ওয়াহাবী-নজদী আন্দোলনের পূর্বসূরি: কাদিযাদেলি সিলসিলা, একটি উসমানী শিক্ষা ও সংস্কার আন্দোলনের পুনর্পাঠ:

১৮ শতকে যখন নজদে ওয়াহাবী আন্দোলন শুরু হল তখন থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত একটা ধারণা প্রচলিত রয়েছে যে এই আন্দোলন যেন হঠাৎ করেই আবির্ভূত হয়েছে, এবং এর পেছনে ক্রিয়াশীল কোনো ইলমী বা জ্ঞানগত ধারা আসলে নেই। শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহহাব [রাহ.] তাঁর নিজস্ব চিন্তাধারার আলোকে একটা মিলিট্যান্ট ধর্মীয় আন্দোলন দাঁড় করিয়ে ফেললেন, যা নাকি মূলধারা বিচ্যুত ও অতি কট্টরপন্থী। এর ফলে সহজেই একে ইসলামের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন একটি ধারা হিসেবে চিত্রিত করা গেল। এমনিতেও এর মূল নাম “মুওয়াহহিদিন” বা একত্ববাদী আন্দোলন থেকে পরিবর্তন করে এই আন্দোলনের নাম দেয়া হয়েছিল “ওয়াহাবী আন্দোলন”। ফলে একে সহজেই একটা “ট্যাগ” দিয়ে দেয়া গেল। 

কিন্তু এটা খুঁজে দেখার চেষ্টা করা হল না যে এই আন্দোলন কি হঠাৎ-ই মাটি ফুঁড়ে বেড়িয়ে এল নাকি এর পেছনে শাইখের [রাহ.] উস্তাযদের কোনো অবদানও রয়েছে? এটা কি একমই বিচ্ছিন্ন ও ভুঁইফোড় একটি আন্দোলন নাকি শতাব্দী প্রাচীন কোনো সংস্কার আন্দোলনের শাখা? এই আন্দোলনের যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো দেখা যায় সেগুলো কি তাদের একদমই মূলধারা বিচ্যুত একক ও অনন্য বৈশিষ্ট্য নাকি শতাব্দী প্রাচীন অন্যান্য মূলধারার সংস্কারবাদী আন্দোলনের সাথে এর বৈশিষ্ট্যগুলো মিলে যায়? 

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর না খুঁজেই এই আন্দোলনটির ঢালাও বিরোধিতা করা হল। 

সমকালীন তুর্কি ও মিসরি শাসকযন্ত্র দ্বারা অত্যাধিক চাপ প্রয়োগে দমন করতে দেখা গেল। সেই সাথে দেখা গেল ইস্তাম্বুল, দামেস্ক, আলেপ্পো ও কায়রোর সূফী শাইখ ও মুফতীরা যেন তড়িঘড়ি করেই এই আন্দোলনের বিপক্ষে আয়োজন করে নেমে গেলেন, এদের বিভিন্ন অপবাদ দিলেন, এদের ওপর শির্ক-কুফর-খুরুজসহ নানা কাল্পনিক অভিযোগ আরোপ করলেন। এদের রক্তকে হালাল করে দিলেন। সমকালীন প্রসিদ্ধ আলিম-ইমামদের বিখ্যাত বইপত্রে এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে লেখা নিরেট “মিথ্যাচার” ইতিহাসের অংশ হয়ে রইলো। 

প্রশ্ন হল, এটা কেন হল? তাঁরা আঁতকে উঠলেন কেন? এমন তো কত বিদ্রোহই হয়েছে, যুদ্ধ হয়েছে, হয়েছে আন্দোলন। তবে কি এদের মাঝে তারা নিজেদের প্রতিপক্ষ কোনো সুদীর্ঘ দ্বীনি-সামাজিক-রাজনৈতিক সংস্কার আন্দোলনের ছায়া দেখে ভড়কে গিয়েছিলেন? 

এই প্রশ্নগুলোর উত্তরই আমরা খুঁজে দেখার চেষ্টা করব এই নিবন্ধে। 

কাদিযাদেলি সিলসিলা: উৎসের দিকে ফিরে দেখা

ঈসায়ী ১৬ শতকের তুর্কি। সুবিশাল ও প্রতাপশালী একটি ইসলামী সাম্রাজ্য। কেবল সামরিক দিক দিয়েই নয়, জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক ভাবেও অত্যন্ত অগ্রসর একটি রাষ্ট্র। অথচ নিদারুণ পরিতাপের বিষয় যে ইসলামের ভ্যানগার্ড রাষ্ট্রটির গোঁড়ায় তখন বিদআত বা দ্বীনের ভেতর নব আবিষ্কৃত বিষয়ের বিষদাঁতের দগদগে ক্ষত। কেবল আমল নয়, বিদআত তার ডালপালা ছড়িয়ে দিয়েছে আকিদাহ পর্যন্ত। মানুষ সূফী দরবেশদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ওয়াজদাতুল উজুদের নামে pantheism বা সর্বেশ্বরবাদে আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন দিকে। 

যিকরের নামে দাওয়ারান/Sufi whirling/رقص صوفي /সূফী নাচ প্রচলিত ছিল। এসময় তাসাউফ বা আত্মশুদ্ধি চর্চা এক ভিন্ন মোড় নিয়েছিল। বিভিন্ন তরিকা নিজস্ব পদ্ধতির প্রচলন ঘটিয়েছিল। তরিকা বা order গুলো নিপাট ভদ্রতার সাথে দেখাতে চাইতো এগুলো কেবল কিছু একাডেমিক পদ্ধতিমাত্র, যা মানুষের আত্মশুদ্ধির নিমিত্তে, শরীআতের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ। অথচ এই চোরাগলি কাজে লাগিয়ে এমন সব তরিকার আবির্ভাব ঘটেছিল যারা রীতিমত ভিন্ন ধাঁচের ধর্মপদ্ধতিই চালু করেছিল, যাদের আকিদাহ ছিল ইসলাম থেকে ভিন্ন, যাদের আমল ছিল ইসলাম থেকে দূরবর্তী। অথচ মানুষ এদের ধোঁকায় আক্রান্ত ছিল, আর এই সুযোগে এরা ইসলামের নাম ভাঙিয়ে অবলীলায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল। 

এমনই এক তরিকা ছিল আলাউই বেকতাশী বা Alevi-Bektashi তরিকা, যা ঈসায়ী ১৩ শতকের ব্যক্তিত্ব হাজ্বী বেকতাশ ওয়ালী (Haji Bektash Veli)কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত।  এরা মূলত ছিল শীয়াদের একটা ফির্কা। তবে নিজদের একটা সূফী তরিকা হিসেবে জাহির করত। এরা আল্লাহ (হক)-মুহাম্মাদ-আলী মিলে একধরণের ত্রিত্ববাদে বিশ্বাসী ছিল। তাদের মতে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও আলী (রা.) ছিলেন হক-এর নূরের বহিঃপ্রকাশ। এছাড়া এরা তাওরাত, যাবূর ও ইঞ্জিলের নামে প্রচলিত Old ও New Testament এ কেবল বিশ্বাসীই নয়; তারা মনে করে এগুলোও প্রায়োগিক। 

আমরা যখনকার কথা আলোচনা করছি তখন উসমানী সুলতানদের একটি শক্তিশালী ব্যক্তিগত বাহিনী ছিল যার নাম ছিল জানিসারি। এই জানিসারি বাহিনীর অফিসিয়াল অনুসরণীয় তরিকা ছিল আলাউই-বেকতাশী তরিকা। ১৮২৬ সালে সুলতান ২য় মাহমুদ কর্তৃক নিষিদ্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত এরা জানিসারি বাহিনীর ওপর প্রভাব বজায় রেখেছে, সেই সাথে তুর্কিদের জাত শত্রু ইরানের শীয়া সাফাভি সাম্রাজ্যের স্বার্থ রক্ষা করে গিয়েছে। ১৮২৬ সালে সুলতান আলাউই-বেকতাশী তরিকাকে গোটা উসমানী সাম্রাজ্যে নিষিদ্ধ করেন এবং জানিসারি বাহিনী ভেঙে দেন। 

১৬ শতকে যখন জানিসারি বাহিনী ছিল অত্যন্ত প্রভাবশালী ঠিক তখন এই বাহিনী প্রভাবিত হচ্ছিল এরকম ভয়ঙ্কর কুফরি আকিদাহ লালনকারী দল দ্বারা। এর ফলে সাধারণ মানুষও প্রভাবিত হচ্ছিল। ফলে বিভিন্ন শির্ক-কুফর ও বিদআত ছড়িয়ে পড়ছিল।

এছাড়া ছিল মেভলেভি, খালওয়াতিয়া, নকশবন্দী, শাযেলি ও অন্যান্য বহু তরিকা।

ঠিক তখন দু জন মহান আলিম এগিয়ে আসেন উসমানী সাম্রাজ্যের মানুষের আকিদাহ রক্ষায়, তাদের দ্বীন-ঈমান রক্ষায় এবং তাদেরকে শির্ক-কুফর-বিদআত থেকে বাঁচিয়ে সমাজ সংস্কারের মহান দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে। তাঁরা ছিলেন:

১) ইমাম মুহাম্মাদ আফেন্দী আল বিরকাউই আল হানাফী [রাহ.]। তিনি ইমাম বিরকাউ বা বিরজিভী (Birgivi) নামেই প্রসিদ্ধ। তাঁর মৃত্যু হয় ১৫৭৩ সালে। 

২) শাইখুল ইসলাম ইমাম আবুস সাউদ আফেন্দী [রাহ.], মৃত্যু ১৫৭৪ সালে। 

তাঁরা উভয়েই ছিলেন হানাফী ফিকহের অনুসারী। ইমাম আবুস সাউদ [রাহ.] ছিলেন উসমানী সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ ধর্মীয় আলিম তথা শাইখুল ইসলাম। তিনি প্রসিদ্ধ তাফসির إرشاد العقل السليم إلى مزايا الكتاب الكريم যা তাফসিরে আবুস সাউদ নামে প্রসিদ্ধ- এর লেখক। 

অন্যদিকে ইমাম বিরজিভী [রাহ.] ছিলেন হানাফী ফিকহের প্রসিদ্ধ ইমাম ও আত তারিকাতুল মুহাম্মাদিয়া কিতাবের লেখক। 

প্রথম জীবনে বায়রামী তরিকার অনুসারী হলেও পরবর্তী পর্যায়ে ইমাম বিরজিভী [রাহ.] অনেক সংস্কারমূলক লেখালেখি করেন। তিনি আকিদাহ, নৈতিকতা ও আত্মশুদ্ধি নিয়ে যেমন লিখেছেন, ঠিক তেমনি তাঁর লেখায় উঠে আসে কুরআন-সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার প্রয়োজনীয়তা। তাঁর লেখায় ইমাম ইবনুল কায়্যিমের [রাহ.] লেখার ছাপ খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁর দিকে সম্পৃক্ত একটি রচনা হচ্ছে “যিয়ারাতুল কুবুর”, এতে কবর যিয়ারাত সম্পর্কিত আলোচনা রয়েছে। গবেষকগণ এই লেখাটিতে ইমাম ইবনুল কাইয়্যিমের [রাহ.] “ইগাসাতুল লাহফান” নামক গ্রন্থের ছাপ খুঁজে পান। 

যেহেতু তিনি নিজে একজন কাজী বা বিচারক, মাতুরিদী-সুফী ব্যক্তিত্ব ছিলেন, সেহেতু তিনি চেষ্টা করেছেন সমাজের মূলধারার ভেতরে থেকে সূফীবাদের নামে যেসব ঈমান নষ্টকারী কার্যকলাপ চালু হয়েছে তা সংশোধন করতে। তাঁর লেখনী পরবর্তীকালে গড়ে উঠা একটি সংস্কার আন্দোলনের পাথেয় হয়ে ওঠে।

এদিকে ইমাম আবুস সাউদ [রাহ.] শাইখুল ইসলাম হিসেবে ফাতাওয়ার মাধ্যমে সংস্কারে উদ্যোগী হলেন। তিনি সূফী নাচের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বললেন কেউ যদি সূফী নাচকে ইবাদাত মনে করে তাহলে সে “কুফর” করবে। আর কেউ যদি মনে করে যে এটা নিছক একটা জায়েয কাজ তাহলে সে “গোমরাহ”। ইমাম আবুস সাউদ [রাহ.] ইরানের ইসনা আশারিয়া সাফাভীদের বিদ্রোহী ও কাফের ঘোষণা দিয়ে এদের বিরুদ্ধে জিহাদের ফাতাওয়া দেন।

এই দুই আলিমের শিক্ষা ও লেখনীর ওপর ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে একটি সংস্কার আন্দোলন, ইতিহাসে যা “কাদিযাদেলী” আন্দোলন নামে প্রসিদ্ধ। 

গঠন পর্যায়

ইমাম বিরজিভীর [রাহ.] ছাত্রদের হাতে গড়া আলিম ছিলেন কাদিযাদে মেহমেদ এফেন্দী আল হানাফী [রাহ.], তার মৃত্যু হয় ১৬৩৫ সালে। তিনি ছিলেন একজন আলিম, খতিব ও মুদাররিস। তিনি প্রখ্যাত সুলায়মানিয়া ও আয়া সোফিয়া মসজিদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পূর্বসুরিদের অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করতে এগিয়ে আসেন। তিনি এত শক্তভাবে সমাজ সংস্কারে হাত দেন যে গুরুশিষ্য ক্রমে যে শিক্ষার প্রচার হচ্ছিল তা একটি আন্দোলনের রূপ লাভ করে। যদিও এর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ইমাম বিরজিভীর [রাহ.] নামে নেয়া যায়, কিন্তু এর কাঠামোগত রূপ দানের কারণে আন্দোলনটি শাইখ কাদিযাদে মেহমেদের নামানুসারে কাদিযাদেলী নামে প্রসিদ্ধ হয়ে যায়। এ রকম নামকরণের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্য ছিল এটা দেখানো যে এটা মূলধারা বিচ্যুত একটা নতুন উদ্ভূত দলমাত্র, যেভাবে ‘মুওয়াহহিদীন’ আন্দোলনকে ‘ওয়াহাবী’ নামকরণ করা হয়। 

তবে আন্দোলনের সাথে যুক্ত ব্যক্তিরা নিজেদের fakihler বা ফুকাহা নামে ডাকতেই পছন্দ করতেন। 

শাইখ কাদিযাদে আকিদাহ, ফিকহ এবং বিদআত বিষয়ে প্রচুর লেখালেখি করেন। বিশেষ করে কবর কেন্দ্রিক বিদআতকে তিনি কঠোরভাবে আক্রমণ করেন। তিনি শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবন তাইমিয়্যার [রাহ.] ভূয়সী প্রশংসা করেন। 

শাইখ কাদিযাদে তাঁর আন্দোলনে তৎকালীন উসমানী সুলতান ৪র্থ মুরাদের পূর্ণ সমর্থন লাভ করেন। তিনি রাষ্ট্র শাসন সংক্রান্ত শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যার [রাহ.] রচনাবলী অনুবাদ করে সুলতান মুরাদকে প্রদান করেন। সুলতান মুরাদ এসময় জানিসারী বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে আনতে চেষ্টা করছিলেন, যারা বেপরোয়া, লাগামছাড়া ও দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে পড়েছিল। এক্ষেত্রে এটাও স্মর্তব্য যে এদের দুর্নীতির অন্যতম কারণ ছিল এদের ধর্মীয় বিশ্বাস। আলাউই-বেকতাসীরা তো দূরের বিষয় খালাওয়াতী সূফীরা পর্যন্ত ঘুষ গ্রহণকে না-জায়েয মনে করত না। 

শাইখ কাদিযাদে [রাহ.] প্রথম জীবনে খালওয়াতী সূফী তরিকার অনুসারী হলেও পরে এ থেকে বের হয়ে আসেন এবং কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক সংস্কার ও আত্মশুদ্ধির ওপর জোর দেন। এসময় প্রখ্যাত খালওয়াতী সূফী  Abdülmecid Sivasiও সুলতান মুরাদের সহায়তা পেতেন। শাইখ কাদিযাদে [রাহ.] তার সাথে ইলমী বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন, যা ছিল ইতিহাস খ্যাত। 

এই বিতর্ক বেশ কিছু বিষয়কে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয়। এগুলো হচ্ছে:

১) সামা তথা আধ্যাত্মিক গানের সময় যিকর ও সঙ্গীত একত্রে করা কি জায়েয, অর্থাৎ সঙ্গীতময় সামার শুনতে শুনতে কি যিকর করা যাবে?

২)  খিদর [আ.] কি জীবিত আছেন?

৩) ফিরআউন কি ঈমানদার হিসেবে মারা গিয়েছিল (অনেক সূফী এমনটা মনে করে থাকে)?

৪) সুফী মুহিউদ্দীন ইবনুল আরাবীকে কি কাফির বলা হবে?

৫) (প্রচলিত বিদআতী পদ্ধতিতে) কবর জিয়ারত কি জায়েয?

৬) সালাতুর রাগায়েব, বারায়েহ ও কদরের রাতে কি জামাআতের সাথে সালাত আদায় করা যাবে?

৭) সালাতের পর মুসাহাফা করা, হাতে চুমু দেয়া, দেখা হলে একে অপরের উদ্দেশ্যে বাউ করা কি জায়েয?

৮) আযানের সময় মিলাদ পড়া, বিশেষ কবিতা যেমন ওয়াসিলাতুন নাজাত কি পড়া যাবে? পবিত্র কুরআন কি মাকামাতের সাথে তিলাওয়াত করা যাবে?

৯) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাবা ও মা কি মু’মিন অবস্থায় মারা গিয়েছিলেন?

১০) ইয়াদিযকে লানত দেয়া কি জায়েয?

১১) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর উদ্ভূত বিদআতের ওপর কি আমল করা যাবে? 

১২) ঘুষ গ্রহণের বিধান কী ইত্যাদি। 

এই বিষয়গুলোতে শাইখ কাদিযাদে [রাহ.] নেতিবাচক অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। এথেকে বোঝাই যায় যে উনি মূলত সেই সংস্কারবাদী ধারাকেই উস্তায পরম্পরায় বহন করছিলেন যা সালাফের যুগ থেকে নিয়ে, শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ হয়ে তাঁর কাছে পৌঁছেছিল। 

শাইখ কাদিযাদে [রাহ.] অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বিভিন্ন বিদআতের বিরোধিতা করে যাচ্ছিলেন। এক্ষেত্রে তাঁর সাথে তাঁর ছাত্র ও ভক্তকুলও যুক্ত ছিল। রাষ্ট্রীয় উচ্চ অবস্থানে থাকায় দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রভাব বিস্তার করা তাঁর জন্য অনেকটাই সহজ ছিল। সেসময় দেশের মসজিদগুলোর মিম্বার হয় তাঁর পক্ষে নয় তাঁর বিপক্ষে কথা বলছিল। 

সমকালীন বড় ফিতনা কবর কেন্দ্রিক বিদআতের বিরুদ্ধে তিনি শক্ত অবস্থান নেন। এক্ষেত্রে তিনি পূর্বসুরি ইমাম বিরজিভীকে [রাহ.] অনুসরণ করছিলেন। ইমাম বিরজিভীর [রাহ.] গ্রন্থ “যিয়ারাতুল কুবুরে” একথাও ছিল যে কবর যিয়ারাত কখনো এমন কুফরি পর্যায়েও পৌঁছাতে পারে যখন ব্যক্তির জান ও মাল হালাল করে দেয়া যায়। 

শাইখ কাদিযাদে [রাহ.] যিয়ারাতুল কুবুর ও ইমাম ইবনুল কাইয়্যিমের [রাহ.] লেখা ইগাসাতুল লাহফানকে সংক্ষেপণ করে লেখেন “ইরশাদুল উকুল” নামক গ্রন্থ। তৎকালে কবর যিয়ারাতের যেসব বিদআতী প্রথা ছিল সেগুলোকে তিনি আইয়্যামে জাহিলিয়াতের প্রথা বলে মনে করতেন। 

তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ আমরা শতাব্দি পেরিয়ে শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহহাবের [রাহ.] লেখায় খুঁজে পাই। 

উন্নয়ন পর্যায়

কাদিযাদেলী আন্দোলন যার হাত ধরে উন্নয়নের চূড়ায় পৌঁছায় তিনি ছিলেন শাইখ মুহাম্মাদ বিন আহমাদ আল উস্তুওয়ানী [রাহ.]। তাঁর মৃত্যু হয় ১৬৬১ সালে। তিনি ছিলেন সেই আলিম যার সাথে একাধিক সূত্রে শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহহাবের [রাহ.] ইলমী সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়। 

শাইখ উস্তুওয়ানীর [রাহ.] জন্ম ১৬০৮ সালে, দামেস্কে। পারিবারিক ও প্রাথমিক শিক্ষাগতভাবে ছিলেন হাম্বলী ফিকহের অনুসারী। ইলম অর্জনের এক পর্যায়ে তিনি শাফিঈ হন, এবং শাফিঈ ফিকহেও বুৎপত্তি অর্জন করেন। ইলম অর্জন করেন সিরিয়া ও মিসরে। এরপর তিনি ইস্তাম্বুলে যান। সেখানকার কাদিযাদেলী আলিমদের কাছে ইলম অর্জনের মাধ্যমে হানাফী ফিকহ গ্রহণ করে নেন। এভাবে এ আলিমে দ্বীন ৩টি ফিকহেই বুৎপত্তি অর্জন করেন। তিনি আন্দোলনের নেতৃত্বের আসনে বসেন। তাঁর মত জ্ঞানী ব্যক্তির নেতৃত্বে আন্দোলন অত্যন্ত বেগবান হয়। 

তিনি ক্রমান্বয়ে আয়া সোফিয়ায়, সুলতান আহমেদ ও সুলতান মুহাম্মাদ আল ফাতিহ মসজিদের দায়িত্ব পালন করেন। ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে এক পর্যায়ে তাঁকে রাজ প্রাসাদের এলিট গার্ডদের শিক্ষক নিযুক্ত করা হয়। 

সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে এরপর তিনি সুলতান মুহাম্মাদ ৪র্থ এর শাইখ নিযুক্ত হন। 

শাইখ উস্তুওয়ানীর [রাহ.] সময় এই আন্দোলন এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে। এর আগে আন্দোলনের আলিম ও কর্মীদের কাজ ছিল কেবলই নসিহত করা, মাঝে মধ্যে সরকারকে প্রভাবিত করে কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ানো। কিন্তু এই বার আন্দোলন সরাসরি আমর বিল মারূফ তথা সৎ কাজের আদেশদান ও নাহি আনিল মুনকার তথা অসৎ কাজে বাঁধা দানের দায়িত্বে এগিয়ে আসে। এই পর্যায়ে কাদিযাদেলী আন্দোলনকে আমরা ওয়াহাবী আন্দোলনের মত কার্যক্রমে সম্পৃক্ত দেখতে পাই। 

শাইখ উস্তুওয়ানী [রাহ.] বিদআতের বিরুদ্ধে অত্যন্ত সোচ্চার ও অনমনীয় ছিলেন; এছাড়া তিনি প্রয়োজনে সরকার সমর্থিত বল প্রয়োগের মাধ্যমে বিদআত প্রতিহতের পক্ষপাতিও ছিলেন। 

শাইখ তাঁর কিতাব “রিসালায়” শির্কের বিভিন্ন ধরণ নিয়ে আলোচনা করে মানুষকে সতর্ক করেন। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল তিনি এর মধ্যে ইস্তিগাসার শির্ক বা মৃত ব্যক্তিকে আহ্বান করে সাহায্য চাওয়ার শির্ক সম্পর্কে আলোচনা করেন। তিনি এটাও উল্লেখ করেন যে পাথর, গাছ ও কবরের নামে মানত করা, এগুলোর উদ্দেশ্যে কুরবানি করা কুফর, এবং এর ফলে অনন্তকাল জাহান্নামে জ্বলা লাগবে। 

শাইখের অনুরূপ আলোচনাই আমরা শতাব্দি পেরিয়ে শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহহাব [রাহ.] লিখিত “কিতাবুত তাওহিদে” দেখতে পাই।

১৬৫০-৫১ সাল নাগাদ শাইখ উস্তুওয়ানী [রাহ.] সালতানাতের প্রধান উজিরকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হন এবং তাঁর মাধ্যমে খালওয়াতী সূফিদের একটি খানকা ধ্বংস করার শাহী ফরমান লাভে সমর্থ হন । উল্লেখ্য যে এই ধ্বংস কর্মটি শাহী ফরমান বলে কাদিযাদেলী আন্দোলনের কর্মীরাই বাস্তবায়ন করেন। 

এসময় আরও খানকা ধ্বংসের জন্য ফরমান জারির চেষ্টা করা হয়, কিন্তু অন্যান্য আলিমরা যেহেতু বল প্রয়োগে বিদআত দূর করার পক্ষে ছিলেন না এজন্য রাজকীয় ফরমান লাভ সম্ভব হয়নি। 

এসময় একটা মজার ঘটনা ঘটে। খালওয়াতী সূফীরা বুঝতে পারে যে এসব কথিত “নষ্টের” গোড়া হচ্ছে ইমাম বিরজিভীর [রাহ.] লেখনী, বিশেষ করে “আত তারিকাতুল মুহাম্মাদিয়্যাহ”। দুজন খালওয়াতী সূফী এই গ্রন্থকে রদ করে গ্রন্থ প্রণয়ন শুরু করে। শাইখ উস্তুওয়ানী [রাহ.] এবং তাঁর অনুসারীরা এই বিষয়টা সুলতানের কাছে তুলে ধরেন। ফলে সুলতানের উদ্যোগে সাম্রাজ্যের শাইখুল ইসলামের নেতৃত্বে সর্বোচ্চ উলামা কাউন্সিল ফাতাওয়া জারি করেন যে শাইখ বিরজিভী [রাহ.] এবং তাঁর লেখনির সমালোচনামূলক কোনো কাজ উসমানী সাম্রাজ্যে করা যাবে না। 

ঘটনা প্রবাহ আমাদের সামনে এটা স্পষ্ট করে দেয় যে, অন্তত তখন পর্যন্ত উসমানী সাম্রাজ্যের মূলধারার উলামা এবং শাসককূল এই আন্দোলনের সাথে একাত্ব ছিলেন। অবশ্য ধর্মীয় বিষয়ে রাষ্ট্র যথাসম্ভব কম বল প্রয়োগে আগ্রহী ছিল। 

১৬৫৬ সালে একটা বড় পটপরিবর্তন আসে। এসময় Köprülü Mehmed Pasha সাম্রাজ্যের নতুন প্রধান উজির পদে নিযুক্ত হন। 

এসময় শাইখ উস্তুওয়ানী [রাহ.] একটা নতুন প্ল্যান নিয়ে আগান। তাঁর প্ল্যান ছিল:

১) সুলতান মুহাম্মাদ ৪র্থ- এর ক্ষমতা সুদৃঢ় করতে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সমর্থন শক্তিশালী করা,

২) এরপর যত বিদআত চালু হয়েছে সেগুলোকে নির্মূল করা,

৩) সূফীদের খানকাগুলো ধ্বংস করে দেয়া,

৪) প্রতিপক্ষ কাট্টা বিদআতীদের এই অবস্থানে নেয়া, যে হয় তাঁরা ঈমান নবায়ন করে এসব শির্ক-কুফর পরিত্যাগ করবে, নয় মৃত্যুকে বেছে নেবে। 

এসব উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কাদিযাদেলীরা ফাতিহ মসজিদের কাছাকাছি সশস্ত্র অবস্থান গ্রহণ করেন। তাদের লক্ষ্য ছিল সংস্কারের জন্য গণ-জমায়েত ঘটাবেন এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। 

এসময় নবনিযুক্ত প্রধান উজির আলিমদের একটা কাউন্সিল ডেকে ফাতাওয়া জারি করালেন যে এই ধরণের উত্তেজক কর্মকান্ড মৃত্যু দণ্ডের শাস্তি পাবার উপযুক্ত অপরাধ। তবে মৃত্যুদণ্ড কাউকে দেয়া হয়নি; বরং শাইখ উস্তুওয়ানী ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে সাইপ্রাসে নমনীয় নির্বাসনে পাঠানো হয়। শাইখ উস্তুওয়ানী [রাহ.] সেখান থেকে ১৬৫৬ সালে দামেস্কে ফিরে আসেন। দামেস্কে তিনি প্রসিদ্ধ উমাইয়্যা জামে মসজিদে দর্স দেয়া শুরু করেন। এরপর তিনি সালিমিয়্যাহ মাদ্রাসাতেও শিক্ষকতা করেন। কিছুদিন পর তিনি মারা গেলে তাঁর সন্তান ও সুযোগ্য উত্তরসূরী শাইখ মুস্তাফা আল উস্তুওয়ানী [রাহ.] উমাইয়্যা জামে মসজিদের প্রধান মুদাররিসের পদ অলঙ্কৃত করেন। 

এর মাধ্যমে কাদেযাদেলী আন্দোলনে ইস্তাম্বুল থেকে সাইপ্রাস হয়ে দামেস্কে এসে পৌঁছায়। আমরা সামনে দেখব যে আন্দোলনের শিক্ষা মিসরেও পৌঁছাতে দেরি করেনি। 

শাইখ উস্তুওয়ানীর [রাহ.] শিক্ষা ও কর্মপন্থার সাথে শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহহাবের [রাহ.] শিক্ষা ও কর্মপন্থার যথেষ্ট মিল খুঁজে পাওয়া যায়। আমরা সামনে দেখব যে কিভাবে শাইখ মুহাম্মাদ [রাহ.] শাইখ উস্তুওয়ানীর [রাহ.] শিক্ষা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। শাইখ উস্তুওয়ানীর [রাহ.] বড়জোর ৮০ বা ৯০ বছর পর আমরা তাঁর কর্মপন্থাকে নজদের ভূমিতে বাস্তবায়িত হতে দেখবো। 

উসমানী সাম্রাজ্যের প্রধান উজির কোপুরুলুর কর্মপন্থা দেখতে মনে হয় উনি বোধহয় এই আন্দোলনের বিপক্ষে ছিলেন, এবং নির্বাসন দণ্ডের মাধ্যমে আন্দোলনের শক্তি শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আদতে সেটা ঘটেনি। আসলে সাম্রাজ্যের প্রধান উজির হিসেবে কোপরুলু সকল ধরণে গণনৈরাজ্যের বিরুদ্ধে ছিলেন। সেসময় কাদিযাদেলী আন্দোলন ও বিদআতীদের সংঘাত থামিয়ে দেশকে স্থিতিশীল রাখা জরুরি ছিল। এজন্য তিনি আন্দোলনের কিছু নেতাকে নির্বাসন নামক লঘু দণ্ড দেন, অন্যদিকে বিদআতীদের কঠোর সাজা দেন। তিনি বেশ কিছু সূফী নেতাকে মৃত্যুদণ্ড দেন আর অনেকগুলো বিদআতের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। 

এসময় ইস্তাম্বুল ভ্রমণ করা ইউরোপীয় টি. স্মিথ জানান যে উজির কোপরুলু সূফীদের নাচকে নিষেধ করে থাকেন। 

শীঘ্রই আন্দোলন একজন নতুন শক্তিশালী নেতা আর একজন শক্তিশালী সমর্থক খুঁজে পায়। 

পতন পর্যায়

উজির কোপরুলুর পর প্রধান উজির নিযুক্ত হন তাঁর সুযোগ্য সন্তান কোপরুলু ফাযিল আহমেদ পাশা। এসময় কাদিযাদেলী আন্দোলনের নেতৃত্বে আসেন শাইখ সায়্যিদ ভানি মেহমেদ এফেন্দী [রাহ.]। তাঁর মৃত্যু হয় ১৬৮৫ সালে। উভয়ের যৌথ নেতৃত্বে আন্দোলন অত্যন্ত শক্তিশালী পর্যায়ে পৌঁছায়। তবে এর মাধ্যমে এর পতনও ত্বরান্বিত হয়। কোপরুলু যুগ, অর্থাৎ পিতা ও পুত্রের মন্ত্রীত্বকালে একদিকে উসমানী সাম্রাজ্য তার আয়তনে সুবিশাল হয়, অন্যদিকে সাম্রাজ্যে কাদিযাদেলী আলিমদের নীতিমালাসমূহ প্রযুক্ত হতে থাকে। 

শাইখ ভানির জন্ম আধুনিক পূর্ব তুরস্কের ভান প্রদেশের ভান শহরে। ইলম অর্জনের পর আলিম ও দাঈ হিসেবে তিনি এরজুরাম, ইস্তাম্বুল ও বুরসায় দায়িত্ব পালন করেন। ইস্তাম্বুলে তিনি সুলতান সেলিম মসজিদ কেন্দ্রিক দাওয়াহ কাজে যুক্ত ছিলেন। উজির হবার আগেই ফাযিল আহমেদের সাথে তাঁর বন্ধত্ব হয়, যা বাকি জীবন অটুট ছিল। 

১৬৬১ সালে ফাযিল আহমেদ প্রধান উজির হন। এদিকে শাইখ ভানিও সুলতান মুহাম্মাদ ৪র্থ-এর এবং তাঁর সন্তানদের শিক্ষক হিসেবে রাজকীয় শিক্ষক নিযুক্ত হন। শাইখ উস্তুওয়ানীর মত তিনিও ছিলেন সুলতানের শাইখ। 

শাইখ ভানি [রাহ.] সুলতানকে প্রভাবিত করে চলমান সূফী নাচ ও কবরকেন্দ্রিক বিদআত বন্ধের উদ্যোগ নেন। ১৬৬৮ সালে শাইখ ভানি সুলতান ও প্রধান উজিরের সমর্থনে একটি বেকতাশী মাজার ধবংসে সক্ষম হন। এসময় জানিসারী বাহিনীর ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণ নেয়ার ব্যাপারে আহলুস সুন্নাহর কাদিযাদেলী ও শীআ আলাউই বেকতাশী ফির্কার মাঝে শক্তিশালী বিরোধ ছিল। 

১৬৭১ সালে একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে, যার ফলে আন্দোলনের চিন্তাধারা ও শিক্ষা ইস্তাম্বুল পেরিয়ে মক্কা-মদীনায় প্রতিষ্ঠিত হবার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এ বছর প্রধান উজির কোপরুলু ফাযিল আহমেদের সাথে মরক্কোর প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ শাইখ মুহাম্মাদ বিন সুলাইমান আল মাগরিবীর [রাহ.] সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। শাইখ মাগরিবী [রাহ.] ১৬৮৩ সালে মারা যান। শাইখ মাগরিবী অন্যান্য কাদিযাদেলী আলিমদের মতই প্রথম জীবনে তাসাউফ প্রভাবিত ছিলেন এবং শাযিলী তরিকায় দীক্ষিত ছিলেন। শাইখের সাথে প্রধান উজিরের সুসম্পর্ক কায়েম হবার এক বছরের মাথায় তিনি হারামাইন শরীফাইনের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এসময় তিনি সুলতান কর্তৃক ডিক্রিপ্রাপ্ত হয়ে হারামাইনে প্রচলিত বেশ কিছু বিদআতী কার্যক্রমকে নিষিদ্ধ করে দেন। শাইখ মাগরিবী [রাহ.] ইস্তাম্বুল থেকে জারিকৃত কাদিযাদেলী আন্দোলন প্রভাবিত সংস্কার কার্যক্রমকে সাফল্যের সাথে হারামাইনে জারি করেন। 

১৬৭৬ সালে উজির ফাযিল আহমেদ মারা যান, কিন্তু শাইখ ভানির [রাহ.] নেতৃত্বে তুরস্কে আর শাইখ মাগরিবীর [রাহ.] নেতৃত্বে হারামাইনে কাদিযাদেলী আন্দোলন চলমান থাকে। এসময় ফাযিল আহমেদের মেয়ের জামাই কারা মুস্তাফা পাশা সালতানাতের প্রধান উজির নিযুক্ত হন। 

এরপর এমন এক ঘটনা ঘটে যা আন্দোলনের মোড় ঘুড়িয়ে দেয়, একইসাথে উসমানী সালতানাতের পতনের ঘন্টাও বাজিয়ে দেয়। 

পতনকাল

১৬৮৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ইতিহাসখ্যাত ভিয়েনা যুদ্ধ সংঘটিত হয়। উসমানী সালতানাত ভিয়েনা দখলে আগ্রহী ছিল বহুকাল ধরেই। কেননা ভিয়েনা হাতে এলেই উসমানী সাম্রাজ্য পূর্ব ইউরোপ থেকে পশ্চিম ইউরোপে অগ্রসর হতে পারত। এর আগে সুলতান সুলাইমান কানুনী ভিয়েনা অভিযান করলেও সিগেটভার অবরোধে ব্যর্থ হওয়ায় আর সামনে এগুতে পারেন নি। 

এবার উসমানী সাম্রাজ্য উদ্দীপ্ত হয়ে ভিয়েনায় আক্রমণ চালায়। কারা মুস্তাফার নেতৃত্বে দেড় লাখ সেনা এই অভিযানে অংশ নেয়। এসময় শাইখ ভানিকে [রাহ.] সেনাবাহিনীর উদ্দীপনা বাড়ানোর জন্য তাদের ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। 

বিপক্ষ দিকে পুরো খৃষ্টীয় শক্তি একত্রিত হয় যা হোলি লীগ নামে প্রসিদ্ধ। এতে হোলি রোমান এম্পায়ার, পোল্যান্ড, ব্যাভারিয়া, স্যাক্সোনি প্রভৃতি খৃষ্টান রাজ্যের সমন্বয়ে ৯০ হাজারের মত সেনা অংশ নেয়। 

দুর্বল সামরিক পরিকল্পনা, দুর্বল নেতৃত্ব, অফিসারদের মধ্যে একতার অভাব প্রভৃতি মিলিয়ে এই যুদ্ধ উসমানীদের জন্য ছিল একটা চরম সামরিক ব্যর্থতার নজির। এই যুদ্ধে প্রায় ৫০ হাজারের মত সেনা হতাহত হয় এবং উসমানী বাহিনী চরমভাবে পরাজিত হওয়ার মাধ্যমে ইউরোপের পরাশক্তির অবস্থান  থেকে ছিটকে পড়ে। এই যুদ্ধের পর লাগাতার ১৬ বছর যুদ্ধবিগ্রহ শেষে উসমানীরা হাঙ্গেরি ও ট্রান্সিলভানিয়া অঞ্চল ছেড়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ হিসেবে এই পরাজয় ছিল উসমানীদের লাগাতার পতনের সূচনা।

যুদ্ধ শেষে কারা মুস্তাফা পাশাকে ব্যর্থতার দায়ে ২৫ ডিসেম্বর ১৬৮৩ সালে বেলগ্রেডে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়। 

শাইখ ভানিকে [রাহ.] বুরসার কাছে তাঁর নিজস্ব এলাকায় নির্বাসন দেয়া হয়। তিনি ১৬৮৫ সালে সেখানে মারা যান। কোনো কোনো বর্ণনা থেকে জানা যায় তিনি সেখানে শত্রুর হাতে নিহত হন। 

ভিয়েনার পরাজয়ের ফলে কাদিযাদেলী আন্দোলনের মূল সমর্থক কারা মুস্তাফা পাশা নিহত হন, আন্দোলনের অন্যতম সমর্থক সুলতান মেহমেদ ৪র্থ খুবই অজনপ্রিয় হয়ে পড়েন, ফলে একটি সামরিক অভ্যুত্থানে ১৬৮৭ সালে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন, অন্যদিকে এর আধ্যাত্মিক নেতা শাইখ ভানি [রাহ.] নির্বাসিত জীবনে মারা যান। আলাউই-বেকতাশী প্রভাবে জানিসারী বাহিনী আন্দোলনের বিরোধী তো আগে থেকেই ছিল, এবং একে ধ্বংস করার পথ খুঁজে বেড়াচ্ছিল। হিজাজে শাইখ আল মাগরিবী [রাহ.] রাজনীতিতে অধিক হস্তক্ষেপের ফলে আরও আগেই অজনপ্রিয় হয়ে ক্ষমতা হারান, তাঁকে ১৬৮২ সালে দামেস্কে নির্বাসন দেয়া হয়, সেখানেই এক বছর পর তিনি মারা যান। 

আমরা দেখতে পাচ্ছি দামেস্ক এভাবে আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের আবাস ও ইলমী ঘাঁটিতে পরিণত হয়। এর আগে শাইখ উস্তুওয়ানী [রাহ.] দামেস্কে শেষ জীবন অতিবাহিত করেন ছাত্র গড়ার কাজে। শাইখ মাগরিবীও শেষ জীবন দামেস্কেই কাটান। ফলে দামেস্ক তাঁদের ঘাঁটিতে পরিণত হয়। এসময় তাঁদের বিরোধী সিরিয়ান সূফীরা তাঁদের বিরুদ্ধে প্রচুর লেখালেখি করেছে, বিশেষ করে দামেস্কের নকশবন্দী হানাফী আলিম আব্দুল গনী নাবলুসীর কথা উল্লেখ করা যায়। 

পূর্বে উল্লেখিত ইস্তাম্বুলের খালওয়াতী সূফীদের মত আন নাবলুসীও খুঁজে বের করেন যে সমস্যার গোড়া হচ্ছে ইমাম বিরজিভীর [রাহ.] কিতাব। তবে তিনি এই গ্রন্থের রদ বা খণ্ডন লেখার ভুলটা করেন নি; বরং তিনি “আল হাদিকাতুন নাদিয়্যাহ” নামে আত তারিকাতুল মুহাম্মাদিয়্যার একটা ব্যাখ্যাগ্রন্থ লিখে সাপের বিষদাঁত উপড়ানোর চেষ্টা করেন। এছাড়া ধূমপান, উচ্চস্বরে যিকর ও সঙ্গীত সম্পর্কেও তিনি লেখালেখি করেছেন। “কাশফুন নূর আন আসহাবিল কুবূর” নামক গ্রন্থ লিখে তিনি প্রমাণের চেষ্টা করেন যে মৃত্যুর পরও মৃত ব্যক্তি বা ওলিরা কারামত দেখাতে পারে এবং বিপদগ্রস্তকে সাহায্য করতে পারে। ১৬৭৩ সালে লেখা এই গ্রন্থে তিনি বিরোধীপক্ষকে কুফরের অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। 

কাদিযাদেলী সিলসিলা যে বরাবর সিরিয়ায় চালু ছিল তা বোঝার ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ দলীল হচ্ছে ১৭৩০ সালে আন নাবলুসীর কাছে আলেপ্পো থেকে একজন চিঠি লিখে সেই ব্যক্তির বিধান জানতে চায় যে বলে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মারা গিয়েছেন এবং তাঁর সাহায্য এখন আর চলমান নেই, এজন্য তাঁকে ইয়া রাসূলাল্লাহ মাদাদ বলে, তাঁর কাছে সাহায্য চাওয়া যাবে না। আর এটা যে বলে সে একজন গুরুত্বপুর্ণ কাদিযাদেলী ব্যক্তিত্ব। 

উত্তরে আন নাবলুসী বলেন যে, এই লোক এই কথার দ্বারা রাসূলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুওয়্যাতের ধারাবাহিকতাকে অস্বীকার করায় কাফির! 

এই ঘটনাটা শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহহাবের [রাহ.] দাওয়াহ শুরু করার মাত্র এক দশক আগের। এর ফলে বোঝা যায় যে এই পতনকালেও সিরিয়ায় কাদিযাদেলী আন্দোলন চলমান ছিল। বিশেষ করে আলেপ্পোর কাদিযাদেলী আলিম সানাউল্লাহ আল হালাবীর [রাহ.] কথা বলা যায়, যিনি আন নাবলুসীকে রদ করে গ্রন্থ লেখেন। তাঁর মৃত্যু হয় ১৭০৮ সালে। 

শাইখ সানাউল্লাহর লেখা থেকে প্রতীয়মান হয় যে কাদিযাদেলী আন্দোলনের দূর্বলতার সুযোগে এখন সূফীদের কেউ কেউ উত্থানের চেষ্টা করছে, যা দীর্ঘকাল সাম্রাজ্যে অনুপস্থিত ছিল।  

শাইখ সানাউল্লাহর লেখনীর উল্লেখ প্রথম দিককার নজদী আলিমদের লেখায় পাওয়া যায়। যেমন শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহহাবের [রাহ.] নাতী শাইখ আব্দুর রাহমান বিন হাসান [রাহ.] কিতাবুত তাওহীদের ব্যাখা ফাতহুল মাজীদের ১৬০ পৃষ্টায় লেখেন, 

وقال الشيخ صنع الله ‌الحلبي الحنفي في الرد على من أجاز الذبح والنذر للأولياء: فهذا الذبح والنذر إن كان على اسم فلان فهو لغير الله، فيكون باطلا

“যারা মনে করে যে আওলিয়াদের উদ্দেশ্যে পশু জবাই করা যায় ও মানত মানা যায়, তাদের খণ্ডন করে শাইখ সানাউল্লাহ আল হালাবী আল হানাফী [রাহ.] বলেন,যদি এই জবাই ও মানত অমুকের নামে হয়ে থাকে, তাহলে তা গাইরুল্লাহর জন্য হল, এজন্য এটা বাতিল হবে”।

এতে উভয় আন্দোলনের যোগসূত্র খুব ভালোমতই অনুধাবন করা যায়। 

পতনকালে আন্দোলনের ক্রিয়া

ভিয়েনার পরাজয়ের পর আন্দোলন তার কেন্দ্রীয় অবস্থান হারানোয় ইতিহাসে অনেকটাই অনুক্ত রয়ে যায়। তবে এর মানে এই নয় যে তা একদমই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। কেননা আমরা পেছনে দেখে এসেছি যে সিরিয়ায় তা ভালো মতই ক্রিয়াশীল ছিল। যার সাথে পরে শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহহাব [রাহ.] পরে জ্ঞানগত যুক্ত হন- এটা আমরা সামনে দেখব ইন শা আল্লাহ। 

এসময় সাম্রাজ্যের অন্যত্রও আন্দোলনের প্রভাব চোখে পড়ে। মিসরে একজন কাদিযাদেলী দাঈ ছিল আর রুমী নামে । তিনি আলিম ছিলেন না, সাধারণ তালিবুল ইলম ছিলেন। কিন্তু তিনিই মিসরে এমন এক আন্দোলন গড়ে তোলেন যে ১৭১১ সালে একটা ছোটোখাটো দাঙ্গা বাঁধতে নেয়। 

আর রুমী ইমাম বিরজিভী, আবুস সাউদ ও সানাউল্লাহ হালাবীর [রাহ.] লেখা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তিনি কবর কেন্দ্রিক শির্ক ও বিদআতের বিরোধিতা করেন, আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকারের ওপর জোর দেন, আর যারা এটা করে না তাদেরকে শক্তভাবে তিরস্কার করেন। তিনি দাবি তোলেন যে, সকল সূফী খানকাকে মাদ্রাসায় পরিণত করতে হবে। পেছনে আমি সূফী নাচের ব্যাপারে শাইখুল ইসলাম আবুস সাউদের [রাহ.] ফাতাওয়া উল্লেখ করে এসেছি, আর-রুমী তা ব্যাপকভাবে প্রচার করেন। 

এসময় আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের আলিমরা আর-রুমীকে প্রতিহত করতে এগিয়ে আসেন। তাঁরা ফাতাওয়া দেন যে, কেউ যদি রুমীর মত বিশ্বাস করে যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লাউহে মাহফূয দেখতে পান না, তাহলে শাসকের দায়িত্ব হচ্ছে তাকে শুধরানো। আর না শুধরালে এই কুফরের কারণে তাকে হত্যা করতে হবে! এছাড়া তাঁরা মৃত্যুর পরও ওলীগণ কারামাত দেখাতে পারেন বলে ফাতাওয়া জারি করেন। 

এবার আর রুমী আযহারের শাইখদেরকে তাঁদের শির্কী বিশ্বাসের জন্য কাফির বলে ঘোষণা করেন এবং তাঁর অনুসারীদের একাট্টা করেন। ফলে তাঁর অনুসারী হাজার খানেক তুর্কি সেনা পথে নেমে আসে। অতঃপর সামরিক বাহিনী হস্তক্ষেপ করে এবং আর-রুমী নৌকাযোগে সিরিয়া পালিয়ে যান। এথেকে আমরা এটাও বুঝতে পারি যে সিরিয়ায় কাদিযাদেলীদের যথেষ্ট প্রভাব ছিল বিধায় তিনি সেখানে যেতে মনস্থির করেন। 

শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহহাব ও কাদিযাদেলী আন্দোলন

শাইখ মুহাম্মাদের [রাহ.] ইলমের হাতেখড়ি তাঁর নিজ এলাকাতেই হয়। এরপর তিনি ইলম অর্জন করতে হিজাজ ও ইরাকের বসরা পর্যন্ত সফর করেন। তিনি হাম্বলী ফিকহের কেন্দ্র-দামেস্ক যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু হয়ে ওঠেনি। 

শাইখ মুহাম্মাদের [রাহ.] শির্ক-কুফর-বিদআতের বিরুদ্ধে যে অবস্থান, তা তাঁর নিজ এলাকার আলিমদের থেকে ভিন্ন হলেও কাদিযাদেলী ধারার আলিমদের সাথে বেশ ভালো মতই মিলে যায়। প্রায় সমকালীন ও চিন্তাগত মিলবন্ধন তো বটেই তাঁর সাথে এই ধারার আলিমদের ইলমী সনদও খুঁজে পাওয়া যায়। 

শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহহাব [রাহ.] অনেক আলেমের কাছে পড়লেও হাদিসের ইজাযাহ ৩ জন উস্তায থেকে পেয়েছিলেন:

১) শাইখ আলী আফেন্দী আদ দাগিস্তানী [রাহ.],

২) শাইখ আব্দুল্লাহ ইবন ইব্রাহীম আন নাজদী [রাহ.] এবং

৩) শাইখ আব্দুল লাতিফ আল আহসাই [রাহ.]

এই ৩ জন উস্তাযই দামেস্কে পড়াশোনা করেছেন। উনাদের প্রত্যেকের সনদ ইমাম উস্তুওয়ানীর [রাহ.] হাদিস পাঠচক্রে গিয়ে আবর্তিত হয়, যেমন শাইখ আবুল মাওয়াহিব, তাঁর পিতা আব্দুল বাক্বী এবং মুহাম্মাদ আল বালবানী [রাহ.]। উনারা প্রত্যেকেই ছিলেন হাম্বলী ফিকহের আলিম এবং শাইখ উস্তুওয়ানির দর্সগাহের সাথে সম্পৃক্ত।

 শাইখ মুহাম্মাদের উস্তায শাইখ আব্দুল্লাহ ইবন ইব্রাহীম আন্ নাজদী [রাহ.] ছিলেন শাইখ আবুল মাওয়াহিব [রাহ.] এর ছাত্র, আর শাইখ আবুল মাওয়াহিব [রাহ.] ছিলেন শাইখ মুহাম্মাদ আল উস্তুওয়ানী এবং শাইখ মুহাম্মাদ বিন সুলাইমান আল মাগরিবীর [রাহ.] ছাত্র। এভাবে এই সনদে শাইখ কাদিযাদেলী সিলসিলার আলিমদের সাথে যুক্ত।

অপরদিকে শাইখের অপর এক উস্তায ছিলেন শাইখ মুহাম্মাদ হায়াত সিন্ধী [রাহ.]। শাইখ হায়াত সিন্ধী এমনিতে নকশবন্দী তরিকায় সম্পৃক্ত ছিলেন, তবে অন্ধ তাকলিদের ঘোর বিরোধী ছিলেন। শাইখ হায়াত সিন্ধীর অন্যতম উস্তায ছিলেন শাইখ আবু তাহির কুরানী [রাহ.], শাইখ আবু তাহির ছিলেন শাইখ মুহাম্মাদ বিন সুলাইমান আল মাগরিবীর [রাহ.] ছাত্র। আবার শাইখ আবু তাহিরের পিতা ও উস্তায শাইখ ইব্রাহীম কুরানী [রাহ.] ছিলেন শাইখ আব্দুল বাক্বী আল হাম্বলীর [রাহ.] ছাত্র। এই শাইখ আব্দল বাক্বী ছিলেন শাইখ আবুল মাওয়াহিবের পিতা। এভাবে শাইখে হায়াত সিন্ধীর সনদেও শাইখ মুহাম্মাদ কাদিযাদেলী সিলসিলার আলিমদের শিক্ষার সাথে যুক্ত হন। 

সর্বোপরি এটা মনে রাখতে হবে, সেকালে কাউকে ইজাযাহ দেয়া মানে ছিল: এই ছাত্র যে জ্ঞান অর্জন ও চর্চা করতে যাচ্ছে উস্তায তা অনুমোদন করছেন, আরেক কথায় বলা যায়,ছাত্র উস্তাযের ইলম ধারণে সক্ষম হয়েছেন। 

বিশেষ করে কাদিযাদেলী সিলসিলার ইলমী ও সংস্কারগত সংঘর্ষের সাথে শাইখে মুহাম্মাদের [রাহ.] আন্দোলন, সংস্কার কার্যক্রম ও সংঘর্ষের সাদৃশ্য সুস্পষ্ট। 

আশা করি নিবন্ধের শুরুতে যে প্রশ্নগুলো রেখেছিলাম, সেগুলোর উত্তর পাঠকদের সামনে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। সেই সাথে এটাও বোঝা গেছে কেন দামেস্কের সূফীকূল শাইখের বিরোধিতায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, কেন তাঁর আন্দোলন দমনে সর্বশক্তি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমরা দেখতে পাই যে পরবর্তী যুগের হানাফী-শাফিঈ-মালিকী-হাম্বলী ধারার যে যে আলিমই শাইখ মুহাম্মাদের [রাহ.] বিপক্ষে অভিযোগ ও অপবাদ আরোপ করেছেন তারা সবাই কমবেশি এসব সূফী শাইখদের ইলমী সিলসিলায় যুক্ত। ফলে পূর্বসুরিদের মত একই কাজ তারাও করে গেছেন ও যাচ্ছেন। 

নিঃসন্দেহে ইতিহাসের পাতায় ধূসর হয়ে যাওয়া একটা ছবি আমরা পুনরায় অঙ্কন করতে সক্ষম হলাম-আলহামদুলিল্লাহ। 

শাইখের ইলমী সনদের একটি নমুনা: 

নিবন্ধে ব্যবহৃত তথ্যসূত্রসমূহ:

১) James Muhammad Dawud Currie, Kadizadeli Ottoman Scholarship, Muḥammad ibn ʿAbd al-Wahhāb, and the Rise of the Saudi State, Journal of Islamic Studies, Volume 26, Issue 3, September 2015, Pages 265–288

২) আব্দুল গণী আন নাবলুসীর জীবনী: https://ar.wikipedia.org/wiki/%D8%B9%D8%A8%D8%AF_%D8%A7%D9%84%D8%BA%D9%86%D9%8A_%D8%A7%D9%84%D9%86%D8%A7%D8%A8%D9%84%D8%B3%D9%8A

৩) ভিয়েনার যুদ্ধ: https://en.wikipedia.org/wiki/Battle_of_Vienna#

৪) শাইখ ভানি এফেন্দী সম্পর্কে: https://turkishstudies.net/turkishstudies?mod=makale_ing_ozet&makale_id=18148

৫) কোপরুলু মেহমেদ পাশা সম্পর্কে: https://en.wikipedia.org/wiki/K%C3%B6pr%C3%BCl%C3%BC_Mehmed_Pasha

৬) কাদিযাদে ও সিভাসির মধ্যকার বিতর্ক সম্পর্কে: https://istanbultarihi.ist/532-the-kadizadeli-sivasi-debate

৭) কাদিযাদে মেহমেদের জীবনী: https://en.wikipedia.org/wiki/Kad%C4%B1zade_Mehmed

৮) ইমাম আবুস সাউদ আফেন্দী সম্পর্কে: https://ar.wikipedia.org/wiki/%D8%A3%D8%A8%D9%88_%D8%A7%D9%84%D8%B3%D8%B9%D9%88%D8%AF_%D8%A3%D9%81%D9%86%D8%AF%D9%8A

৯) আলেভিসম/আলাউই সূফী তরিকা: https://en.wikipedia.org/wiki/Alevism

১০) জানিসারী বাহিনী: https://en.wikipedia.org/wiki/Janissary

১১) বেকতাশী তরিকা: https://en.wikipedia.org/wiki/Bektashi_Order

১২) তুরস্কে সূফী তরিকাসমূহ: https://rpl.hds.harvard.edu/faq/sufism-turkey#:~:text=The%20Naqshbandi%20order%2C%20which%20is,%2C%20to%20Bahaeddin%20Nak%C5%9Fibendi%20(d.

১৩) খালওয়াতী তরিকা: https://en.wikipedia.org/wiki/Khalwati_order

১৪) সূফী নাচ: https://en.wikipedia.org/wiki/Sufi_whirling

১৫) সর্বেশ্বরবাদ: https://www.britannica.com/topic/pantheism

১৬) ইমাম বিরজিভী সম্পর্কে: https://ar.wikipedia.org/wiki/%D9%85%D8%AD%D9%85%D8%AF_%D8%A3%D9%81%D9%86%D8%AF%D9%8A_%D8%A7%D9%84%D8%A8%D8%B1%D9%83%D9%88%D9%8A

All links are retrieved on 27th November, 2023. 

১৭) শাইখ আব্দুর রাহমান বিন হাসান আলুশ শাইখ, ফাতহুল মাজীদ, তাহকীক: মুহাম্মাদ হামিদ আল ফাক্বী, মাতবাআতুস সানাতিল মুহাম্মাদিয়্যাহ, কায়রো, মিসর, ৭ম সংস্করণ, ১৩৭৭ হি.