উসমানীদের দ্বারা “ওয়াহাবীদের” তাকফিরকরণ ও তাঁদের ওপর আক্রমণ প্রসঙ্গ:

একটা প্রচলিত ধারণা হচ্ছে ওয়াহাবী তথা শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহহাবের [রাহ.] অনুসারীরা তাঁদের প্রতিপক্ষ, বিশেষ করে সেকালের তুরষ্কের উসমানী সালতানাত ও তাদের অধীনস্থ হারামাইন শরীফাইনের শাসক শরীফদের তাকফির তথা কাফির প্রতিপন্ন করত, অতঃপর তাদের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করত। ধারনাটা এতই প্রচলিত যে, এর একটা ভিন্ন বয়ানও যে থাকা সম্ভব তা হয়ত আমাদের অনেকের মনেও আসে না। 

বস্তুত ইতিহাসের একপাক্ষিক অধ্যয়ন অনেক সময় ব্যক্তিকে বিপথে চালিত করে থাকে। এজন্য ইতিহাসের নির্মোহ পাঠ আবশ্যক। 

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় যে, উসমানী শাসক গোষ্ঠী ওয়াহাবীদের বিরুদ্ধে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছিল। এর মধ্যে আমরা এমন অনেক কাজই করতে দেখি যা হয়তো আমাদের ধারণারও বাইরে। যেমন তাঁদেরকে কাফির ঘোষণা করা, যিন্দীক বলা, তাঁদেরকে মুশরিক বলা, নাপাক বলা, তাঁদের হজ্ব ও উমরাহ করতে বাধা দেয়া, তাঁদের রক্তকে হালাল ঘোষণা করা ইত্যাদি। এর ফলশ্রুতিতে ওয়াহাবীরা একপর্যায়ে তাঁদের প্রত্যক্ষ বিরোধিতায় নামতে বাধ্য হয়। 

এ প্রসঙ্গে সেকালের উসমানী শাসকদের সুবিধাভোগী বহু আলেম ও ঐতিহাসিকের লেখার উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে। আমরা দুজন বিশিষ্ট ব্যক্তির প্রখ্যাত লেখনীর সাহায্য নিচ্ছি। 

প্রথম জন হচ্ছেন, উসমানী সরকার কর্তৃক নিযুক্ত হিজাজের শাইখুল ইসলাম ও হারামাইন শরীফাইনের ইমাম, শাফিঈ মাযহাবের প্রখ্যাত আলেম, শাইখ আব্দুল ক্বাদীর জীলানীর [রাহ.] বংশধর শাইখ আহমাদ যাইনী দাহলান [রাহ.]। তাঁর জন্ম ১৮১৬ ঈ., মৃত্য ১৮৮৬ ঈ. 

আকীদায় আশ’আরী এই আলেম ছিলেন একাধারে দেওবন্দী ঘরানার আলেম মাওলানা খালীল আহমাদ সাহরানপুরী ও রেজভী ঘরানার ইমাম আহমাদ রেজাখান ব্রেলভীর উস্তাদ। 

তাঁর প্রখ্যাত গ্রন্থ “আদ দুরারুস সানিয়্যাহ ফি রাদ্দি আলাল ওয়াহাবিয়্যাহ” থেকে উদ্ধৃতি নেয়া হবে। এক্ষেত্রে ১৯৫০ সালে প্রকাশিত এর ২য় সংস্করণ ব্যবহার করা হচ্ছে। 

এই নিবন্ধে লেখককে শাইখ দাহলান বলে সম্বোধন করা হবে। 

দ্বিতীয় জন হচ্ছেন, মসজিদুল হারামের ইমাম, খতিব ও মুদাররিস তথা শিক্ষক, প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক শাইখ আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ বিন আব্দুশ শাকূর আল মাক্কী আল হানাফী [রাহ.]।

তাঁর মৃত্যু হয়েছে ১২৫৭ হিজরী মোতাবেক আনুমানিক ১৮৪১ বা ১৮৪২ সালে।

এই নিবন্ধে তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ “তারিখু আশরাফি উমারাই মাক্কাহ” এর সাহায্য নেয়া হয়েছে, যা মিসরের New Valley University এর শিক্ষক ড. মুহাম্মাদ আব্দুল আল মুহাম্মাদ আলী এর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে। 

এই নিবন্ধে উক্ত লেখককে শাইখ ইবন আব্দিশ শাকূর বলে সম্বোধন করা হবে।

তাকফিরের বয়ান: 

) সংঘাত হুট করে শুরু হয়নি। মক্কার শরীফরা নজদী আলেমদের তাঁদের প্রতিনিধি পাঠাতে বলে দেয়। নজদীগণ ৩০ জন আলেমের একটি প্রতিনিধি দল পাঠায়। এই দলটির সাথে কথা বলে তুর্কিপন্থী আলেমরা বলে দেন যে এদের আকীদায় সর্বদিক বেষ্টিত কুফর রয়েছে। তাও কেমন কুফর? ইবন আব্দিশ শাকূর বলেন, كفراً صريحاً لا يحتاج إلى تأويل 

“এমন সুস্পষ্ট কুফর যা তাবিলযোগ্য নয়”। 

কারো কুফর যদি এই পর্যায়েই পৌঁছে যায় যে তা মোটেও তাবিল বা ব্যাখ্যাযোগ্য নেই, তখন তাকে কাফির ঘোষণা করা, তার রক্ত-সম্পদকে হালাল ঘোষণা করা তো সময়ের ব্যাপারমাত্র। সেটাও শীঘ্রই পূরণ হয়ে যায়। এটা আমরা পরবর্তী আলোচনায় দেখব।

২) মক্কার আঞ্চলিক শাসকদের বলা হত শরীফ। মুসাঈদ বিন সাঈদের পর [ ১৭৬০-৭০ ঈ.] ক্ষমতায় আসেন তাঁর ভাই আহমাদ বিন সাঈদ [১৭৭০-১৭৭০ ঈ.]

পূর্বের প্রতিনিধি দলের মতই শরীফ আহমাদ একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণ করেন। এরা নজদী বা ওয়াহাবী আলেমদের সম্পর্কে জানালেন لايتدينون إلا بدين الزنادقة “এরা মূলত যিন্দীকদের ধর্মমত পালন করে থাকে”।

এখানে আমাদের বুঝতে হবে যে যিন্দীক দ্বারা কী বোঝানো হয়। মূলত যিন্দীক শব্দটি দ্বারা ঐ ব্যক্তিকে বোঝানো হয় যে বাহ্যিকভাবে নিজেকে মুসলিম দাবি করলেও ভেতরে ভেতরে অন্য কোনো ধর্ম পালন করে। 

অর্থাৎ এই সরকারি প্রতিনিধি দলের দাবি মোতাবেক নজদীরা মূলত বাহ্যিকভাবে ইসলামের দাবি করলেও এরা আসলে ভেতরে ভেতরে অন্য কোনো ধর্মমত পালন করে যাচ্ছে! 

এর ফলে তারা সিদ্ধান্ত নেন যে যেহেতু এরা যিন্দীক এমনকি মুশরিক, তাই তাঁদেরকে হজ্ব ও উমরার জন্য বাইতুল্লাহর আসেপাশে আসা থেকে বাধা দেয়া হবে। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন, إِنَّمَا ٱلۡمُشۡرِكُونَ نَجَسࣱ فَلَا یَقۡرَبُوا۟ ٱلۡمَسۡجِدَ ٱلۡحَرَامَ

“নিশ্চয় মুশরিকরা হচ্ছে নাপাক, কাজেই তারা যেন মাসজিদুল হারামের নিকটবর্তী না হয়”।

৩) কেউ যদি মুশরিক হয়, যিন্দীক হয়, মুর্তাদ হয় তাহলে তাদের ওপর লুটপাট চালাতে আর আপত্তি তো থাকে না। এজন্য ইবন আব্দিশ শাকূর বর্ণনা করেছেন, শরীফ গালিব [১৭৮৮-১৮০৩ ঈ.] যখন সালাফী অধ্যুষিত ওয়াদি হিলীতে অভিযান চালান তখন সেখানকার গরু-ছাগল ও বটেই দাসদেরও লুটপাট করা হয়। এমনকি কতক সেনা সেখানকার স্বাধীন বালকদের তুলে নিয়ে এসে মক্কায় দাস হিসেবে বিক্রয় করে দেয়!

৪) এই ধরণের আক্রমণ ও হত্যাযজ্ঞ চালুই ছিল। শরীফ মুবারাক একবার এক স্থানে গেলেন যার নাম ছিল আল- ইলম। সেখানে বনু হারব গোত্রের কিছু ওয়াহাবীকে পেলেন। তাঁদের ওপর আকস্মিক আক্রমণ করে তাদের কাউকে তিনি হত্যা করলেন,কাউকে শূলে চড়ালেন, কাউকে এতই মারলেন যে তারা অন্ধ হয়ে গেল। 

এরপর কিছুটা সামনে এগিয়ে তিনি ৪৫ জন ওয়াহাবীকে পেলেন যারা মদীনা থেকে কিছু জিনিসপত্র নিয়ে আসছিল। তিনি তাঁদের সবাইকে হত্যা করে তাঁদের সামগ্রী লুটে নেন। 

৫) নজদী আলিমদের প্রতিনিধিদলের সাথে শরীফের প্রতিনিধি কী রকম আচরণ করেছিল তার বর্ণনাটাও জানা দরকার। এর আলোচনা শাইখ দাহলান বিস্তারিতভাবেই করেছেন। আমরা সেটা সংক্ষেপে উল্লেখ করছি। 

নজদের প্রতিনিধিদল হজ্ব ও উমরা করার জন্য শরীফের অধীনস্থ মক্কার প্রশাসক মাসঊদের কাছে অনুমতি চান। মাসঊদ তাঁদের আকিদাহ যাচাই করার জন্য ৩০ জন আলিম প্রেরণ করে। শাইখ দাহলানের ভাষায়, ظنا منهم أنهم يفسدون عقائد أهل الحرمين 

“এই ধারণা করে যে, হতে পারে তারা হারামাইনের অধিবাসীদের আকিদাহ খারাপ করে দিল!”

এরপর তাঁদেরকে মুলহিদ তথা নাস্তিক অভিহিত করে শেকলবন্দী করে জেলে প্রেরণ করা হল।

এই ঘটনাগুলো থেকে বোঝা গেল যে উসমানীদের নিযুক্ত শাসকদের তরফ থেকে ওয়াহাবীদের প্রচুর নিগ্রহ ও নিপীড়নের স্বীকার হয়েছে, তাঁদেরকে মুলহিদ, যিন্দীক এমনকি মুশরিক বলা হয়েছে, তাঁদের ওপর আকস্মিক আক্রমণ করা হয়েছে, তাঁদের হজ্ব ও ঊমরা থেকে বাধা দেয়া হয়েছে, তাঁদের হত্যা করা হয়েছে, তাঁদের ধন-সম্পদ এমনকি সন্তানদেরও লুট করা হয়েছে। এর ফলে এক পর্যায়ে তাঁরা প্রতিরোধে নামতে বাধ্য হন। 

References:

1 দেখুন https://en.wikipedia.org/wiki/Ahmad_Zayni_Dahlan, retrieved on 08/11/2023  

2 আব্দুল্লাহ বিন আব্দির রহমান আল মুআল্লিমী, আ’লামুল মাক্কিঈন: ১/১২৩-২৪ 

3 তারিখু আশরাফি উমারাই মাক্কাহ: ২/৫২৪ 

4 https://ar.wikipedia.org/wiki/%D8%B4%D8%B1%D9%8A%D9%81_%D9%85%D9%83%D8%A9 retrieved on 09/11/2023  

5 তারিখু আশরাফি উমারাই মাক্কাহ: ২/৫২৭

6 মাজমুঊ ফাতাওয়া: ৭/৪৭১ 

7 সূরা তাওবাহ: ২৮ 

8 তারিখু আশরাফি উমারাই মাক্কাহ: ২/৫২৭ 

9 তারিখু আশরাফি উমারাই মাক্কাহ: ২/৫৮২ 

10 তারিখু আশরাফি উমারাই মাক্কাহ:২/৫৬২ 

11 আদ দুরারুস সানিয়্যাহ, পৃ: ৪৭