলাউই আল হিন্দী [রাহ.], যিনি শাহ ওয়ালিউল্লাহ খেতাবে সমাধিক প্রসিদ্ধ, ছিলেন প্রখ্যাত হানাফী ফকীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও সমাজ সংস্কারক। এছাড়া আসরারুশ শারী’আর মহান ব্যাখ্যাকারী। উপমহাদেশে তিনি ভারতগুরু উপাধিতে ভূষিত, কেননা উপমহাদেশের হানাফী ফিকহের যাবতীয় ধারা, যথা: বালাকোটি, রেজাখানী, দেওবন্দী, দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতের শাফিঈ ফিকহ আর আহলে হাদিস ধারার সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ইলমী সনদসমূহ উনার কাছে গিয়েই একত্রিত হয়েছে। অর্থাৎ তিনি সেই বটবৃক্ষ, যার শিকড় বহুদূর বিস্তৃত হয়েছে। এই উপমহাদেশে ঝিমিয়ে পড়া হাদিস চর্চাকে তিনিই পুরুজ্জীবিত করেন। 

শাহ সাহেব [রাহ.] ১১৭৬ হিজরিতে মারা যান। 

শাহ সাহেব [রাহ.] কবরপূজা ও এর সাথে সম্পৃক্ত বিষয়সমূহ নিয়ে ফার্সি ভাষায় একটি আস্ত গ্রন্থ লিখেছেন, যার নাম, “আল বালাগুল মুবীন”। গ্রন্থটির ঊর্দূ ও বাংলা অনুবাদ হয়েছে অনেক আগেই। এই গ্রন্থেই তিনি কবরসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে যেমন কবরওয়ালার কাছে চাওয়া, সাহায্য চাওয়া, আশ্রয় চাওয়া, কবরের সামনে বিনয়ের সাথে দাঁড়িয়ে থাকা, সেখানে নামাজ পড়া- এগুলোকে শির্কী কর্মকাণ্ড ও কবরপূজা বলে অভিহিত করেছেন। 

কবরপূজারীদের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি লিখেছে, “আর কবরবাসীদেরকে তাদের নাম নিয়ে ডাকতে থাকে এবং তাদের কাছে বিভিন্ন বস্তু পাওয়ার জন্যও দুআও করতে থাকে। তাদের কাছে নিজেদের রিযক ও সন্তানসন্ততিও চেয়ে থাকে”।

এদেরকে হিন্দুদের সাথে তুলনা করে তিনি লিখেছে, 

“হিন্দু ও মুশরিকরা যেভাবে নিজেদের প্রতিমা ও মূর্তির সাথে ব্যবহার করে থাকে, এভাবে আমাদের মুসলিম সমাজের কতিপয় লোক বুযুর্গদের কবর নিয়ে এমন বহু ধরণের অকর্ম-কুকর্ম করে, যার সমর্থন শরীআতের কোথাও বিন্দুমাত্র খুঁজে পাওয়া যায় না”।

এসব লোক মৃত নেককার ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে যেসকল বিশ্বাস পোষণ করে ইস্তিগাসাহ, ইস্তিআনাহ ও ইস্তিআযাহ করে থাকে তা যে আল্লাহ তাআলার সিফাতের সাথে শির্ক হয়, সেটা ব্যাখ্যা করে তিনি লিখেছেন, 

“যেমন কাউকে জীবিত করা, মৃত্যুদান করা, সন্তান-সন্ততি দান করা, রিযক দেয়া, অদৃষ্ট ও গোপনীয় বিষয়ের জ্ঞান থাকা ইত্যাদি। এসব বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী একমাত্র আল্লাহ তাআলার সত্ত্বার সাথেই সংশ্লিষ্ট। এই কাজ আল্লাহ তাআলা ব্যতীত অন্য কারও দ্বারা হতে পারে না, হওয়া সম্ভব না। এই কাজ আল্লাহ তাআলা ব্যতীত অন্য কারও দ্বারা হতে পারে এমন ধারণা ও বিশ্বাস থাকাটা শিরক ছাড়া আর কী হতে পারে?”

ইস্তিগাসার বিষয়টি তিনি ‘মাজালিসুল আবরার’ কিতাবের উদ্ধৃতি দ্বারা খণ্ডন করে লিখেছেন, 

“অনেক লোক এই কবর পূজার বিদআতের আশ্রয় গ্রহণের ফলে বরবাদ হয়ে গিয়েছে। তারা গাইরুল্লাহকে ইয়া মাওলা (হে আমার মাওলা) বলে ডেকে থাকে এবং কবরবাসীর নিকট নিজের মনস্কামনা ও হাজত পূরণের জন্য আবেদন জানিয়ে থাকে”।

এভাবে পুরো বিষয়টিই তিনি সুস্পষ্টভাবে খণ্ডন করেছেন। আমরা পাঠককে অনুরোধ করবো, তাঁরা যেন বইটি আদ্যোপ্রান্ত পাঠ করেন। 

তিনি তাঁর অপর কালজয়ী গ্রন্থ “হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ”-তেও এই বিষয়ে প্রাসঙ্গিক আলোচনা করেছেন। 

যেমন তিনি সূরা জ্বিনের ১৮ নং আয়াত উল্লেখ করেন, فَلا تَدْعُوا مَعَ اللَّهِ أَحَدًا

“কাজেই তোমরা আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে ডেকো না”।

এরপর এর ব্যাখ্যায় লিখেছেন, 

وَلَيْسَ المُرَاد من الدُّعَاء الْعِبَادَة كَمَا قَالَه الْمُفَسِّرُونَ، بل هُوَ الِاسْتِعَانَة لقَوْله تَعَالَى:

 بَلۡ اِیَّاهُ تَدۡعُوۡنَ فَیَکۡشِفُ مَا تَدۡعُوۡنَ اِلَیۡهِ 

“এই আয়াতের উদ্দেশ্য কেবল ইবাদাত জাতীয় দুআই নয়, যেমনটা মুফাসসিরগণ বলেছেন; বরং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে ইস্তিআনাহ, কেননা আল্লাহ তাআলা অপর আয়াতে বলেন- ‘বরং তাকেই তোমরা ডাকবে। অতঃপর যদি তিনি চান, যে জন্য তাকে ডাকছ, তা তিনি দূর করে দেবেন’”। 

অর্থাৎ এর মাধ্যমে তিনি ইস্তিআনাহ ও ইস্তিগাসার মূলোৎপাটন করেছেন। কেননা অনেকে মনে করে যে প্রথম আয়াতে আল্লাহ যে অন্য কাউকে ডাকতে নিষেধ করেছেন, এর মানে হল অন্য কাউকে ইবাদাতের নিয়তে ডাকতে বা ইবাদাতের নিয়তে অন্য কারও কাছে দুআ করা নিষিদ্ধ, কিন্তু আসবাবের ঊর্ধে সাহায্য প্রার্থনা বা ইস্তিআনার নিয়তে ডাকলে সমস্যা নেই! 

শাহ সাহেব [রাহ.] এই সন্দেহের অপনোদন করে সূরা আনআমের আয়াত উল্লেখ করে দেখালেন যে এই আয়াতে যেভাবে বলা হয়েছে ঠিক তেমনি পূর্বের আয়াতেও ইস্তিআনাই উদ্দেশ্য। কাজেই আল্লাহ তাআলা ব্যতীত কিংবা তাঁর পাশাপাশি অন্য কারও কাছে ইস্তিআনার সুযোগ নেই। 

২১) ইমাম শাহ ইসমাঈল আশ শহীদ দেহলভী [রাহ.]: শাহ ইসমাঈল বিন আব্দিল গাণি [রাহ.] ছিলেন শাহ ওয়ালিউল্লাহ [রাহ.] এর নাতি। নিজেও ছিলেন প্রখ্যাত আলিমে দ্বীন। তিনি স্বীয় দাদার ইলমের ধারক ও বাহক ছিলেন। ভারতে ব্রিটিশ আগ্রাসন ও সীমান্ত অঞ্চলে পাঞ্জাবের শিখ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জিহাদে নিজের জীবনকে ওয়াকফ করে দেন। বালাকোটের ময়দানে ১২৪৬ হিজরিতে শিখ রাজশক্তির সাথে সম্মুখ জিহাদে শাহাদাত বরণ করেন। 

কেবল সামরিকভাবে মুসলিমদের শক্তিশালী করার মধ্যেই তাঁর দাওয়াহ সীমিত ছিল না। তিনি দেখেছিলেন যে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো সাধারণত কবরপূজারী ও বিদআতী গোষ্ঠীর মাধ্যমে সাহায্যপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। কেননা এদের মাঝে তাওহিদের চেতনা থাকে না, এরা শির্ক-কুফর-বিদআত থেকেও বাঁচতে আগ্রহী থাকে না। এদের মূল উদ্দেশ্য থাকে দুনিয়ায় নিরাপদ থেকে জীবনযাপন করে যাওয়া, আর এটা করতে পারলেই তারা নিজেদের জীবনকে সার্থক মনে করে। 

ফলে ব্রিটিশদের সহায়তা করতে এসব গোষ্ঠী শাহ সাহেবের [রাহ.] আন্দোলনের বিরুদ্ধে আদাজল খেয়ে নামে। কাজেই তিনি সহজেই বুঝতে পারেন যে গোঁড়ায় হাত দেয়া লাগবে, মানুষকে শির্ক-কুফর-বিদআত ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত করতে হবে। তাই সামরিক আন্দোলনের পাশাপাশি তিনি ধর্মীয় এবং আকিদাগত সংস্কারেও ঝাঁপিয়ে পড়েন। 

এ উদ্দেশ্যে তিনি একটি চমৎকার গ্রন্থ প্রণয়ন করেন, “তাকউইআতুল ঈমান”, নামে। যদিও তিনি শাইখ ইবন আব্দিল ওয়াহহাবের [রাহ.] কিতাবুত তাওহিদ পড়েছেন এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না, তবে তাঁর এই গ্রন্থের সাথে কিতাবুত তাওহিদের প্রচণ্ড মিল বিদ্যমান। ইংরেজিতে একটা কথা আছে Great minds think alike. আর একই দ্বীনের একই আকিদায় মিল থাকাই স্বাভাবিক। 

এই গ্রন্থটি সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী [রাহ.] আরবিতে অনুবাদ করেছেন, নাম দিয়েছেন “রিসালাতুত তাওহিদ”। এর বাংলা অনুবাদও সুপ্রাপ্য। আমরা পাঠকদের অনুরোধ করবো, তাঁরা যেন বইটির বাংলা অনুবাদ অবশ্যই পড়েন।

তিনি ইস্তিগাসাকারীদের ব্যাপারে বলেছেন যে, এরা যদি মনে করে থাকে, আমরা মৃতদের কাছে আসলে প্রয়োজন পূরণে দুআ করছিনা, আমরা তাদের এজন্য ডাকি, যেন তাঁরা আল্লাহর কাছে আমাদের ব্যাপারটা নিয়ে সুপারিশ করে দেন, তাহলে আমরা এটা সহজে পেয়ে যাব, কাজেই এটা শির্ক হবে না, তাহলে তারা আসলে ভুল ভাবছে। কেননা মৃতরা তাদের এই আহ্বান কিভাবে শুনছে? সব স্থানের সকল কথা, আহ্বান কেবল আল্লাহ তাআলা শুনতে পান। তিনি আস সামি’ তথা সর্বশ্রোতা, এছাড়া তিনি আলিম, সর্বাবস্থার জ্ঞান কেবল তাঁরই রয়েছে। কাজেই মৃতদের ক্ষেত্রে যদি মনে করা হয় যে তাঁরা আহ্বান শুনছেন, জানছেন, তাহলে নিঃসন্দেহে আল্লাহর সিফাত যেমন শ্রবণ ও জ্ঞানের তাওহিদের সাথে শির্ক হচ্ছে, কেননা এমন ধরনের শ্রবণ ও জ্ঞান এককভাবে শুধু আল্লাহ তাআলার রয়েছে। 

তিনি লিখেছেন, 

وقال اللَّه تعالى: {وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنْ يَدْعُو مِنْ دُونِ اللَّهِ مَنْ لَا يَسْتَجِيبُ لَهُ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَهُمْ عَنْ دُعَائِهِمْ غَافِلُونَ} [الأحقاف: 5] ، وقد دلت هذه الآية على أن المشركين قد أمعنوا في السفاهة، فقد عدلوا عن اللَّه القادر العليم، إلى أناس لا يسمعون دعاءهم، وإن سمعوا ما استجابوا [لهم] ، وهم لا يقدرون على شيء، فظهر من ذلك أن الذين يستغيثون ويظنون أنهم ما أشركوا، فإنهم ما طلبوا منهم قضاء الحاجة، وإنما طلبوا منهم الدعاء، وإن لم يشركوا عن طريق طلب قضاء الحاجة، فإنهم أشركوا عن طريق النداء، فقد ظنوا أنهم يسمعون نداءهم عن بعد، كما يسمعون نداءهم عن قرب

“আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর সে ব্যক্তির চেয়ে বেশী বিভ্রান্ত কে যে আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুকে ডাকে যা কিয়ামতের দিন পর্যন্ত তাকে সাড়া দেবে না? এবং এগুলো তাদের আহবান সম্বন্ধেও গাফেল’। 

এই আয়াত প্রমাণ করে যে মুশরিকরা নির্লজ্জ বোকামীতে ডুবে গিয়েছিল। তারা সর্বোচ্চ ক্ষমতাবান ও সর্বজ্ঞানী আল্লাহ তাআলাকে বাদ দিয়ে এমন সব মানুষের অভিমুখী হয়েছিল যারা তাদের দুআ শোনেও না। যদিও শুনেও থাকে, তারপরেও তাদের সেই আহ্বানে সাড়া দিতে পারেনা। তারা তো কোনো বিষয়েই ক্ষমতাবান নয়। 

এথেকে এটাই সুস্পষ্ট হয় যে, যারা ইস্তিগাসাহ করে, আর মনে করে যে তারা তো শিরক করছে না, কেননা তারা তো এসব (মৃত/জীবিত) নেককারদের কাছে হাজত পূরণের কামনা করছে না, তারা কেবল তাদের কাছ থেকে দুআ কামনা করছে; (তাদের এই চিন্তা ভুল) কেননা যদি তারা হাজত পূরণের আকাঙ্ক্ষার মাধ্যমে শিরক নাও করে থাকে, তারা নিদা বা আহ্বানের মাধ্যমে শিরক করেছে। তারা অবশ্যই ভেবে নিয়েছে যে এসব সত্ত্বা যেভাবে কাছে থেকে তাদের আহ্বান শুনতে পারে ঠিক সেভাবে দূর থেকেও তাদের আহ্বান শুনতে পায়”।  

শাহ সাহেব [রাহ.] যেভাবে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন, আলহামদুলিল্লাহ তাতে পুরো বিষয়টি অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবেই পাঠকের সামনে উপস্থাপিত হয়েছে এবং ইন শা আল্লাহ এর মাধ্যমে এ সংক্রান্ত যাবতীয় সন্দেহ-সংশয় দূর হয়ে যায়। 

পুরো গ্রন্থে তাওহিদ ও তার বিপরীত শির্ক-কুফর সংক্রান্ত আরও গুরত্বপূর্ণ আলোচনা রয়েছে। সংক্ষেপনের স্বার্থে আমরা অধিক উদ্ধৃতি উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকলাম। 

২২) ইমাম নুআঈম বিন হাম্মাদ [রাহ.]: ইমাম নুআইম বিন হাম্মাদ [রাহ.] ছিলেন ইমাম বুখারীর [রাহ.] উস্তায। তাঁকে সমকালে ইলমে ফারাইযের সর্বাধিক জ্ঞানী ব্যক্তি বলা হত। ইমাম নুআইমই [রাহ.] সর্বপ্রথম “মুসনাদ” জাতীয় হাদিসগ্রন্থ প্রণয়ন করেন। খলকে কুরআনের মাসআলায় মু’তাযিলাদের অনুরূপ মত না দেয়ায় তাঁকে জেলে আটক করা হয়। তাওহিদের প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপোষহীন ব্যক্তিত্ব। তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ “আল ফিতান ওয়াল মালাহিম”, বাংলাতেও অনূদিত হয়েছে। ২২৮ হিজরিতে তাঁর মৃত্যু হয়। 

ইমাম বুখারী [রাহ.] তাঁর এই উস্তাযের বক্তব্য উল্লেখ করে লিখেছেন, 

وقال نعيم: ‌لا ‌يستعاذ بالمخلوق، ولا بكلام العباد والجن والإنس، والملائكة

“নুআঈম বলেছেন, কোনো মাখলুকের মাধ্যমে ইস্তিগাসাহ করবে না, কোনো বান্দা, জ্বীন, মানুষ বা ফেরেশতার কালাম বা কথার মাধ্যমেও ইস্তিগাসাহ করবে না”।

এথেকে এটাও বোঝা গেল যে ইমাম বুখারীর [রাহ.] মতেও কোনো মাখলুকের মাধ্যমে ইস্তিগাসাহ করা যাবে না। 

ইমাম ইবন হাজার আসকালানীও [রাহ.] তাঁর মন্তব্য উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, 

‌إذ ‌لا ‌يستعاذ ‌بمخلوق، قال الله تعالى: {فاستعذ بالله} وقال النبي صلى الله عليه وسلم: وإذا استعذت فاستعذ بالله

“কোনো মাখলুকের মাধ্যমে ইস্তিগাসাহ করা যাবে না। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অতঃপর আল্লাহর কাছেই আশ্রয় প্রার্থনা করো (ইস্তিগাসাহ করো)’, আর নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যখন তুমি আশ্রয় প্রার্থনা করবে, তখন আল্লাহ কাছেই আশ্রয় চাইবে’”

২৩) ইমাম আবু বাকর আল বাইহাক্বী [রাহ.]: ইমাম আবু বাকর আহমাদ বিন হুসাইন আল বাইহাক্বী [রাহ.] ছিলেন হাদিসের সুপ্রসিদ্ধ ইমাম, শাফিঈ ফকীহ ও আশআরী আকিদার ইমাম। সুনানুল কুবরা, সুনানুস সুগরা, আল মাআরিফ, দালাইলুন নাবুওয়্যাহ, মাআরিফাতুল সুনানি ওয়াল আসারের মত প্রসিদ্ধ হাদিস গ্রন্থের রচয়িতা তিনি। তিনি ৪৫৮ হিজরিতে মারা যান। 

তিনি লিখেছেন, ‌ولا ‌يصح ‌أن ‌يستعيذ بمخلوق من مخلوق

“এক মাখলুকের (অনিষ্ট) থেকে অপর মাখলুকের কাছে ইস্তিআযাহ বা আশ্রয় প্রার্থনা সঠিক নয়”।

২৪) ইমাম কাদ্বী আবু ইয়ালা ইবনুল ফাররা [রাহ.]: ইমাম, আল্লামাহ, ফকীহ ও কাদ্বী আবু ইয়ালা মুহাম্মাদ বিন আল হুসাইন ইবনুল ফাররা [রাহ.] ছিলেন হাম্বলী মাযহাবের প্রসিদ্ধ আলিম, শাইখুল হানাবিলাহ। তিনি ইবনু আসাকিরের [রাহ.] মত প্রসিদ্ধ ইমামের উস্তায ছিলেন। ৪৫৮ হিজরিতে মৃত্যু। 

তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছি, কেউ যদি হোঁচট খেয়ে বলে উঠে, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বা আলী, তাহলে এর বিধান কী?

উত্তরে তিনি বলেছেন, 

إن قصد الاستغاثةَ ‌فهو ‌مخطئٌ؛ لأنَّ الغوثَ من الله تعالى، وهما مَيتانِ فلا يَصِحُّ الغوثُ منهما، ولأنَّه يجبُ تقديمُ الله على غيره

“যদি এর মাধ্যমে ইস্তিগাসাহ উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে সে ভুল করেছে। কেননা সাহায্য কেবল আল্লাহ তাআলার কাছ থেকেই পাওয়া যায়। তাঁরা উভয়ে তো মৃত, কাজেই তাঁদের থেকে সাহায্য প্রার্থনা করা সঠিক নয়। কেননা অপরের ওপর আল্লাহকে প্রাধান্য দেয়া ওয়াজিব”। 

২৫) ইমাম ইবন আব্দিল বারর আল মালিকী [রাহ.]: ইমাম ইউসুফ বিন আব্দিল্লাহ বিন আব্দিল বারর [রাহ.] ছিলেন মালিকী মাযহাবের ইমাম, মুসলিম স্পেনের প্রধানতম আলিমদের একজন, আরবি ভাষাবিদ, হাদিসের হাফিয ও ঐতিহাসিক। তিনি ৪৬৩ হিজরিতে মারা যান।

তিনি লিখেছেন, ‌لأنه ‌محُالٌ ‌أن ‌يُستعاذَ ‌بمخلُوق، وعلى هذا جماعةُ أهل السُّنة. والحمدُ لله

“কোনো মাখলুকের মাধ্যমে ইস্তিআযাহ করা হবে এটা অসম্ভব ব্যাপার। আর এর ওপরই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআত প্রতিষ্ঠিত রয়েছে, সকল প্রশংসা আল্লাহ তাআলার”। 

২৬) ইমাম আবু হামিদ আল গাযালী [রাহ.]: হুজ্জাতুল ইসলাম আবু হামিদ মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ আল গাযালী [রাহ.] স্বনামেই আমাদের কাছে পরিচিত। তিনি ছিলেন প্রখ্যাত শাফিঈ ফকীহ, উসূলবিদ, সূফী ও দার্শনিক। তাঁর অমরকীর্তি হচ্ছে “ইহইয়াউ ঊলুমিদ্দীন”। তিনি ৫০৫ হিজরিতে মারা যান। 

আমাদের আলোচ্য বিষয়ে ইমাম গাযালীর একটি বক্তব্য আল্লামা মাহমূদ শুকরী আলূসী [রাহ.] উল্লেখ করেছেন। ইমাম গাযালী [রাহ.] বলেছেন, 

المؤمن لا يجعل بينه وبين الله تعالى وسائط في الطلب، قال تعالى: ﴿وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيدِ﴾

“কোনো কিছু চাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর নিজের ও আল্লাহর মাধ্যমে কোনো মাধ্যম ধরবে না। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি তার ঘাড়ে অবস্থিত ধমনী অপেক্ষাও নিকটতর’”।

অর্থাৎ যেহেতু আল্লাহ তাআলা জ্ঞানত আমাদের এতই নিকটবর্তী, তিনি সব কিছু শোনেন, দেখেন ও জানেন, কাজেই তাঁকে শোনানোর, জানানোর বা দেখানোর জন্য, নিদেনপক্ষে মানানোর জন্য অন্য কাউকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করার মোটেও প্রয়োজন নেই। 

২৭) মুহিউসসুন্নাহ ইমাম আল বাগাউই [রাহ.]: ইমাম আল হুসাইন বিন মাসঊদ আল বাগাউই [রাহ.] মুহিউসসুন্নাহ বা সুন্নাতের পুনরুজ্জীবনকারী উপাধিতে প্রসিদ্ধ। তিনি ছিলেন মুহাদ্দিস, শাফিঈ ফকীহ, মুফাসসির ও প্রচুর গ্রন্থের লেখক। তাঁর প্রসিদ্ধতম গ্রন্থ হচ্ছে “মাসাবিহুস সুন্নাহ”, যার ওপর নির্ভর করে উপমহাদেশের প্রসিদ্ধতম হাদিস গ্রন্থ “মিশকাতুল মাসাবিহ” রচিত হয়েছে। 

ইমাম আল বাগাউই [রাহ.] লিখেছেন, ولم يكن النبي صلى الله عليه وسلم ‌يستعيذ ‌بمخلوق ‌من ‌مخلوق

“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো কোনো মাখলুকের বিরুদ্ধে অপর কোনো মাখলুকের কাছে ইস্তিআযাহ বা আশ্রয় প্রার্থনা করেন নি (অর্থাৎ তিনি কেবল আল্লাহর কাছেই আশ্রয় চেয়েছেন)”।

আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইই ওয়া সাল্লামের জীবনে আমাদের জন্য রয়েছে উত্তম অনুসরণীয় আদর্শ। 

২৮) ইমাম ইবনু মুফলিহ [রাহ.]: ইমাম শামসুদ্দীন মুহাম্মাদ বিন মুফলিহ আল মাকদিসী আল হাম্বলী [রাহ.] ছিলেন হাম্বলী মাযহাবের প্রসিদ্ধ ইমাম ও উসূলবিদ। তাঁর রচিত “আল ফুরু”, “আল আদাবুশ শারঈয়্যাহ”- অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পাঠ্য। তিনি ৭৬৩ হিজরিতে মারা যান। 

তিনি লিখেছেন: 

‌لا ‌يخلق ‌القبور بالخلوق، والتزويق والتقبيل لها والطواف بها، والتوسل بهم إلى الله

“জাফরানের ও অন্যান্য সুগন্ধি দিয়ে কবরকে সুগন্ধিত করবে না। করবকে সুন্দর করে কারুকাজের মাধ্যমে সাজাবে না। করবে চুমু দেবে না এবং তাকে ঘিরে তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করবে না। আর আল্লাহর কাছে কবরওয়ালার মাধ্যমে তাওয়াসসুল তথা উসিলা পেশ করবে না”।

ইমাম ইবন মুফলিহ [রাহ.] ইস্তিগাসাহ, ইস্তিআনাহ ও ইস্তিআযারও পূর্ব ধাপ, তাওয়াসসুলকেই নিষেধ করে দিচ্ছেন। কেননা সাধারণত তাওয়াসসুলের মাধ্যমেই মৃতকেন্দ্রিক আমলের সূচনা ঘটে, পরে সেটা ইস্তিগাসাহ,ইস্তিআনাহ ও ইস্তিআযায় রূপ নেয়। এতে বোঝা যায় বাকি বিষয়গুলোও তাঁর কাছে বৈধ হবার কথা না। তাওয়াসসুল আমাদের এই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় নয়। এজন্য এ বিষয়ে আলোচনা দীর্ঘ করছি না।

২৯) কিওয়ামুস সুন্নাহ শাইখুল ইসলাম ইসমাঈল আল আসবাহানী [রাহ.]: শাইখুল ইসলাম ইসমাঈল বিন মুহাম্মাদ আল কুরাশী আত তামীমী আল আসবাহানীর [রাহ.] উপাধি ছিল কিওয়ামুস সুন্নাহ(قِوَام السُّنَّةِ) তথা সুন্নাতের অবলম্বন। তিনি ছিলে তাফসির, হাদিস ও আরবি ভাষার ইমাম। 

তিনি লিখেছেন, 

‌وَمن ‌أَسْمَائِهِ: ‌الْوَهَّاب: يهب الْعَافِيَة، وَلَا يقدر الْمَخْلُوق أَن يَهَبهَا ويهب الْقُوَّة وَلَا يقدر الْمَخْلُوق أَن يَهَبهَا، تَقول: يَا رب هَب لي الْعَافِيَة وَلَا تسْأَل مخلوقا ذَلِك، وَإِن سَأَلته لم يقدر عَلَيْهِ، وَتقول عِنْد ضعفك: يَا رب هَب لي قُوَّة، والمخلوق لَا يقدر عَلَى ذَلِك

“তাঁর সুন্দর নামসমূহের মাঝে একটি হচ্ছে ‘আল ওয়াহহাব’ অর্থাৎ মহান দাতা। তিনিই সুস্থতা-নিরাপত্তা দান করে থাকেন। কোনো মাখলুকের সামর্থ্য নেই যে সুস্থতা-নিরাপত্তা দেবে। তিনি শক্তি-সামর্থ্য দান করে থাকেন, কোনো মাখলুকের এই সামর্থ্য নেই যে শক্তি-সামর্থ্য দান করবে। কাজেই তুমি (দুআয়) বলবে, হে আমার রব, আমাকে আফিয়াত তথা সুস্থতা-নিরাপত্তা দান করুন। 

কোনো মাখলুকের কাছেই তুমি এগুলো চাইবে না। যদি তুমি চাও তারপরও তো মাখলুক তোমাকে এগুলো দেবার ক্ষমতা রাখে না। 

আর তোমার দুর্বল মুহূর্তে (দুআয়) বলবে, হে আমার রব, আমাকে শক্তি-সামর্থ্য দান করুন। কোনো মাখলুক এটা দিতে সক্ষম নয়”।

মাখলুকের কাছে কেন চাওয়া যাবে না, বা কেন মাখলুকের কাছে চেয়ে লাভ নেই, তা ইমাম ইসমাঈল [রাহ.] সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন। 

৩০) ইমাম আল মাযারী আল মালিকী [রাহ.]: ইমাম মুহাম্মাদ বিন আলী আত তামীমী আল মাযারী [রাহ.] ছিলেন প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস এবং মালিকী ফকীহ । 

সহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যা লিখতে গিয়ে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, দুআর সময় আল্লাহর দিকে মুতাওয়াজ্জুহ তথা আল্লাহ অভিমুখী হওয়া তাওহিদপন্থীদের বৈশিষ্ট্য, আর অন্য কারও অভিমুখী হওয়া কাফির-মুশরিকদের বৈশিষ্ট্য। তিনি লিখেছেন, 

‌من ‌علامات ‌الموحدين التوجه إلى السماء عند الدعاء وطلب الحوائج لأن العرب التي تعبد الأصنام تطلب حوائجها من الأصنام والعجم من النيران

“একত্ববাদীদের আলামত বা পরিচিতি হচ্ছে তাঁরা দুআ ও প্রয়োজন পূরণের আকাঙ্ক্ষার সময় আসমানের দিকে মুতাওয়াজ্জুহ হয়, কেননা যেসব আরবরা মূর্তিপূজা করতো তারা প্রয়োজনের পূরণে জন্য মূর্তির কাছেই কামনা করতো, আর আজমীরা (ইরানিরা) কামনা করতো প্রজ্বলিত অগ্নির কাছে”। 

কাজেই দুআ করতে, বা কিছু চাইতে আল্লাহর অভিমুখী হতে হবে, কোনো মাখলুকের অভিমুখী হওয়া যাবে না। 

৩১) আশ শাইখ আল আরিফ আব্দুল ক্বাদির জিলানী আল হাম্বলী [রাহ.]: ইমাম আব্দুল ক্বাদির বিন মূসা আল জিলানী [রাহ.] ছিলেন তাসাউফের সুমহান ইমাম ও কাদেরিয়া তরিকার প্রতিষ্ঠাতা। আমাদের অঞ্চলে তিনি বড় পীর,পীরানে পীর, গাউসুল আ’জম উপাধিতে প্রসিদ্ধ। এছাড়া তিনি ছিলেন হাম্বলী ফিকহের একজন বড় আলিম ও সমাজসংস্কারক। তাঁর মৃত্যু হয় ৫৬১ হিজরিতে। 

শাইখ জিলানীকে [রাহ.] কেন্দ্র করে কেবল আমাদের দেশেই নয় অন্যান্য অঞ্চলেও প্রচুর শির্কী কার্যক্রম গড়ে উঠেছে। মানুষ বিপদে পড়লে বলে ওঠে, ইয়া গাউসে পাক মাদাদ, ইয়া গাউসাল আ’জম মাদাদ ইত্যাদি। তাঁর মাধ্যমে ইস্তিগাসাহ, ইস্তিআনাহ, ইস্তিআযাহ ও ইস্তিমদাদ করা হয়। 

অথচ তিনি নিজে তাঁর মৃত্যু শয্যায় ওসিয়ত করে বলে গেছেন-

لا تخف أحداً ولا ترجه، وأوكل الحوائج كلها إلى الله، واطلبها منه، ولا تثق بأحد سوى الله عز وجل، ولا تعتمد إلا عليه سبحانه. التوحيد التوحيد التوحيد. وجماع الكل التوحيد

“কাউকে ভয় করো না, আর কারও কাছে কোনো কিছু প্রত্যাশা করো না। সকল প্রয়োজন পূরণের জন্য কেবল আল্লাহর ওপর নির্ভর কর আর তাঁর কাছেই চাও। আল্লাহ আযযা ওয়া জাল ব্যতীত আর কারও প্রতি আস্থা রেখো না। আর তিনি সুবহানাহ-ব্যতীত অন্য কারও ওপর নির্ভর করো না। তাওহিদ, তাওহিদ, তাওহিদ (কে আঁকড়ে ধর)। সকল (কল্যাণের) একত্রকারী হচ্ছে তাওহিদ”। 

তিনি আরও বলেন, 

ينبغي لكل مسلم موحد أن لا يتكل إلا على الله، ولا يستغيث إلا بالله، ولا يعتقد التصرف إلا لله

“প্রত্যেক একত্ববাদী মুসলিমের জন্য আবশ্যক হচ্ছে যে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও ওপর তাওয়াককুল বা নির্ভর করবে না। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও কাছে ইস্তিগাসাহ করবে না। আর আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ তাসাররুফ করতে পারে বা স্বাধীনভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারে- এটা বিশ্বাস করবে না”।

কী বিস্ময়কর পরিতাপের বিষয়, যিনি নিজেই এই জাতীয় শির্কের বিরুদ্ধে বলে গেলেন, ওয়াজ করে গেলেন, লিখে গেলেন, আজ খোদ তাঁকে কেন্দ্র করেই এই শির্কী কর্মকাণ্ড পৃথিবীর দিকে দিকে চলছে। এ যেন ইতিহাসের সেই বাস্তবতা, যারা তাওহিদের ঝাণ্ডা উত্থিত করে, যুগের মুশরিকরা শয়তানের প্ররোচনায় এক পর্যায়ে তাঁদের কেন্দ্র করেই শির্কের আখড়া গড়ে তোলে। ঈসা [আ.] তো এর সুপরিচিত উদাহরণ। 

৩২) ইমাম আবু হাইয়্যান আল উন্দুলুসী [রাহ.]:  ইমাম আসীরুদ্দীন মুহাম্মাদ বিন ইউসুফ ইবন হাইয়্যান আল গারনাতী [রাহ.] ছিলেন আরবি ভাষা, তাফসির , হাদিস ও জীবনীশাস্ত্রের মহান ইমাম। স্পেনের গ্রানাডায় জন্ম, মৃত্যু ৭৪৫ হিজরিতে মিসরের কায়রোয়। তাঁর জগদ্বিখ্যাত তাফসির হচ্ছে, “আল বাহরুল মুহীত ফিত তাফসির”। 

সূরা ইউনুসের ২২ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুশরিকদের অবস্থা বর্ণনা করেছে যে, তারা যখন সমুদ্রে ঝড়ের কবলে পড়ে তখন এভাবে দুআ করা:  دَعَوُا اللّٰهَ مُخۡلِصِیۡنَ لَهُ الدِّیۡنَ

“তখন তারা বিশুদ্ধ আনুগত্যে আল্লাহকেই ডেকে বলে…” 

এর ব্যাখ্যা ইমাম আবু হাইয়্যাহ [রাহ.] লিখেছেন, 

‌ومعنى ‌الإخلاص ‌إفراده ‌بالدعاء من غير إشراك أصنام ولا غيرها، قال معناه: ابن عباس وابن زيد

“আর এখানে ইখলাস অর্থ হচ্ছে কোনো মূর্তি বা অন্য কাউকে বা কিছুকে শরীক না করে এককভাবে আল্লাহর কাছে দুআ করা। এই অর্থ ইবন আব্বাস [রা.] ও ও ইবন যাইদ [রাহ.] করেছেন”।

তাহলে বোঝা গেল যে ইখলাসের সাথে দুআ তখনই হবে যখন তাতে আল্লাহর সাথে অন্য কেউ শরীক হবে না। আর এটাও বোঝা গেল যে, দুআতে আল্লাহর সাথে অন্য কারও অনুপ্রবেশ করালে, অন্য কাউকে উদ্দেশ্য করে ইস্তিগাসাহ-ইস্তিআনাহ-ইস্তিআযাহ করলে সেটা শির্ক হবে। 

৩৩) ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম [রাহ.]: ইমাম আবু আব্দিল্লাহ শামসুদ্দীন মুহাম্মাদ বিন আবি বাকর আদ দিমাশকী আল হাম্বলী [রাহ.], তিনি ইবনু কাইয়্যিমিল জাওযিয়্যাহ বা ইবনুল কায়্যিম নামেই প্রসিদ্ধ। শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়ার [রাহ.] খাস ছাত্র ছিলেন, ছিলেন আকিদাহ, ফিকহ, উসূল, হাদিস, সীরাত ও তাসাউফের ইমাম। বিপুল পরিমাণ প্রসিদ্ধ গ্রন্থের রচয়িতা। তিনি ৭৫১ হিজরিতে মারা যান। 

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম [রাহ.] ইস্তিগাসাহ ও এ সংক্রান্ত অন্যান্য শির্ক নিয়ে প্রচুর লিখেছেন। তাসাউফ শাস্ত্রে তাঁর একটি কালজয়ী গ্রন্থ হচ্ছে “মাদারিজুস সালিহীন”। এই গ্রন্থেও তিনি এ জাতীয় শির্ক সম্পর্কে সচেতন করেছেন। তিনি শির্কের প্রকার সম্পর্কে লিখতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন, 

ومن أنواعه: ‌طلبُ ‌الحوائج ‌من ‌الموتى، والاستغاثةُ بهم، والتّوجُّهُ إليهم. وهذا أصلُ شرك العالم، فإنَّ الميِّتَ قد انقطع عملُه، وهو لا يملك لنفسه نفعًا ولا ضرًّا

“এর প্রকারসমূহের মাঝে রয়েছে, মৃতদের কাছে হাজত বা প্রয়োজন পূরণের কামনা করা, তাদের মাধ্যমে ইস্তিগাসাহ করা, তাদের দিকে তাওয়াজ্জুহ দেয়া বা তাদের অভিমুখী হওয়া। এগুলো হচ্ছে জাগতিক শির্কের মূল। কেননা মৃতের তো আমল ইতোমধ্যেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। সে তার নিজের জন্যও ভালো বা মন্দ করার কোনো ক্ষমতাই রাখে না”।

অন্য রচনায় তিনি এসব কবরবাসী-যাদেরকে উদ্দেশ্য করে দুআ, ইস্তিগাসাহ, ইস্তিআনাহ ও ইস্তিআযাহ করা হচ্ছে সেগুলো তাগুত হিসেবে অভিহিত করেছেন, আর যারা এসব কাজ করছে তাদের কর্মকে মুশরিকদের কর্ম হিসেবে অভিহিত করেছেন। 

৩৪) ইমাম ইবন কাসির [রাহ.]: ইমাম আবুল ফিদা ইমাদুদ্দীন ইসমাঈল ইবন উমার বিন কাসির আদ দিমাশকী [রাহ.] ছিলেন তাফসির, ইতিহাস, হাদিসশাস্ত্র ও শাফিঈ ফিকহের ইমাম, ছিলেন হাফিযে হাদিস। তিনি ৭৭৪ হিজরিতে মারা যান। 

তাঁর রচিত তাফসির “তাফসিরুল কুরআনিল আযীম” ও ইতিহাস গ্রন্থ, “আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়া”- উভয়টির অনুবাদ বাংলা ভাষায় সুপ্রাপ্য। 

তিনি স্বীয় ইতিহাস গ্রন্থে ‘সায়্যিদাহ নাফিসাহ [রাহ.]’ এর মাজার প্রসঙ্গে আলোচনায় লিখেছেন, 

وأصل عبادة الأصنام من المغالاة في القبور وأصحابها، وقد أمر النبي صلى الله عليه وسلم بتسوية القبور وطمسها. والمغالاة في البشر حرام. ومن زعم…  

أنها تنفع أو تضر بغير مشيئة الله فهو مشرك

“মূর্তি পূজার মূল উৎস হচ্ছে কবর ও কবরওয়ালাদের নিয়ে বাড়াবাড়ি। এজন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবরকে সমান করে দিতে ও নিশ্চিহ্ন করে দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। মানুষের ব্যাপারে অতিরঞ্জন হারাম… আর যে এই ধারণা করবে যে তিনি (সায়্যিসাহ নাফিসাহ) আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়াই উপকার বা অপকার করতে সক্ষম, সে মুশরিক”।

তিনি স্বীয় তাফসিরেও শির্ককের বিভিন্ন ধরণ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন। ইবাদাতের শির্কের পাশাপাশি দুআর শির্ক নিয়েও তিনি আলোচনা করেছেন। যেমন সূরা গাফিরে আল্লাহ তাআলা বলেন: 

 فَادۡعُوا اللّٰهَ مُخۡلِصِیۡنَ لَهُ الدِّیۡنَ وَ لَوۡ کَرِهَ الۡکٰفِرُوۡنَ

“সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ডাক তাঁর আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে। যদিও কাফিররা অপছন্দ করে”।

এই আয়াতের তাফসিরে তিনি লিখেছেন, 

أي ‌فأخلصوا ‌لله ‌وحده ‌العبادة ‌والدعاء وخالفوا المشركين في مسلكهم ومذهبهم

“অর্থাৎ ইবাদাত ও দুআয় কেবল আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ হও (বা একনিষ্ঠ হয়ে কেবল আল্লাহর ইবাদাত কর আর তাঁর কাছেই দুআ কর)। আর (এভাবে) মুশরিকদের কর্মপন্থা ও ধর্মের বিরোধিতা কর”।

৩৫) ইমাম ইবন আবিল ইয আল হানাফী [রাহ.]: ইমাম আলী ইবন আলী ইবন আবিল ইয আল হানাফী আদ দিমাশকী [রাহ.] ছিলেন হানাফী ফকীহ, আকিদার ইমাম এবং দামেস্ক ও মিসরের প্রধান বিচারপতি। তিনি ৭৯২ হিজরিতে মারা যান। 

আকিদাহ বিষয়ক তাঁর কালজয়ী গ্রন্থ হচ্ছে, “শারহুল আক্বীদাতিত তাহাউইয়্যাহ”। 

এই গ্রন্থে আকিদার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে শির্ক নিয়ে তিনি অনেক আলোচনা করেছেন। শির্কের উৎস সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে কুরআনের বিভিন্ন আয়াত উদ্ধৃত করে তিনি এক পর্যায়ে লিখেছেন, 

ولم يكونوا يعتقدون في الأصنام أنها مشاركة لله في خلق العالم، بل كان حالهم فيها كحال أمثالهم من مشركي الأمم من الهند والترك والبربر وغيرهم، تارة يعتقدون أن هذه تماثيل قوم صالحين من الأنبياء والصالحين، ويتخذونهم شفعاء، ويتوسلون بهم إلى الله، وهذا كان أصل شرك العرب

“এসব মুশরিকরা এটা বিশ্বাস করতো না যে দুনিয়ার সৃষ্টিতে তাদের উপাস্য দেবমূর্তীগুলো আল্লাহর কার্যে শরীক ছিল। তাদের অবস্থা অনুরূপ অন্যান্য জাতির মুশরিকদের মতই ছিল যেমন: ভারত, তুর্ক, বারবার ও অন্যান্যরা। তারা কখনো এমন বিশ্বাস করতো যে এসব মূর্তির দেবতারা আসলে নবী ও নেককারদের মধ্যকার কোনো নেককার ব্যক্তিবর্গ ছিল। আমরা তাদেরকে সুপারিশকারী হিসেবে গ্রহণ করেছি মাত্র। তাদের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর কাছে উসিলা তালাশ করি।– আর এটাই ছিল আরবের শির্কের মূল কারণ”।

অতঃপর তিনি আলোচনা করে দেখিয়েছেন যে, এজন্য শির্কের বাহনকে পূর্বাহ্নেই ধ্বংস করে দেবার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবরসমূহকে নিশ্চিহ্ন করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে বলেছেন। 

৩৬) ইমাম সা’দুদ্দীন আত তাফতাযানী [রাহ.]: ইমাম মাসঊদ বিন উমার সা’দুদ্দীন আত তাফতাযানী [রাহ.] ছিলেন নাহু, সারফ, মা’আনী, বায়ান, মানতিক, ইলমুল কালাম ও ফিকহের ইমাম। শাফিঈ ও হানাফী উভয় ফিকহেই তিনি ব্যাপক জ্ঞান রাখতেন। দুই মাযহাবেই ফাতাওয়া দিতেন। তিনি নিজের ব্যাপারে বলেছেন, আমি উসূলের দিক দিয়ে হানাফী,আর ফুরুর দিক দিয়ে শাফিঈ। তিনি ৭৯৩ হিজরিতে মারা যান। 

উনার লেখা “শরহুল আকাইদ” আমাদের দেশের মাদ্রাসাসমূহে আকিদার অবশ্যপাঠ্য হিসেবে বিবেচিত। 

মুশরিকরা কিভাবে শির্কে পতিত হল তার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, 

لما مات منهم من هو كامل المرتبة عند الله تعالى اتخذوا تمثالا على صورته وعظموه تشفعا إلى الله تعالى وتوسلا

“যখন তাদের মধ্যে এমন কেউ মারা যেত যে আল্লাহ তাআলার কাছে উচ্চমর্যাদার অধিকারী, তখন তারা আল্লাহ তাআলার কাছে সুপারিশ করার জন্য এবং তাঁর কাছে পৌঁছার মাধ্যম হিসেবে সেই ব্যক্তির সুরতে মূর্তি বানাতো এবং সেই মূর্তিকে সম্মান করতো”।

তিনিও অন্যান্য ইমামদের মত এই বিষয়টা স্পষ্ট করছেন যে, মূলত আল্লাহ তাআলার কাছে নৈকট্য পাবার আশায়, সুপারিশের আশায় মানুষ নেককার ব্যক্তিদের অতিভক্তি করে বসে, যা শেষতক শির্কে রূপ নেয়। কাজেই একে শুরুতেই থামিয়ে দেয়া আবশ্যক। কেউ যদি মনে করে আমি তো অমুক পীরকে এজন্য কষ্টের সময় ডাকি যেন তিনি আল্লাহর কাছে সুপারিশ করে আমার কষ্ট দূর করে দেন, কিংবা আল্লাহর কাছে তার এমন মর্তবা যে সুপারিশও করা লাগবে না, তাঁর নাম ধরে ডাকলেই আল্লাহ তাআলা কষ্ট দূর করে দেবেন, তাহলে এই ব্যক্তি মূলত মুশরিকদের এসকল বিশ্বাসকেই ধারণ করে চলেছে। 

৩৭) ইমাম ইবন রাজাব হাম্বলী [রাহ.]: ইমাম আব্দুর রাহমান বিন আহমাদ বিন রাজাব আল হাম্বলী আদ দিমাশকী [রাহ.] ছিলেন হাম্বলী ফিকহের প্রসিদ্ধ ইমাম, হাফিযে হাদিস, হাদিস শাত্রজ্ঞ, ঐতিহাসিক এবং হাদিসের প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যাকার। তিনি ৭৯৫ হিজরিতে মারা যান। 

তিনি লিখেছেন, 

إنّ قول العبد: لا إله إلا الله يقتضي أن لا إله له غير الله، والإله هو الذي يُطاعٍ فلا يعصى هيبة له وإجلالاً ومحبة وخوفاً ورجاءً، وتوكلاً عليه وسؤالا منه ودعاء له، ولا يصلح ذلك كله إلا لله عز وجل.

فمن أشرك مخلوقاً في شيء من هذه الأمور التي هي من خصائص الإلهية كان ذلك قدحاً في إخلاصه في قول لا إله إلا الله، ونقصاً في توحيده، وكان فيه من عبودية المخلوق بحسب ما فيه من ذلك، وهذا كله من فروع الشرك

“বান্দা যখন বলে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, তখন এই কালিমা দাবি করে যে আল্লাহ ব্যতীত ব্যক্তির আর কোনো ইলাহ থাকবে না। আর ‘ইলাহ’ হচ্ছে সেই সত্ত্বা যার আনুগত্য মেনে নেয়া হয় বা বশ্যতা স্বীকার করা হয়; তাঁর ভয়-ভক্তিতে, তাঁর সম্মানে, ভালোবাসায়, শঙ্কায় ও আশায় তাঁর অবাধ্যতা করা থেকে বিরত থাকা হয়। তাঁর ওপর তাওয়াক্কুল করা হয় বা নির্ভর করা হয়, তাঁর কাছেই চাওয়া হয়, তাঁর কাছেই দুআ করা হয়। আর এসব কাজের কোনোটাই আল্লাহ আযযা ওয়া জালের পরিবর্তে অন্য কারও জন্য করা সঠিক নয়।

আল্লাহ তাআলার উলুহিয়্যাহ বা ইলাহ হবার গুণের সাথে সম্পৃক্ত এসব বিশেষ বা খাস বৈশিষ্ট্য বা কর্মের কোনোটাতে যদি কেউ কোনো মাখলুককে শরীক করে তাহলে সেটা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলার ক্ষেত্রে তার ইখলাসকে নিন্দিত করবে, তার তাওহিদের লোকসান ঘটাবে। 

এরকম যতটা করা হবে সে অনুপাতে তাতে মাখলুকের বন্দেগী যুক্ত হবে। আর এসবই শির্কের শাখা”। 

৩৮) ইমাম তাকিউদ্দীন আল মাক্বরিযী আশ শাফিঈ [রাহ.]: ইমাম আবুল আব্বাস আহমাদ বিন আলী আল হুসাইনী আল মাকরিযী [রাহ.] ছিলেন শাফিঈ মাযহাবের আলিম এবং মিসরের প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক। ৮৪৫ হিজরিতে মারা যান। 

তিনি উলুহিয়্যাতের শির্ক নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন, 

فالشرك في الإلهيّة والعبادة: هو الغالب على أهل الإشراك، وهو شرك عبّاد الأصنام، وعبّاد الملائكة، وعبّاد الجّن، وعبّاد المشايخ والصالحين الأحياء والأموات، الذين قالوا: {مَا نَعْبُدُهُمْ إِلاّ لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللَّهِ زُلْفَى}

“উলুহিয়্যাত তথা আল্লাহ তাআলার ইলাহ হওয়ার ক্ষেত্রে একত্ব এবং ইবাদাতের শির্ক: শির্ককারীদের মধ্যে এই ধরণের শির্কই প্রবল। এই শির্ক হচ্ছে মূর্তিপূজক, ফেরেশতাপূজারী, জ্বিনপূজারী, পীরপূজারী এবং জীবিত-মৃত নেককারদের পূজারীদের শির্ক। (কুরআনে আছে যে) তারা বলে- 

‘আমরা তো এদের ইবাদত এ জন্যে করি যে, এরা আমাদেরকে পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর সান্নিধ্যে এনে দেবে’”।

এর মাধ্যমে তিনি পীরপূজারী ও নেককার ব্যক্তিদের পূজাকারীদের বিষয়টা জোড়ালোভাবে উল্লেখ করে তাদের শির্কের অপনোদন করেছেন। 

তিনি আরও বলেন, 

‌فمن ‌اتخذ ‌واسطةً ‌بينه ‌وبين ‌الله – تعالى – فقد ظنّ به أقبح الظن، ومستحيل أن يشرعه لعباده، بل ذلك يمتنع في العقول والفطر

“যে নিজের ও আল্লাহ তাআলার মাধ্যে মধ্যস্থতাকারী স্থির করে নেয়, সে আল্লাহর ব্যাপারে অত্যন্ত নিকৃষ্ট ধারণা করে। আল্লাহ বান্দার জন্য এমন বিধান দান করবেন তা একদম অসম্ভব; বরং বিশুদ্ধ আকল ও ফিতরাতও এটাকে নাকচ করে থাকে”।

وبالجملة فما قدّر الله حقّ قدره من عبد معه من ظنّ أنه يوصل إليه

“এক কথায় বলা চলে, যারা আল্লাহর সাথে অন্য কারও ইবাদাত এজন্য করে যেন সেই সত্ত্বা তাকে আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছে দেয়, সে আসলে আল্লাহ তাআলাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারেনি”। 

তিনি আরও লিখেছেন, 

زيارة القبور – على ثلاثة أقسام:

قوم يزورون الموتى فيدعون لهم. وهذه هي الزّيارة الشرعيّة.

وقوم يزورونهم يدعون بهم، فهؤلاء هم المشركون في الألوهيّة والمحبّة.

وقوم يزورونهم فيدعونهم أنفسهم، وقد قال النبي صلى الله عليه وآله وسلم: “اللهم لا تجعل قبري وثنا يعبد”، وهؤلاء هم المشركون في الربوبيّة

“কবর যিয়ারাতকারী ৩ প্রকার:

১) যারা কবর যিয়ারত করে সেখানকার মৃতদের জন্য দুআ করে। এটা হচ্ছে শরীআতসম্মত যিয়ারত।

২) যারা কবর যিয়ারত করে কবরওয়ালাদের মাধ্যমে (বা উসিলায় বা তাদের দিয়ে) দুআ করাতে চায়। এরা হচ্ছে উলুহিয়্যাহ বা ইলাহ হিসেবে আল্লাহর একত্ব ও মুহাব্বতের এক্ষেত্রে আল্লাহর একত্বে শির্ককারী মুশরিক।

৩) যারা কবর যিয়ারত করে খোদ কবরওয়ালার কাছেই দুআ করে। আর (এজন্যই) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুআ করেছিলেন, 

‘হে আল্লাহ, আমার কবরকে পূজিত প্রতিমায় পরিণত হতে দেবেন না’, আর এরা সব হচ্ছে আল্লাহর রুবুবিয়্যাহ তথা আল্লাহ যে রব হিসেবে একক, সেই তাওহিদে শির্ককারী”।

এই বক্তব্যের মাধ্যমে কবরকেন্দ্রিক সকল শির্কেরই বিরোধিতা করা হয়েছে, আর দেখিয়ে দেয়া হয়েছে যে এগুলো কোনো না কোনোভাবে শির্ক হয়-ই, হয় উলুহিয়্যাতে শির্ক, নয় রুবুবিয়্যাতে শির্ক। 

তিনি তাঁর অপর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ المواعظ والاعتبار بذكر الخطط والآثار-এও উপযুক্ত স্থানে এ ধরণের শির্কের বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান নিয়েছেন। 

৩৯) ইমামে রব্বানী মুজাদ্দিদে আলফেসানী [রাহ.]: ইমাম আহমাদ ফারুক আস সিরহিন্দী [রাহ.] ভারতীয় উপমহাদেশের একজন মহান সংস্কারক ব্যক্তিত্ব। মুঘল সম্রাট আকবরের সময় দ্বীন-এ ইলাহী নামক নতুন ধর্ম প্রবর্তনকালে তিনি এর বিরুদ্ধে তীব্র বিরোধিতা করেন। এছাড়া এই অঞ্চলে তাসাউফের নামে যেসব শির্ক ও কুফর প্রচলিত ছিল, তিনি সেগুলোর অনেকগুলোর সংস্কার সাধন করেন মানুষ দ্বীনকে বিশুদ্ধ করতে চেষ্টা করেছেন। তিনি নকশবন্দী তরিকার একটি শাখা মুজাদ্দেদিয়ার প্রতিষ্ঠাতা। ইমামে রব্বানী হিসেবে খ্যাত। এছাড়া তাঁকে দ্বিতীয় হিজরি সহস্রাব্দের মুজাদ্দিদ মনে করে মুজাদ্দিদে আলফে সানী খেতাবেও ভূষিত করা হয়। 

মুজাদ্দিদে আলফেসানী [রাহ.] বিভিন্ন ব্যক্তিকে প্রচুর চিঠিপত্র লিখেছেন যার মধ্যে শির্ক সম্পর্কে অনেকবারই সতর্ক করেছেন। তাঁর চিঠিপত্রের সঙ্কলন “মাকতুবাত শরীফ” আরবিতে “আল মাকতুবাতুর রাব্বানিয়্যাহ” নামে অনূদিত হয়েছে, যা লেবাননের দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ ৩ খণ্ডে প্রকাশ করেছে। 

এই সংকলনের ৪৫৩নং পত্রটি তিনি কোনো এক নেককার নারীর উদ্দেশ্যে লিখেছেন। সেকালে নারীদের মাঝে পীর ও কবরকেন্দ্রিক বিভিন্ন শির্কী বিশ্বাস প্রচলিত ছিল, তিনি এগুলোর খণ্ডন করেন। হিন্দু নারীদের সংস্পর্শে আসার ফলে মুসলিম নারীরা তাদের কিছু বিশ্বাস ও আচারকে গ্রহণ করেছিল, তিনি সেগুলোরও খণ্ডন করেন। 

তিনি লিখেছেন, 

وَاسْتَمْدَادٌ مِنَ الأَصْنَامِ وَالطَّاغُوتِ فِي دَفْعِ الأَمْرَاضِ وَالْأَسْقَامِ كَمَا هُوَ شَائِعٌ فِيمَا بَيْنَ جَهَلَةِ أَهْل الإِسْلامِ عَيْنُ الشِّرْكِ وَالضَّلَالَةِ وَطَلَبُ الْحَوَائِجِ مِنَ الْأَحْجَارِ الْمَنْحُوتَةِ نَفْسُ الكُفْر وَإِنْكَارُ 

 عَلَى وَاحِبِ الوُجُودِ تَعَالَى وَتَقَدَّسَ قَالَ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى شِكَايَةً ِ عَنْ حَالِهِ بَعْضَ أَهْل الضَّلالَ يُرِيدُونَ أَنْ يَتَحَاكَمُوا إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدِ أُمِرُوا أَنْ

يَكْفُرُوا بِهِ وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُضِلُّهُمْ ضَلَالًا بَعِيدًا }

“বিভিন্ন রোগ ও পীড়া থেকে আরোগ্য লাভের জন্য বিভিন্ন মূর্তি ও তাগুতের কাছে সাহায্য চাওয়ার (ইস্তিমদাদ) যে অভ্যাস ইসলামের দাবিদার জনগোষ্ঠীর মাঝে ব্যাপক প্রসারিত হয়েছে, তা নিছক শির্ক ও গোমরাহী। আর পাথরে খোদিত মূর্তির কাছে প্রয়োজন পূরণের কামনা করা তো কুফর এবং মহা পবিত্র ওয়াজিবুল উজুদ (আবশ্যকীয় সত্ত্বা) তাআলার সত্ত্বার অস্বীকার। কতিপয় গোমরাহ গোষ্ঠীর ব্যাপারে অভিযোগ করে আল্লাহ তাবারাক ওয়া তাআলা বলেন-

‘তারা তাগূতের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে চায়, যদিও সেটাকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর শয়তান তাদেরকে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট করতে চায়’”।

সেসময় নারীরা মাজারে শায়িত বুযুর্গদের উদ্দেশ্যে সিয়াম পালন করে এর মাধ্যকে নিজেদের হাজত পূরণের কামনা করতো। এই প্রথাকে খণ্ডন করে তিনি লিখেছেন, 

ويطلبن حوائجهن منهم بواسطة تلك الصيام، ويزعمن قضاء حوائجهن منهم، وهذا الفعل إشراك للغير في عبادة الله تعالى وطلب لقضاء الحوائج من الغير بواسطة العبادة إليه

“এসব সিয়াম পালনের মাধ্যমে তারা কবরওয়ালার কাছ থেকে নিজেদের প্রয়োজনসমূহ পূরণের কামনা করে থাকে। এই ধরণের কাজ আল্লাহ তাআলার ইবাদাতে অপরকে শরীক করার শামিল, এবং অপর কারও ইবাদাত করার মাধ্যমে সেই সত্ত্বাকে দিয়ে প্রয়োজন পূরণের চেষ্টা করানোর অন্তর্ভুক্ত”। 

তাঁর বক্তব্য থেকে বোঝা গেল যে, আল্লাহ ব্যতীত অপর কাউকে সন্তুষ্ট করে তার মাধ্যমে নিজের প্রয়োজন পূরণের এই সব কর্মকাণ্ড মূলত শির্ক এবং এক ধরণের ইবাদাত। দুঃখের বিষয় হল ইমামে রব্বানীর [রাহ.] অনুসরণের দাবিদারদের মধ্যে এই শির্কের আজ ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। 

৪০) ইমাম সুনআল্লাহ আল হালবী [রাহ.]: ইমাম সুনআল্লাহ বিন সুনআল্লাহ আল হালবী [রাহ.] ছিলেন সিরিয়ার প্রখ্যাত হানাফী ফকীহ, ওয়াইয, মুহাদ্দিস ও আরবি সাহিত্যিক। তিনি ১১২০ হিজরিতে মারা যান। সমকালীন শির্ক, কুফর ও বিদআতের বিরুদ্ধে কঠোর ছিলেন। আউলিয়া কিরামের নামে যেসব শির্ক, কুফর, বিদআত ও কুসংস্কার প্রচলিত হয়েছিল, সেগুলো রদ করে তিনি লিখেছেন, “সাইফুল্লাহ আলা মান কাযাবা আলা আউলিয়াইল্লাহ” নামক গ্রন্থ। 

তিনি সমকালীন লোকদের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, 

وإنه قد ظهر الآن فيما بين المسلمين جماعات يدعون أنّ للأولياء تصرفات في حياتهم وبعد الممات، ويستغاث بهم في الشدائد والبليات، وبهممهم تنكشف المهمات، فيأتون قبورهم وينادونهم في قضاء الحاجات، مستدلين على أن ذلك منهم كرامات

“বর্তমানে মুসলিমদের মধ্যে এমন অবস্থা প্রকাশিত হয়েছে যে, একদল লোক দাবি করছে যে আউলিয়ারা জীবিত কিংবা মৃত উভয় অবস্থায় বিভিন্ন কাজে তাসাররুফ বা হস্তক্ষেপ করতে পারে। কঠিন পরিস্থিতিতে ও বালা-মুসিবতে তাদের মাধ্যমে ইস্তিগাসাহ করতে হয়। তাদের প্রভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদির সমাধা হয়। তাই তারা আউলিয়াদের কবরের কাছে আসে, নিজেদের প্রয়োজন পূরণের জন্য তাদের কাছে আহ্বান করে। তারা এই কাজের স্বপক্ষে যুক্তি হিসেবে বলে যে এগুলো হচ্ছে আউলিয়াদের কারামাত!”

এরপর তিনি লিখেছেন, 

والاستغاثة تجوز في الأسباب الظاهرة العادية من الأمور الحسية في قتال أو إدراك عدو أو سبع ونحوه، كقولهم: يالزيد! يالقومي! ياللمسلمين! كما ذكروا ذلك في كتب النحو بحسب الأسباب الظاهرة بالفعل.

أما الاستغاثة بالقوة والتأثير، أو في الأمور المعنوية من الشدائد كالمرض وخوف الغرق والضيق والفقر وطلب الرزق ونحوه فمن خصائص الله، فلا يُذكر فيها غيره، قال جل ذكره: {وَإِذَا مَسَّكُمُ الْضُّرُّ فِي الْبَحْرِ ضَلَّ مَن تَدْعُونَ إِلَاّ إِيَّاهُ} فنفى دعاء غيره، فتعين انفراده به

“প্রকাশ্য, স্বাভাবিক, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ে ইস্তিগাসাহ জায়েয, যেমন যুদ্ধে বা দুশমনকে দেখার পর বা কোনো হিংস্র জন্তু দেখার পর কেউ যদি বলে, ইয়া যাইদ, হে আমার জাতি, হে মুসলিমেরা (আমাকে সাহায্য কর- তখন ইস্তিগাসাহ জায়েয), যেমনটা নাহু বা আরবি ব্যাকরণের গ্রন্থসমূহে ক্রিয়ার মাধ্যমে বাহ্যিক আসবাব গ্রহণ বিষয়ে লেখা হয়েছে।

আর বিভিন্ন আধ্যাত্মিক বিষয়ে যেমন প্রচণ্ড অসুস্থতা, ভীতি, পানিতে ডুবে যাওয়া, সংকীর্ণতা, দারিদ্র্য, রিযক অন্বেষণ বা এরকম বিষয়ে শক্তি-সামর্থ্য ও সহায়তা চেয়ে ইস্তিগাসাহ করাটা কেবল আল্লাহর সাথেই সম্পৃক্ত হতে পারে। এরকম ক্ষেত্রে আল্লাহর পরিবর্তে অপর কাউকে উল্লেখ  করা যাবে না। যেমনটা আল্লাহ জাল্লা যিকরুহ বলেন-‘আর যখন তোমাদেরকে সমুদ্রে বিপদ স্পর্শ করে, তখন তিনি ছাড়া যাদেরকে তোমরা ডাক, তারা (তোমাদের মন থেকে) হারিয়ে যায়’, কাজেই এতে অপর কাউকে আহ্বান করার বিষয়টিকে বাতিল করে দেয়া হয়েছে, আর এককভাবে কেবল আল্লাহকেই দুআর জন্য সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে”। 

তিনি আরও লিখেছেন, 

فمن اعتقد أنّ لغير الله من نبي أو ولي أو روح، أو غير ذلك في كشف كربة، وقضاء حاجة تأثيراً، فقد وقع في وادي جهل خطير، فهو على شفا حفرة من السعير

“যে এই বিশ্বাস করে যে আল্লাহ ব্যতীত কোনো নবী, বা ওলী, বা রূহ, বা অন্য কেউ বা কিছু দুঃখ-কষ্ট দূর করতে পারে, প্রভাব বিস্তার করে প্রয়োজন পূরণ করতে পারে, সে আসলে অজ্ঞতার বিপজ্জনক উপত্যকায় এসে উপস্থিত হয়েছে। সে জাহান্নামের গর্তের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে”।

৪১) ইমাম আমীর আস সানআনী [রাহ.]: ইমাম আমীর মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল আস সানআনী [রাহ.] ছিলেন ইয়ামানের প্রসিদ্ধ আলিম ও সমকালীন যুগের মুজতাহিদ। ইসলামের সকল শাস্ত্রেই ছিল তাঁর বলিষ্ঠ পদচারণা। তিনি ১১৮২ হিজরিতে মারা যান।

তিনি লিখেছেন, 

فإفرادُ الله تعالى بتوحيد العبادة لا يتِمُّ إلَاّ بأن يكونَ الدعاءُ كلُّه له، والنداءُ في الشدائد والرخاء لا يكون إلَاّ لله وحده، والاستغاثة والاستعانةُ بالله وحده، واللّجوء إلى الله والنذر والنحر له تعالى، وجميع أنواع العبادات من الخضوع والقيام تذلُّلاً لله تعالى، والركوع والسجود والطواف والتجرد عن الثياب والحلق والتقصير كلُّه لا يكون إلَاّ لله عز وجل 

ومَن فعل شيئاً مِن ذلك لمخلوق حيٍّ أو ميت أو جماد أو غيره، فقد أشرك في العبادة

“ইবাদাতকেন্দ্রিক তাওহিদের ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলাকে একক উপযুক্ত সত্ত্বা হিসেবে গ্রহণ করার দাবি ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণতা পাবে না, যতক্ষণনা সকল দুআও কেবল আল্লাহর কাছেই করা হবে, যতক্ষণনা প্রচণ্ড দুঃখ-কষ্ট কিংবা স্বাচ্ছন্দ্যের কালে নিদা তথা আহ্বান কেবল আল্লাহর কাছেই করা হবে, যতক্ষণনা ইস্তিগাসাহ ও ইস্তিআনাহ কেবল আল্লাহর কাছেই করা হবে, যতক্ষণনা আশ্রয় নেয়া হচ্ছে কেবল আল্লাহর-ই কাছে, আর তাঁর জন্যই মানত করা হচ্ছে, জবাই বা কুরবানি কেবল আল্লাহর তাআলার জন্যই করা হচ্ছে; যতক্ষণনা বিনয়াবত ও দণ্ডায়মান হয়ে করা হয় এমন সকল প্রকার ইবাদাত অবনত হয়ে কেবল আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্যেই করা হচ্ছে; যতক্ষণনা রুকু, সিজদা, তাওয়াফ, দুনিয়াবী কাপড় মুক্ত হয়ে ইহরামের কাপড় ধারণ, মাথামুণ্ডন, চুল ছাঁটা এসব কিছুই একমাত্র আল্লাহ আযযা ওয়া জাল-এর জন্য হচ্ছে। 

এই আমলগুলোর কোনোটাও যদি জীবিত বা মৃত কোনো মাখলুক বা কোনো জড় পদার্থ, বা অন্য কোনো কিছুর জন্য কেউ করে, তাহলে সে ইবাদাতে শির্ক করলো”।

তাঁর কথা থেকে এটা সুস্পষ্ট যে আল্লাহ ব্যতীত অপর কারও কাছে ইস্তিগাসাহ ও ইস্তিআনাহ করাকে তিনি ইবাদাতে শির্ক মনে করেন। 

যেসব সত্ত্বার উদ্দেশ্যে এসব আমল করা হচ্ছে তাদেরকে বিধান সম্পর্কে তিনি এরপর লিখেছেন, 

وصار مَن تُفعل له هذه الأمور إلَهاً لعابديه، سواءٌ كان مَلَكاً أو نبيًّا أو وليًّا أو شجراً أو قبراً أو جنيًّا أو حيًّا أو ميتاً

“যার উদ্দেশ্যে এসব আমল করা হয়েছে সেই সত্ত্বা তার এসব ইবাদাতকারীর জন্য ‘ইলাহে’ পরিণত হয়েছে, তা তিনি কোনো ফেরেশতা হোন, বা নবী হোন, বা ওলী হোন, বা তা কোনো গাছ হোক, বা কবর হোক, বা জ্বীন হোক, জীবিত হোক বা মৃত হোক”।

আর যারা এই ইবাদাত করছে তাদের বিধান সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, 

وصار العابدُ بهذه العبادة أو بأيِّ نوع منها عابداً لذلك المخلوق مشركاً بالله، وإن أقَرَّ بالله وعَبَدَه

“এসব ইবাদাত যারা করছে বা এসব ইবাদাতের যে কোনো একটাও যারা করছে তারা আসলে এর মাধ্যমে ঐ মাখলুকের ইবাদাতকারীতে পরিণত হয়েছে, আর আল্লাহকে মানার ও তাঁর ইবাদাত করার পরও এই ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শির্ককারীতে পরিণত হয়েছে”। 

৪২) ইমাম মুরতাদ্বা আয যাবিদী [রাহ.]: ইমাম মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ মুরতাদ্বা আয যাবিদী আরবি ভাষা, হাদিস, ইলমে রিজাল ও বংশলতিকা বিশেষজ্ঞ। তিনি ইয়ামানের যুবাইদ গোত্রের লোক হলেও তাঁর জন্ম ভারতের বিলগ্রামে, যা আধুনিক উত্তর প্রদেশের অংশ। তিনি একসময় হিজাজ হয়ে মিসরে বসতী স্থাপন করেন। ১২০৫ হিজরিতে মিসরেই মহামারিতে মারা যান। তাঁর অন্যতম প্রসিদ্ধ কর্ম হচ্ছে “ইহইয়াউ উলুমিদ্দীনের” ব্যাখ্যা “ইতহাফু সাদাতিল মুত্তাকীন”। 

ইমাম যাবিদী [রাহ.] লিখেছেন, 

وقبيح بذوي الإيمان أن يُنزلوا حاجتهم بغير الله تعالى مع علمهم بوحدانيته وانفراده بربوبيته، وهم يسمعون قوله تعالى {أَلَيْسَ اللَّهُ بِكَافٍ عَبْدَهُ}

“ঈমানওয়ালা কারও জন্য এটা অত্যন্ত নিকৃষ্ট কাজ যে, তারা স্বীয় প্রয়োজন আল্লাহ তাআলা ব্যতীত অপর কারও কাছে জানাবে, অথচ তারা এটা জানে যে রুবুবিয়্যাতে তথা রব হওয়ার ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলা এক ও একক। তারা তো আল্লাহ তাআলার এই বাণীও শুনেছে,

‘আল্লাহ কি তাঁর বান্দার জন্য যথেষ্ট নন?’”।

কাজেই তাঁর কথা থেকে সুস্পষ্ট যে আল্লাহ ব্যতীত অপর কারও কাছে চাওয়া, ইস্তিগাসা, ইস্তিআনাহ করা আল্লাহ তাআলার রুবুবিয়্যাতের সাথে সাংঘর্ষিক। 

৪৩) ইমাম আল কাউকাবানী [রাহ.]: ইমাম আব্দুল কাদ্বির বিন আহমাদ আল কাউকাবানী [রাহ.] ছিলেন ইমাম আহমাদ বিন ইয়াহইয়ার [রাহ.] বংশধর, ছিলেন মুহাদ্দিস ও মুজতাহিদ আলিম। ইয়ামানের যুবাইদী গোত্রের প্রসিদ্ধ আলিমদের অন্যতম। তিনি ইমাম কাদ্বী শাওকানীর [রাহ.] উস্তায ছিলেন। ইয়ামানের সানআয় ১২০৭ হিজরিতে মারা যান। 

তিনি বলেছেন, 

أمّا مَن أُشرب قلبه أنّ النفع يقع من غير الله، فإذا سقط قال: يا فلان، أو لَامَه أحد قال: إنما توسلت بأنبياء الله وعباده الصالحين.

فإذا قلت له: من أجاز لك التوسل بغير الله؟ أعرض عنك ورأى أنك قد أشركت بالأنبياء والأولياء؛ لأنه لا يعرف معنى التوحيد ولا معنى الشرك

“যার মনে এটা ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে যে আল্লাহ ছাড়া উপকার পাওয়া যেতে পারে, সে হোঁচট খেলে বা পড়ে গেলে বলে ওঠে, হে অমুক! বা কেউ তাকে তিরস্কার করলে সে বলে, আমি আল্লাহর নবীগণ ও নেককার বান্দাদের মাধ্যমে মিনতি করছি। 

যদি আপনি তাকে বলেন, কে তোমাকে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও মাধ্যমে তাওয়াসসুল করার অনুমতি দিয়েছে? তখন সে আপনার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে আর মনে করবে যেন আপনি নবীগণ ও আউলিয়াদের সাথে শির্ক করে ফেলেছেন!

সে আসলে তাওহিদের অর্থ বোঝেনি, শির্কের অর্থও বোঝেনি”।

৪৪) ইমাম মুহাম্মাদ বিন আলী আশ শাওকানী [রাহ.]: ইমাম শাওকানী [রাহ.] ছিলেন ইয়ামানের প্রসিদ্ধ আলিমে দ্বীন, মুজতাহিদ, ফকীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির, উসূলবিদ ও বিচারক। তিনি ১২৫০ হিজরিতে মারা যান। 

ইমাম শাওকানী [রাহ.] প্রথম জীবনে যাইদী শীআ ছিলেন বিধায় ইস্তিগাসাহ, ইস্তিআনাহ ও ইস্তিআযার পরিণাম ও এর পেছনে ক্রিয়াশীল চিন্তাধারা খুব ভালো মতই জানতেন, কেননা গাইরুল্লাহর কাছে ইস্তিগাসাহ করা শীআদের সকল ফির্কার কাছেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আমল। তাদের একেক প্রয়োজনের ইস্তিগাসা করতে একেক জন guardian saint এর মত আহলে বাইতের ইমাম রয়েছে। তিনি ইয়ামানের সুন্নীদের মাঝে কবর কেন্দ্রিক শির্ক দেখে তার তীব্র প্রতিবাদ করেন। 

তিনি কবরকেন্দ্রিক শির্ক-বিদআত সম্পর্কে লিখতে গিয়ে এক পর্যায়ে লিখেছেন-

‌منها) ‌اعتقاد ‌الجهلة ‌لها كاعتقاد الكفار للأصنام، وعظم ذلك فظنوا أنها قادرة على جلب النفع ودفع [الضر] فجعلوها مقصدًا لطلب قضاء الحوائج وملجأ لنجاح المطالب وسألوا منه ما يسأله العباد من ربهم، وشدّوا إليها الرحال وتمسحوا بها واستغاثوا.

وبالجملة إنهم لم يدعوا شيئًا مما كانت الجاهلية تفعله بالأصنام إلا فعلوه، فإنا لله وإنا إليه راجعون

“এর মাঝে রয়েছে, কাফিররা মূর্তির ব্যাপারে যে ধরণের বিশ্বাস পোষণ করতো সেই ধরণের জাহিলী বিশ্বাস। এর মধ্যে সবচাইতে বড় জাহিলী বিশ্বাসটি হচ্ছে, তারা মনে করে কবরওয়ালা কল্যাণ আনয়ন ও অকল্যাণ দূরীকরণের ক্ষমতা রাখে। ফলে তারা তাকে হাজত পূরণের মাধ্যম এবং সফলতা ও কামনা পূরণের কেন্দ্রে পরিণত করেছে।  

তারা কবরওয়ালার কাছে তা চাইছে যা বান্দা স্বীয় রবের কাছে চায়। কবরের উদ্দেশ্যে সফর করছে। (বরকতের জন্য) কবরগাত্র মাসাহ করছে। কবরওয়ালার মাধ্যমে ইস্তিগাসাহ করছে। 

এক কথায়, জাহেলী যুগে মূর্তি সাথে যা যা করা হত তার কোনোটাই তারা না করে ছাড়ছে না। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন”।

ইমাম শাওকানী [রাহ.] এই বিষয়টা অত্যন্ত বিস্তারিতভাবে লিখেছেন স্বীয় কিতাব “আদ দুররুন নাদিয়্যাহ ফি ইখলাসি কালিমাতিত তাওহিদে”। অনেকে মনে করে থাকে যে মূর্তিপূজক ও কালিমার দাবিদার কবরপূজকদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে, এছাড়া অজ্ঞতাও কার্যকর রয়েছে। এই বিষয়গুলো কেন প্রায়োগিক ক্ষেত্রে সঠিক নয় তা তিনি এই গ্রন্থে অত্যন্ত বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। 

সংক্ষেপ করতে আমরা কেবল একটি ক্ষুদ্র উদ্ধৃতি উপস্থাপন করছি। তিনি লিখেছেন, 

لمن صار يدعو الأموات عند الحاجات، ويستغيث بهم عند حلول المصيبات، وينذر لهم النذور وينحر لهم النحور، ويعظمهم تعظيم الرب سبحانه: إن هذا الذي يفعلونه هو الشرك الذي كانت عليه الجاهلية، وهو الذي بعث الله رسوله بهدمه، وأنزل كتبه في ذمّه

“যখন লোকেরা প্রয়োজনের সময় মৃতদের আহ্বান করে (তাঁদের কাছে দুআ করা হয়), মুসিবতে পড়লে তাঁদের মাধ্যমে ইস্তিগাসাহ করে, তাঁদের জন্য মানত করে, তাঁদের জন্য কুরবানী করে, রব সুবহানাহ-কে যেভাবে সম্মান করার কথা সেভাবে মৃতদের সম্মান করে, তখন তারা যে কাজগুলো করে সেগুলো আসলে ঐ শির্ক, জাহিলী যুগে মানুষ যেগুলো করতো, যেগুলো মিটিয়ে দেবার জন্য আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে পাঠিয়েছেন, যেগুলোর নিন্দা করে তিনি স্বীয় কিতাব নাযিল করেছেন”। 

৪৫) আল্লামা শাহ আব্দুল ক্বাদির দেহলভী [রাহ.]: শাহ আব্দুল ক্বাদির দেহলভী [রাহ.] ছিলেন শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীর [রাহ.] সন্তান। সেকালে ভারতবর্ষের প্রসিদ্ধতম আলিমদের একজন। মাওলানা আব্দুল হাই, ইমাম শাহ ইসমাঈল শহীদ, মাওলানা ফাযলে হক খয়রাবাদী, মাওলানা শাহ ইসহাক [রাহ.] প্রমুখ ছিলেন তাঁর ছাত্র। কুরআনুল কারিমের প্রসিদ্ধ ঊর্দূ অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত টীকা “মুযিহুল কুরআন” তাঁর কালজয়ী কীর্তি। তিনি ১২৩০ হিজরিতে মারা যান।

এই তাফসিরে শির্কের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে তিনি লেখেন, 

“কেউ যখন আল্লাহর কোনো সিফাত অপর কোনো মাখলুকের মধ্যে রয়েছে বলে মনে করে তখন সেটা শির্ক। যেমন কেউ ভাবলো অমুক সব কিছু জানে, সে যা চায় তা-ই হয়, বা আমাদের ভালোমন্দ হওয়াটা তার ইচ্ছাধীন। অথবা শির্ক তখন হয় যখন আল্লাহর প্রাপ্য সম্মান অন্য কাউকে দেয়া হয়, যেমন কোনো জিনিসকে সিজদাহ করা বা তার কাছ থেকে নিজের হাজত বা প্রয়োজন পূরণের আবেদন করা”।

শাহ সাহেব [রাহ.] শির্কের একটি ভিন্নমাত্রিক প্রায়োগিক সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। তাঁর দেয়া সংজ্ঞা থেকে এটাও স্পষ্ট হচ্ছে যে কেউ যদি আল্লাহর প্রাপ্য সম্মান তথা ইস্তিগাসাহ, ইস্তিআযাহ, ইস্তিআনাহ অন্য কারও কাছে করে তাহলে সেটা যেমন শির্ক হবে, তেমনি এই বিশ্বাস নিয়ে যখন ইস্তিগাসাহ করছে যে অমুক পীর বা শাইখ এই আহবান/ডাক/দুআ শুনতে পাচ্ছেন তখন সেক্ষেত্রেও শির্ক হচ্ছে।

বোঝা যাচ্ছে যে শাহ আব্দুল ক্বাদির [রাহ.] শির্ক সম্পর্কে স্বীয় ছাত্রদের যে জ্ঞান প্রদান করেছেন, সেই জ্ঞানের বহিঃপ্রকাশই শাহ ইসমাঈল শহীদের [রাহ.] গ্রন্থে জাজ্জ্বল্যমান হয়েছে। 

৪৬) ইমাম হাসান বিন খালিদ আল হাযিমী আল ইয়ামানী [রাহ.]: ইমাম হাসান বিন খালিদ আল হাযিমী [রাহ.] ছিলেন ইয়ামানের প্রসিদ্ধ ফকীহ ও মুজতাহিদ। তাফসির ও হাদিস শাস্ত্রে ছিলেন সুদক্ষ। তিনি ইয়ামানের আরিসের শাসক শরীফ মাহমুদ বিন মুহাম্মাদের উজির ছিলেন। শরীফ মাহমুদ উসমানী সেনাপতি মুহাম্মাদ আলী পাশার বিরুদ্ধে সুদীর্ঘ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। এই যুদ্ধের এক পর্যায়ে ইমাম হাযিমী [রাহ.] গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। 

তিনি লিখেছেন, 

فتوحيد الله لا يتم إلا بأن يكون النداء في الشدائد والرخاء له وحده، فمن دعا مع الله غيره فقد جعله معه شريكًا واتخذه إلها؛ لأن الدعاء عبادة، بل هو مخها ولبها، والإله المألوه أي المعبود، فمن طلب من غير الله ما لا يقدر عليه إلا الله فقد عبده مع الله

“প্রচণ্ড দুঃখ-কষ্ট ও স্বাচ্ছন্দ্যের সময়ে যদি কেবল আল্লাহকেই আহ্বান করা না হয় তাহলে আল্লাহর তাওহিদ পূর্ণতা পায় না। যদি কেউ আল্লাহর পাশাপাশি অপর কাউকে আহ্বান করে তাহলে সে আল্লাহর সাথে শরীক স্থির করলো এবং সেই সত্ত্বাকে (যাকে আহ্বান করলো) ইলাহ হিসেবে গ্রহণ করলো। কেননা দুআ হচ্ছে ইবাদাত; বরং দুআ হচ্ছে ইবাদাতের মজ্জা ও শ্রেষ্ঠাংশ। আর ‘ইলাহ’ হচ্ছেন তিনি যিনি ‘মা’লুহ’ অর্থাৎ উপাস্য। 

কাজেই কেউ যখন গাইরুল্লাহর কাছে এমন কিছু চায় যা দেবার সামর্থ্য কেবল আল্লাহর রয়েছে, সে আসলে আল্লাহর পাশাপাশি ঐ সত্ত্বারও ইবাদাত করে”। 

তিনি সমকালীন লোকদের কার্যকলাপ সম্পর্কে লিখেছেন,

وهؤلاء الضلال في هذا الزمان إذا عصفت بهم الريح تنادوا ليدع كل منكم شيخه، ولا تسمع إلا يا زيلعي يا حضرمي يا بدوي يا عبد القادر يا شاذلي يا صندل يا أبا فراج فرجها يا فلان يا فلان، لا تسمع منهم من يقول يا الله، فيرتج المركب بالأصوات بذكر الشيوخ، وهذا هو الشرك الأكبر الذي لا يغفره الله، وأباح دم صاحبه وماله وذريته لأهل الإسلام، لأنه سأل غير الله ما لا يقدر عليه إلا الله، فقد عبده مع الله واتخذه إلها وربا وإن سماه شيخًا وسيدًا

“এই যুগের গোমরাহরা যখন (সমুদ্রে) প্রবল দমকা হওয়ার মুখে পড়ে, তখন একে অপকে ডাকতে থাকে যেন সবাই যে যার শাইখকে বা পীরকে (এই বিপদে) আহ্বান করে। তখন কেবল শোনা যায় ইয়া যাইলাঈ, ইয়া হাদ্বরামী, ইয়া বাদাউই, ইয়া আব্দাল ক্বাদি, ইয়া শাযিলী, ইয়া সান্দাল, ইয়া আবা ফারাজ- এই মুসিবত দূর করে দিন, ইয়া অমুক, ইয়া তমুক।

তাদের মধ্যে কাউকে আপনি ইয়া আল্লাহ বলতে শুনবেন না। 

ফলে শাইখদের ডাকাডাকির আওয়াজে নৌযানটি কেঁপে ওঠে। 

এটা হচ্ছে ঐ শির্কে আকবর যা আল্লাহ ক্ষমা করেন না। এই শির্ক যে করে তার রক্ত, সম্পদ, সন্তান-সন্ততি মুসলিমদের জন্য হালাল বা বৈধ হয়ে যায়। কেননা সে গাইরুল্লাহর কাছে এমন কিছু চেয়েছে যা দেবার ক্ষমতা দেবল আল্লাহ তাআলারই রয়েছে। 

সে অবশ্যই আল্লাহর পাশাপাশি অপর সত্ত্বার ইবাদাত করেছে, সেই সত্ত্বাকে ইলাহ ও রব হিসেবে গ্রহণ করেছে, যদিও সেই ইলাহ বা রবের নাম দিয়েছে শাইখ বা সাইয়্যিদ”।

৪৭) আল্লামা আবুল মাআলী আলী বিন মুহাম্মাদ আস সুওয়াইদী আশ শাফিঈ [রাহ.]: আল্লামা আবুল মাআলী আলী বিন মুহাম্মাদ আস সুওয়াইদী আল বাগদাদী আশ শাফিঈ [রাহ.] ছিলেন বাগদাদের প্রসিদ্ধ শাফিঈ আলিম। ছিলেন শাইখুল কুররা ওয়াল মুহাদ্দিসীন। তিনি ইমাম আজলুনী ও মুরতাদ্বা আয যাবিদীর [রাহ.] মত যুগশ্রেষ্ঠ আলিমদের শিষ্য ছিলেন। তাঁর পরিচয় দিতে গিয়ে শাইখ আবুল বারাকাত খাইরুদ্দীন আলূসী [রাহ.] লিখেছেন, 

أمير المؤمنين في الحديث، علامة العراق الشيخ علي أفندي السويدي البغدادي الشافعي

“হাদিসের আমীরুল মু’মিনিন, ইরাকের আল্লামা, আশ শাইখ, আলী আফেন্দী আল সুওয়াইদী আল বাগদাদী আশ শাফিঈ”।

তিনি ১২৩৭ হিজরিতে মারা যান।

আল্লামা আস সুওয়াইদী [রাহ.] আকিদার ওপর একটি চমৎকার গ্রন্থ রয়েছে, নাম “আল-ইক্বদুস সামীন ফি বায়ানি মাসাইলিদ দ্বীন”। এর ব্যাখ্যা রচনা করেছেন তাঁর সন্তান আবুল ফাউয মুহাম্মাদ আমীন বিন আলী আস সুওয়াইদী [রাহ.]। 

এই কিতাবে আল্লামা আস সুওয়াইদী [রাহ.] তাওহিদ ও শির্ক সম্পর্কে অত্যন্ত উন্নতমানের আলোচনা করেছেন। শির্কের বিভাজন প্রসঙ্গে শাইখ আহমাদ আর রুমীর [রাহ.] করা ৬ শ্রেণির শির্ক নিয়ে আলোচনা করেছেন। উলুহিয়্যাত ও রুবুবিয়্যাতের শির্ক নিয়ে আলোচনা করেছেন। কবর যিয়ারাত প্রসঙ্গে সেখানে সংঘটিত শির্ক ও বিদআত খণ্ডন করেছেন। যারা শাফিঈ ফিকহের নাম দিয়ে এসব কর্মকে প্রচার করে থাকেন তাদেরকে তিনি দৃঢ়তার সাথে শাফিঈ ফিকহ অনুযায়ীই খণ্ডন করেছেন। 

ব্যাখ্যাসহ বইটি ৫৫২ পৃষ্ঠার। এর স্থানে স্থানে শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়াহ ও ইবনুল কাইয়্যিমের [রাহ.] উদ্ধৃতির দেখা মেলে। তুর্কি, ইরাক ও শামের আলিমদের হাতে গড়া একজন শাফিঈ আলিমের এভাবে শাইখুল ইসলামকে উদ্ধৃত করা আমাদের কাছে সুস্পষ্ট করে দেয় যে তাঁর চিন্তাধারা মোটেও অপাংক্তেয় ছিল না।

এই গ্রন্থের শেষের দিকে তিনি ‘ইস্তিআযাহ’ নিয়ে একটি অধ্যায়ই রচনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, 

فمن استعاذ بغير الله على وجه التخليص من الشرور التي لا يدفعها إلا علام الغيوب فهو بمن استعاذ به مشرك

“যদি কেউ এমন অনিষ্ট থেকে উদ্ধার পাবার জন্য আল্লাহর পরিবর্তে অপর কারও কাছে ইস্তিআযা করে, যা থেকে গাইয়ের জ্ঞানের অধিকারী (মহান আল্লাহ) ব্যতীত অন্য কেউ উদ্ধার করার ক্ষমতা রাখে না, সেই ব্যক্তি যার কাছে ইস্তিআযাহ করেছে তাকে আল্লাহর সাথে শরীক সাব্যস্ত করেছে”। 

অন্যত্র তিনি কবরকেন্দ্রিক শির্কের ব্যাপারে ইবনুল কাইয়্যিম [রাহ.] এর বক্তব্য উল্লেখ করে লিখেছেন, 

فَمَنِ اسْتَعَانَ بِغَيْرِ اللَّهِ أَوِ اسْتَغَاثَ بِهِ كَمَا يَقُوْلُهُ هَؤُلَاءِ الْمُتَوَلَّهُوْنَ بِالْمَشَايِخِ : يَا سَيِّدِي الشَّيْحُ فُلَانٌ ! فَقَدْ أَشْرَكَ مَعَ اللهِ غَيْرَهُ

“কেউ যদি আল্লাহ ব্যতীত অপর কারও কাছে ইস্তিআনা বা ইস্তিগাসাহ করে, যেমনটা শাইখ বা পীরদের দ্বারা মোহাবিষ্ট ঐসকল লোকেরা বলে থাকে যে, ইয়া সায়্যিদী আশ শাইখ অমুক (উদ্ধার করেন/ বাঁচান/ সাহায্য করেন ইত্যাদি), তাহলে সেই ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অপর কাউকে শরীক সাব্যস্ত করলো”। 

কাজেই এটা সুস্পষ্ট যে তিনিও এধরণের কাজগুলোকে শির্ক মনে করতেন। এছাড়া এই গ্রন্থেই অন্যত্র তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যে শির্ক কেবল আত্মিক বিশ্বাসের মাধ্যমেই হতে হবে এমন না, আমল ও কথার মাধ্যমেও শির্ক হতে পারে। 

৪৮) আল্লামা আব্দুল্লাহ বিন মুহসিন আল আত্তার আশ শাফিঈ [রাহ.]: আল্লামা আব্দুল্লাহ আল আত্তার [রাহ.]-এর জন্ম ১২৬৫ হিজরিতে ইয়ামানের হাযরামাউতে। তিনি ছিলেন প্রসিদ্ধ শাফিঈ আলিম এবং সূফী বুযুর্গ। দ্বীন প্রচারের জন্য ইন্দোনেশিয়ায় চলে আসেন, এবং এখানেই ১৩৫১ হিজরিতে মারা যান। তিনি ছিলেন হাযরামাউতের প্রসিদ্ধ লুগাউই, ফকীহ ও ঐতিহাসিক আলাউই বিন তাহির আল হাদ্দাদ এবং ইন্দোনেশিয়ার প্রসিদ্ধ দাঈ আলী বিন আব্দির রাহমান আল হাবাশীর [রাহ.] উস্তায। 

আল্লামা আল আত্তার ইন্দোনেশিয়ায় শির্ক-বিদআতের বিরুদ্ধে ব্যাপক দাওয়াহ করেছেন। আকিদাহ বিষয়ে তাঁর একটি রচনা হচ্ছে “তানযীহুয যাত ওয়াস সিফাত মিন দুনিল ইলহাদ ওয়াশ শুবুহাত”। 

এতে তিনি লিখেছে, 

فإفراد الله تعالى بتوحيد العبادة لا يتم إلا أن يكون جميعها كلها له، والنداء في الشدائد والرخاء لا يكون إلا لله وحده، والاستغاثة والاستعانة لله وحده، واللجوء إلى الله، والنذر له، والنحر له، وجميع أنواع العبادة، ومن يفعل شيئًا من ذلك لمخلوق من حي أو ميت أو جماد فقد أشرك في العبادة، وصار مَن يُفعل له هذه الأمور إلهًا لعابديه سواء كان ملكًا أو نبيًا أو وليا أو شجراً أو قبرًا، وصار بهذه العبادة أو بأي نوع منها عابدًا لذلك المخلوق وإن أقرّ بالله وعبده، فإن إقرار المشركين بالله وتقربهم إليه لم يخرجهم عن الشرك

“ইবাদাতের তাওহিদ আল্লাহ তাআলার জন্যই একক করে নেয়া ততক্ষণ পরিপূর্ণতা পাবে না, যতক্ষণনা এর পুরোটাই কেবল আল্লাহর জন্য হয়ে যাচ্ছে, যতক্ষণ না প্রচণ্ড দুঃখ-কষ্ট ও স্বাচ্ছন্দ্যের সময় কেবল আল্লাহকেই আহ্বান করা না হচ্ছে, যতক্ষণ কেবল আল্লাহর কাছেই ইস্তিগাসাহ ও ইস্তিআনাহ করা না হচ্ছে, কেবল আল্লাহর কাছেই আশ্রয় নেয়া না হচ্ছে, যতক্ষণ কেবল আল্লাহর জন্যই মানত করা না হচ্ছে, কেবল তাঁর জন্যই কুরবানী করা না হচ্ছে, এভাবে যতক্ষণ সকল ইবাদাত কেবল আল্লাহর জন্যই করা না হচ্ছে। 

এসকল ইবাদাতের কোনোটা যদি কেউ কোনো জীবিত বা মৃত মাখলুকের জন্য করে, কিংবা কোনো জড় পদার্থের জন্য করে, সে অবশ্যই ইবাদাতে শির্ক করলো। 

আর যার জন্য এসব আমলের কোনো একটাও করা হল সে তার উপাসনাকারীর ‘ইলাহ’-তে পরিণত হল, সে সেই সত্ত্বা কোনো ফেরেশতা হোক, নবী হোক, ওলী হোক, গাছ হোক বা কোনো কবর হোক। এসব মাখলুকের জন্য উপরোল্লিখিত ইবাদাতের যেটাই করা হোক না কেন এর মাধ্যমে ব্যক্তি সেই মাখলুকের ইবাদাতকারীতে পরিণত হয়, যদি সে আল্লাহকে স্বীকার করে এবং তাঁর ইবাদাতও করে। কেননা মুশরিকরা আল্লাহকে মানলেও, তাঁর নৈকট্য অর্জনের প্রচেষ্টা করলেও, (কেবল) এর মাধ্যমে তারা শির্কমুক্ত হয়নি”। 

৪৯) ইমাম মুহাম্মাদ আবিদ সিন্ধী [রাহ.]: ইমাম মুহাম্মাদ আবিদ সিন্ধী [রাহ.] ছিলেন হানাফী ফিকহের প্রসিদ্ধ ফকীহ ও মুহাদ্দিস। মদীনা মুনাওয়্যারার আলিমদের সর্দার। তিনি ১২৫৭ হিজরিতে মারা যান।

তিনি স্বীয় গ্রন্থ “তাওয়ালিউল আনওয়ার শারহুদ দুররিল মুখতারে” লিখেছেন, 

‌ولا ‌يقول ‌يا ‌صاحب ‌القبر يا فلان اقض حاجتي أو سلها من الله أو

كن لي شفيعًا عند الله. بل يقول: يا من لا يشرك في حكمه أحدًا اقض لي حاجتي

“আর এটা বলবে না যে, হে কবরওয়ালা, হে অমুক, আমার প্রয়োজন পূরণ করুন, বা আল্লাহর কাছে এটা (আমার জন্য) চান (বা চেয়ে দিন), বা আল্লাহর কাছে আমার জন্য সুপারিশকারী হয়ে যান; বরং বলবে, হে সেই মহান সত্ত্বা, হুকুমের ক্ষেত্রে যিনি কাউকে শরীক করেন না, আমার প্রয়োজন পূরণ করে দিন”। 

৫০) আল্লামা আবা বুতাইন [রাহ.]: আল্লামা আব্দুল্লাহ বিন আব্দির রহমান আবা বুতাইন [রাহ.] ছিলেন নজদ অঞ্চলের প্রসিদ্ধ হাম্বলী ফকীহ। ইলম অর্জনের জন্য শামে সফর করেন। তাইফ, উনাইযাহ ও ক্বাসিম অঞ্চলের বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন। ১২৮২ হিজরিতে মারা যান। হাম্মলী ফিকহে তাঁর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রচনা রয়েছে। 

তিনি লিখেছেন, 

فنقول: جميع ما تقدم من الأدلة الدالة على أن دعاء الأموات والغائبين وطلب الحاجات منهم من الشرك الذي حرمه الله ورسوله، يدخل في ذلك الملائكة والأنبياء والصالحون وغيرهم، لأن ذلك عبادة، وهي محض حق الله

“কাজেই আমরা বলি, পেছনে যত দলিল উদ্ধৃত হয়েছে সেগুলো প্রমাণ করে যে মৃত ও অনুপস্থিত ব্যক্তিবর্গের কাছে দুআ করা, প্রয়োজন পূরণের আবেদন জানানো সেই শির্কের অন্তর্ভুক্ত যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হারাম করেছেন। এর মাঝে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ফেরেশতারা, নবীগণ, নেকককার বান্দারা ও অন্যান্যরা (অর্থাৎ এঁদের যাদের কাছেই চাওয়া হোক না কেন- শির্ক হবে)। কেননা তা (দুআ ও তলব) হচ্ছে ইবাদাত। আর ইবাদাত কেবলই আল্লাহর হক”। 

৫১) ইমাম নবাব সিদ্দিক হাসান খান ভূপালী [রাহ.]: ইমাম নবাব সিদ্দিক হাসান খান ভূপালী [রাহ.] ছিলেন ভারতের প্রসিদ্ধ আলিম, ফকীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও মুজতাহিদ ব্যক্তিত্ব। আহলে হাদিস জনগোষ্ঠীর ইমাম, ভারতীয় রাজ্য ভূপালের নবাব ও ইমাম শাওকানীর [রাহ.] বিশিষ্ট ছাত্র। তিনি ১৩০৭ হিজরিতে মারা যান। 

অনেকে ধারণা করেন যে তিনি এই মাসআলায় শাইখ ইবন আব্দিল ওয়াহহাব [রাহ.] থেকে ভিন্ন মত রাখতেন। এজন্য তাঁর মন্তব্যও উল্লেখ করছি। তাওহিদ বিষয়ক তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হচ্ছে “আদ দ্বীনুল খালিস”। এই গ্রন্থে তিনি যা উল্লেখ করেছেন তা শাইখ ইবন আব্দিল ওয়াহহাব [রাহ.] থেকে মোটেও ভিন্ন নয়। 

তিনি লিখেছেন, 

فالدعاء هو التوحيد، فمن دعا غير الله فقد أشرك، ودعاءُ غيره سبحانه شرك لا شك فيه

“দুআই হচ্ছে তাওহিদ। যে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে আহ্বান করে বা অন্য কারও কাছে দুআ করে, সে শির্ক করে। আল্লাহ সুবহানাহ ব্যতীত অন্য কারও কাছে দুআ করা যে শির্ক, এতে কোনো সন্দেহ নেই”। 

এই গ্রন্থে তিনি এটাও বলেছেন- من استغاث بالأموات زعمًا منه أنهم يشفعون له في الدنيا فقد سلك سبيل اليهود والنصارى

“যে মৃতদের কাছে এটা মনে করে ইস্তিগাসাহ করে যে তাঁরা দুনিয়ায় তার জন্য সুপারিশ বা শাফাআত করে দেবে, সে আসলে ইহুদী ও খৃষ্টানদের পথে চলছে”।

৫২) আল্লামা আহমাদ বিন মুস্তাফা আল মারাগী [রাহ.]: আল্লামা মারাগী [রাহ.] ছিলেন মিসরের প্রসিদ্ধ আলিম ও মুফাসসির। তিনি প্রসিদ্ধ তাফসির গ্রন্থ, “তাফসিরুল মারাগীর” প্রণেতা। তিনি ১৩৭১ হিজরিতে মারা যান। 

আল্লামা মারাগী [রাহ.] লিখেছেন, 

ومن جعل بينه وبين الله واسطة في العبادة كالدعاء، فقد عبد هذه الواسطة من دون الله، 

“যে আল্লাহ ও নিজের মধ্যে ইবাদাতের ক্ষেত্রে মাধ্যম স্থির করে নেয়, যেমন দুআয় মাধ্যম স্থির করা, সে আসলে আল্লাহর পরিবর্তে এই মাধ্যমের ইবাদাত করে”। 

৫৩) আল্লামা মীর সাইয়্যিদ মা’সূমী আল খুজান্দী [রাহ.]: আল্লামা মীর সায়্যিদ মুহাম্মাদ সুলতান আল খুজান্দী [রাহ.] ছিলেন ‘খুজান্দের’ প্রসিদ্ধ আলিম, ফকীহ, দাঈ ও মারগিলানের বিচারক। মারগিলান আধুনিক উজবেকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত। তাঁর জন্মস্থান খুজান্দ শহরটি আধুনিক তাজিকিস্তানের অংশ। তিনি ইলম অর্জনের জন্য মক্কা, শাম এবং মিসরেও গিয়েছিলেন। রুশ বিপ্লবের পর তাজিকিস্তান ও উজবেকিস্তানে সমাজতান্ত্রিক শাসন চালু হলে তিনি বন্দি হন। মুক্ত হবার পর প্রথমে চীনে ও পরে মক্কায় হিজরত করেন, এবং সেখানেই ১৩৮১ হিজরিতে মারা যান। 

তিনি লিখেছেন, 

من قال: لا إلهَ إلَّا اللهُ، وهو مع ذلك يفعَلُ الشِّركَ الأكبَرَ، كدُعاءِ الموتى والغائبين، وسؤالِهم قضاءَ الحاجاتِ، وتفريجَ الكُرُباتِ، والتقَرُّبِ إليهم بالنَّذرِ والذَّبائحِ؛ فهذا مُشرِكٌ شاء أم أبى

“যে বলে: লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আবার এর পাশাপাশি শির্কে আকবর করে, যেমন মৃত ও অনুপস্থিত সত্ত্বার কাছে দুআ করা, তাঁদের কাছে প্রয়োজন পূরণের আবেদন করা, দুঃখ-কষ্ট দূর করতে আবেদন করা, তাঁদের নৈকট্য অর্জনের জন্য মানত করা, কুরবানি করা- সে স্বীকার করুক বা অস্বীকার করুন, সে আসলে মুশরিক”। 

আল্লামা খুজান্দী কেবল ইস্তিমদাদের মাসআলা নিয়ে একটি স্বতন্ত্র কিতাবই লিখেছেন, নাম: حكم الله الواحد الصمد في حكم الطالب من الميت المدد। ৭২ পৃষ্ঠার বইটি শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দির রাহমান আল খামিসের সম্পাদনায় ১৪১৪ হিজরিতে প্রকাশিত হয়েছে। সংক্ষিপ্ত এই গ্রন্থে তিনি ইস্তিগাসার মাসআলায় হানাফী ফিকহের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থসমূহ এবং স্বীয় উস্তাযের উদ্ধৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন। 

৫৪) শাইখুল কুরআন আল্লামা গুলামুল্লাহ খান [রাহ.]: শাইখুল কুরআন গুলামুল্লাহ খান [রাহ.] ছিলেন পাকিস্তানের প্রসিদ্ধ দেওবন্দী আলিম ও মুফাসসির। ছিলেন মাওলানা হুসাইন আলী ও আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মিরীর [রাহ.] ছাত্র। মাওলানা হুসাইন আলীর [রাহ.] মৃত্যুর পর তাঁর কুরআনী আন্দোলনকে তিনি এগিয়ে নিয়েছিলেন, যেজন্য এই তাওহিদপন্থী আলিম শাইখুল কুরআন উপাধীতে ভূষিত হন। 

তিনি স্বীয় তাফসিরে লিখেছেন, 

ما فوق الاسباب غائبانہ حاجات میں پکارنا عبادت ہے اس لیے اللہ کے ساتھ مخصوص ہے اور غیر اللہ کے لئے شرک ہے ۔ 

“হাজত পূরণের জন্য আসবাবের ঊর্ধে কাউকে গায়েবীভাবে আহ্বান করা ইবাদাত। এজন্য এটা কেবল আল্লাহর জন্যই খাস, আর গাইরুল্লাহ বা আল্লাহ ভিন্ন অন্য কারও জন্য করা শির্ক”।

৫৫) মুফতিয়ে আজম আযীযুর রহমান [রাহ.]: মুফতী আযীযুর রহমান [রাহ.] ছিলেন দারুল উলূম দেওবন্দের প্রধান মুফতী এবং নকশবন্দী তরীকার একজন সূফীসাধক। তিনি ১৯২৮ সালে মারা যান। 

তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, নবীগণ [আ.] ও আউলিয়াদেরকে হাযির নাযির ভাবা ও মুসিবতের সময় তাঁদেরকে ডাকা বা আহ্বান করা এবং এই বিশ্বাস রাখা যে, তাঁদেরকে যখনই ডাকা হবে তাঁরা তখনই তাৎক্ষনিক সাড়া দেবেন- এই বিশ্বাস রাখা কি কুফর?

তিনি উত্তরে লেখেন:

(الجواب) یہ اعتقاد کفر ہے ۔ نصوص صریحہ کے خلاف ہے کلام پاک میں ہے – وَهُوَ ٱللَّهُ فِی ٱلسَّمَـٰوَ ٰ⁠تِ وَفِی ٱلۡأَرۡضِ یَعۡلَمُ سِرَّكُمۡ وَجَهۡرَكُمۡ وَیَعۡلَمُ مَا تَكۡسِبُونَ اس سے صاف معلوم ہوتا

ہے کہ سوائے خدا کے تمام جگہ کوئی حاضر و ناظر نہیں ہے اور مصیبت کے وقت اور ہر وقت خدا تعالی سے مدد مانگنی چاہیے ۔ قال رسول الله ﷺ لا بن عباس اذا استعنت فاستعن بالله – جب مدد کی ضرورت

ہو خدا سے مانگو غیر کی طرف توجہ نہ کرو۔

“(উত্তর) এই আকিদাহ বা বিশ্বাস কুফর। সুস্পষ্ট নস (তথা কুরআন ও সুন্নাহ) এর বিপরীত বিশ্বাস এটি। কালামে পাকে রয়েছে- ‘আর আসমানসমূহ ও যমীনে তিনিই আল্লাহ, তিনি জানেন তোমাদের গোপন ও প্রকাশ্য এবং জানেন যা তোমরা অর্জন কর’।

এই আয়াত থেকে সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ সকল স্থানে হাযির-নাযির নয়। আর মুসিবতের সময় এবং সব সময়ই কেবল খোদা তাআলার কাছে সাহায্য চাওয়া উচিৎ। 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইবন আব্বাস [রা.] কে বলেছেন, ‘যখন তুমি সাহায্য চাইবে, আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাইবে’।

যখন সাহায্যের প্রয়োজন পরবে তখন খোদার কাছে চাও, অন্য কারও অভিমুখী হইও না”।

৫৬) মুফতি সাইয়্যিদ আব্দুর রাহীম লাজপুরী [রাহ.]: মুফতি সায়্যিদ আব্দুর রাহীম লাজপুরী [রাহ.] ভারতের একজন প্রসিদ্ধ হানাফী আলিম ছিলেন। তাঁর ফাতাওয়া সঙ্কলন “ফাতাওয়া রাহিমিয়্যাহ”, এই অঞ্চলে অত্যন্ত বিখ্যাত এবং নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ হিসেবে বিবেচ্য। মুফতি সাহেব ১৪২২ হিজরিতে মারা যান।

মুফতি সাহেবের কাছে গাইরুল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনার বিধান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। তিনি দেড় পৃষ্ঠা ব্যাপী এর চমৎকার জবাব প্রদান করেন। আমরা পেছনে শাইখ আব্দুল ক্বাদির জিলানী, শাহ ওয়ালিউল্লাহ, তাহির পাটনীর [রাহ.] এর যে উদ্ধৃতিসমূহ উল্লেখ করেছি, সেগুলো তিনি উল্লেখ করেছেন; বরং আরও বেশি উদ্ধৃত করেছেন। 

তিনি এই ফাতাওয়ায় শাহ ওয়ালিউল্লাহ [রাহ.] এর গ্রন্থ “তাফহিমাত” থেকে উদ্ধৃত করেছেন যে, 

كل من ذهب الي بلدة اجمير او الي قبر سالار مسعود او ما ضاهاها لأجل حاجة يطلبها اثم اثما اكبر من القتل و الزنا

“যে আজমীরে বা সালার মাসঊদের কবরে বা তাদের অনুরূপ কোথাও নিজেদের প্রয়োজন পূরণের কামনায় যায়, সে খুন ও ব্যাভিচারের চেয়েও বড় গুনাহ করে”। 

মুফতি সাহেব নিজে লিখেছেন,

خدا کو چھوڑ کر دوسرے سے اولاد مانگنا، بیمار کے لئے شفا طلب کرنا اہل قبور سے روزی مانگنا، مقدمہ میں کامیاب کرنے کی درخواست کرنا جائز نہیں ہے، مشرکانہ فعل ہے

“খোদাকে ছেড়ে অন্যের কাছে সন্তান চাওয়া, অসুস্থের জন্য সুস্থতা চাওয়া, কবরওয়ালার কাছে রুজি চাওয়া, মামলায় জেতার জন্য দরখাস্ত করা- জায়েয নয়, এগুলো মুশরিকদের মত কাজ”। 

৫৭) আল্লামা সারফারায খান সাফদার [রাহ.]: মাওলানা সারফারায খান [রাহ.] ছিলেন পাকিস্তানের প্রসিদ্ধ আলিমে দ্বীন, ফকীহ, খতিব ও বিশিষ্ট লেখক। তিনি ২০০৯ সালে মারা যান। 

বিদআতী ও কবরপূজারী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রচুর বিতর্ক ও লেখনীর জন্য তিনি বিশেষভাবে পরিচিত। শির্ক-কুফরের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। 

ইস্তিগাসাহ, ইস্তিআনাহ, ইস্তিআযাহ ও ইস্তিমদাদের ক্ষেত্রে মূল হচ্ছে মাশাইখের রূহকে হাযির ভাবা, নিদেনপক্ষে তাঁরা শোনেন-এটা ভাবা। এর খণ্ডনে হানাফী ফুকাহাদের যে অবস্থান তিনি সংক্ষেপে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন স্বীয় তাফসিরে। তিনি লিখেছেন, 

ایک شخص یہاں کھڑا ہے اور کہتا ہے اے شیخ عبد القادر جیلانی یہ میری مدد کر یہ مافوق الاسباب استعانت ہے۔ اس طرح کہنے میں ان کو حاضر و ناظر اور عالم الغيب ماننا پڑے گا اور متصرف فی الامور سمجھنا پڑے گا اور یہی کفر کی بنیاد ہے۔ تمام فقہاء کرام ہیم کا اس مسئلے میں اتفاق ہے کہ “مَنْ قَالَ أَرْوَاحُ الْمَشَائِخ حَاضِرَةٌ تَعْلَمُ يَكْفُرُ، شامی، عالمگیری، البحر الرائق اور بزاز یہ میں ہے کہ جو آدمی یہ عقیدہ رکھے کہ مشائخ کی ارواح حاضر ہیں اور ہمارے حالات کو جانتی ہیں وہ پکا کافر ہے کیونکہ یہ مافوق الاسباب استعانت ہے۔ اور یہ اللہ تعالیٰ کے سوا کسی سے

جائز نہیں ہے۔

“একজন ব্যক্তি এখানে দাঁড়িয়ে যদি বলে, হে শাইখ আব্দুর ক্বাদির জিলানী, আমাকে সাহায্য করুন। এটা আসবাবের ঊর্ধের বিষয়ে ইস্তিআনাহ। এভাবে বলার মাধ্যমে তাঁকে (আহূত সত্ত্বাকে) হাযির, নাযির ও আলিমুল গাইব মানা লাগবে। সেই সাথে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে তাসাসররুফ বা হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা রাখেন এটা মেনে নিতে হবে। আর এটাই তো কুফরের বুনিয়াদ। 

সকল সম্মানিত ফুকাহা এই মাসআলায় একমত যে, ‘যে বলবে মাশাইখদের/পীরদের রুহসমূহ হাযির আছে, তাঁরা সব জানেন, সে কুফর করবে’। (অর্থাৎ) ফাতাওয়ায়ে শামী, আলমগীরী, বাহরুর রাইক আর বাযযাযিয়ায় আছে যে, যেই ব্যক্তি এই আকিদাহ পোষণ করে যে, মাশাইখদের রূহসমূহ হাযির আছে, আর আমাদের অবস্থা তাঁরা জানেন, সে পাক্কা কাফির। কেননা এটা আসবাবের ঊর্ধের ইস্তিআনাহ। আর এটা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও কাছে করা জায়েয নয়”।

আলহামদুলিল্লাহ, এ পর্যন্ত আমরা ৪ মাযহাবের ও বিভিন্ন ঘরানার মোট ৫৭ জন আলিমে দ্বীনের উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছি। তাঁরা প্রত্যেকেই প্রসিদ্ধ ও প্রভাবশালী আলিমে দ্বীন ছিলেন। সংক্ষেপণের জন্য আমরা আর সংখ্যা বৃদ্ধি করছি না। নয়তো আল্লাহ তাআলা চাইলে, আরও অনেক আলিমের উদ্ধৃতিই উল্লেখ করা সম্ভব। 

এসব উদ্ধৃতি থেকে এটা স্পষ্ট হয় যে,

১) গাইরুল্লাহর কাছে ইস্তিগাসাহ, ইস্তিআনাহ, ইস্তিআযাহ ও ইস্তিমদাদ করা উদ্ধৃত সকল আলিমের মতেই নাজায়েয। 

২) যুগে যুগে বিপুল পরিমাণ আলিমে দ্বীন এই কাজকে সরাসরি শির্ক আখ্যা দিয়েছেন।

৩) শাইখ ইবন আব্দিল ওয়াহহাব [রাহ.] তাঁর অবস্থানে মোটেও একা নন। তাঁর পূর্বে যেমন অনেকে এই বিধান ঘোষণা করেছেন, তাঁর সময়ে অনেকে করেছেন, আর তাঁর পরেও অনেকে করেছেন। আর এটা কেবল হাম্বলী আলিমদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং হাম্বলী, হানাফী, শাফিঈ, মালিকী এবং আহলে হাদিস-সকল মাযহাবের আলিমদের মধ্যেই মুহাক্কিক আলিমগণ এর এই ধরণের কর্মকে শির্ক বা নিদেনপক্ষে না-জায়েয বলেছেন। 

৪) একইভাবে এই অবস্থানটি কেবল আরবের কোনো অঞ্চলে সীমাবদ্ধ বা কোনো অঞ্চল থেকে উদ্ভূত মাসআলা নয়, যেমনটা অনেকে দাবি করে থাকেন। কেননা আমরা দেখেছি স্পেন, আফ্রিকা, মিসর, শাম, ইরাক, ইয়ামান, মধ্য এশিয়া, পাকিস্তান হয়ে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত উলামায়ে কিরাম এই মত প্রদান করেছেন। 

৫) এমন বেশ কিছু আলিমের উদ্ধৃতি আমরা উদ্ধৃত করেছি, যারা এমন সময় এই ফাতাওয়া দিয়েছেন যখন আলে সাউদ নির্বাসনে ছিল, ক্ষমতাচ্যুত ছিল। ১৯ শতকের সেই সময়টায় ‘ওয়াহাবীদের’ নিয়ে বহু মিথ প্রচলিত ছিল। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা হত। সাধারণত তাঁদের অনুরূপ কোনো ফাতাওয়া দেয়া হিজাজ, ইরাক, শাম ও মিসরে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার ছিল। অথচ আমরা দেখি, সেই সময়ও বিভিন্ন মাযহাবের হকপন্থী আলিমরা তাওহিদ ও শির্কের বিষয়ে উচ্চকণ্ঠে কথা বলেছেন। ইস্তিগাসার মাসআলায় এমন মতামত ব্যক্ত করেছেন যা ‘ওয়াহাবী’দের সাথে মিলে যায়। 

৬) কেবল আসারিরাই নয়, প্রাচীন আশআরী ও মাতুরিদী আলিমরাও একই মত পোষণ করে করেছেন। 

এথেকে তো বোঝাই যায় যে, হকের প্রদীপ সর্বদাই কোথাও না কোথাও নিভু নিভু করে হলেও জ্বলতে থাকবে। 

আশা করি এই নিবন্ধ তার উদ্দেশ্য সাধনে সক্ষম হয়েছে, আমরা এটা দেখাতে পেরেছি যে শাইখ ইবন আব্দিল ওয়াহহাব [রাহ.] ইস্তিগাসাহ, ইস্তিআনাহ ও ইস্তিআযার ব্যাপারে যে মত প্রদান করছেন তাতে তিনি মোটেও একা নন; বরং এটাই হাম্বলী ফিকহের মুফতাহ বিহ মত বা এর ওপরই তাঁদের ফাতাওয়া। এছাড়া অন্যান্য ফিকহের উলামারাও একই কথা বলেছেন। 

এছাড়া বিষয়টা কেবল আসারি আকিদার অনুসারীদের নিজস্ব অবস্থানও নয়; বরং প্রাচীন আশআরী ও মাতুরিদী আলিমরাও একই কথাই বলেছেন। 

উল্লেখ্য যে, এর সাথে সম্পৃক্ত আরেকটি মাসআলা হচ্ছে তাওয়াসসুলের মাসআলা। অনেকে তাওয়াসসুল ও ইস্তিগাসাকে এক করে ফেলেন, কিন্তু উভয়ে ভিন্ন বিষয়। তাওয়াসসুলের ক্ষেত্রে শাইখের অবস্থান আমাদের আলোচ্য নিবন্ধের বিষয়বস্তু নয়। ইন শা আল্লাহ, প্রয়োজন ও সুযোগ হলে সে বিষয়ে অন্য কোনো নিবন্ধে আলোচনা করা হবে। 

সকল প্রশংসা কেবল লা শরীক আল্লাহ তাআলার।

অগণিত সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক তাঁর প্রিয় হাবীবের ওপর। 

References:

1 আল মু’জামুল ওয়াফী, ভুক্তি: ‌الاستغاث

2 মাক্বাঈসুল লুগাহ: ৪/৪০০, ভুক্তি: غَوَثَ

3 আল মাউসুআতুল ফিকহিয়্যাতিল কুওয়াইতিয়্যাহ: ৪/২২

4  আল মু’জামুল ওয়াফী, ভুক্তি: استعانة

5 A Dictionary of Modern Written Arabic, 4th ed., page 772

6 আল মু’জামুল ওয়াফী, ভুক্তি: استعاذ