শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহহাবের ব্যাপারে উলামায়ে কিরামের প্রশংসা

শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহহাব [রাহ.] নজদ অঞ্চলে যে সংস্কার আন্দোলনের আওয়াজ তোলেন, তাওহিদের যে দাওয়াহ ছড়িয়ে দেন, মানুষকে শির্ক-কুফর-বিদআত ও কুসংস্কার থেকে বাঁচানোর জন্য যে সংগ্রাম শুরু করেন, তার ফলাফল তিনি আল্লাহর মেহেরবানিতে তাঁর জীবদ্দশায় নজদ অঞ্চলে বাস্তবায়িত হতে দেখেছেন। নিজের হাতে গড়া আন্দোলনের ফসল নিজের জীবদ্দশায় সাধারণত দেখতে পাওয়া যায় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দাঈগণ আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য আন্দোলন শুরু করেন,যার ফল কখনো এক-দুই প্রজন্ম পরে দেখতে পাওয়া যায়, আবার কখনো এই দুনিয়ায় জমিনে তার ফল একেবারেই দেখতে পাওয়া যায় না। তবে আল্লাহর কাছে এর উত্তম প্রতিদান ও পুরস্কার অবশ্যই সংরক্ষিত থাকে। খুব কম ব্যক্তিই নিজের জীবদ্দশায় নিজের হাতে গড়া আন্দোলনের ফলাফল দেখতে সক্ষম হন। শাইখ [রাহ.] ছিলেন এমনই এক বিরল ব্যক্তিত্ব। 

তাঁর আন্দোলনের ফলাফল তাঁর জীবদ্দশাতেই দেখা যাচ্ছিল। নজদ অঞ্চল শির্ক-কুফর-বিদআত ও কুসংস্কারমুক্ত হচ্ছিল। এর পাশাপাশি সেখানে ইসলামী শাসক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল। ক্রমান্বয়ে উয়াইনা থেকে জ্বলে ওঠা শরীআতের প্রদীপের আলো ক্রমান্বয়ে পুরো হিজাজকেই আলোকিত করে তোলে, এবং আল্লাহর মেহেরবানিতে হারামাইন শরীফাইন বা মক্কা ও মদীনাও এই আলোতে আলোকিত হয়েছিল। 

বিষয়টা এমন নয় যে মক্কা-মদীনায় দ্বীন ছিল না, আল ইয়াউযুবিল্লাহ। দ্বীন অবশ্যই ছিল, উলামায়ে কিরাম তাঁদের দর্সের মাধ্যমে দ্বীনের আলো জ্বালিয়ে রাখছিলেন। কিন্তু শাসকদের দুর্বলতা, প্রাবৃত্তিক তাড়না ও অন্যান্য কারণে দ্বীনি বিধান প্রায়োগিকভাবে কায়েম ছিল না, এছাড়া অনেক গোমরাহ মতবাদই প্রভাব বিস্তার করছিল। আর এজন্যই প্রয়োজন ছিল রাষ্ট্রীয় সংস্কার, যা এই বিষবৃক্ষকে উপড়ে ফেলে মানুষকে নির্ভেজাল দ্বীন পালনের সুযোগ করে দেবে। শাইখের [রাহ.] সংস্কার আন্দোলন এটাকেই বাস্তবায়ন করছিল।

এর ফলে এই আন্দোলনের প্রভাব পূর্ব থেকে পশ্চিমে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। এটা সত্য যে বিরোধীপক্ষ ও বিরোধী শাসকগোষ্ঠী এর বিরুদ্ধে প্রচুর অপপ্রচার চালাচ্ছিল। এটা কেবল তখনই ক্রিয়াশীল ছিল এমন নয়; বরং এরপরে শত বছর ব্যাপী এই অপপ্রচার চালু ছিল। এছাড়া ইউরোপীয় শক্তিবর্গও এই আন্দোলনের প্রভাব বুঝতে সক্ষম হয়েছিল। অনেক এলাকাতেই স্থানীয় গোত্রপতি ও ধর্মগুরুদের সহায়তা ইউরোপীয়রা পেয়েছিল। কিন্তু কোনো সংস্কারবাদী আন্দোলন এলে শুরুতেই ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের খুঁটি অর্থাৎ গোত্রপতি ও বিদআতী ধর্মগুরুদের ভিত যে তা নাড়িয়ে দেবে এটা তারা খুব ভালোভাবেই অনুধাবন করেছিল। ফলে তারাও এই আন্দোলনকে প্রতিহত করতে শক্তি নিয়োগ করে, বিভিন্ন অপপ্রচার চালায়। এজন্য আমরা দেখি যে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনবিরোধী আন্দোলনকারী মুসলিমদের ওয়াহাবী ট্যাগ দেয়া হয়েছিল।

এরপরও আল্লাহর মেহেরবানীতে বিভিন্ন এলাকায় শাইখের [রাহ.] আন্দোলন সম্পর্কে সঠিক মতামত পৌঁছেছিল, এবং বিভিন্ন অঞ্চলের সচেতন আলিমগণ শাইখের [রাহ.] ও তাঁর আন্দোলনের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। এমন কিছু প্রশংসাবাণী আমরা আমাদের সামনে উপস্থাপন করতে যাচ্ছি। কেননা বিভিন্ন সময়ের অনেক ধর্মীয় ব্যক্তির কলমে শাইখের [রাহ.] ব্যাপারে যেসকল বেঠিক- কুরুচিপূর্ণ কথা লেখা হয়েছে, সেগুলো অনেকেই উদ্ধৃত করেন। এগুলো সহজে খুঁজেও পাওয়া যায়। কিন্তু একই সময়ে অনেক মহান আলিম ও প্রসিদ্ধ ব্যক্তিও যে শাইখের প্রশংসা করেছেন, তা বেমালুম চেপে যাওয়া হয়, অথবা সেগুলো খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হয়ে যায়। 

 এখানে সেসকল আলিমকে উদ্ধৃত করা হচ্ছে যারা সরাসরি এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন না। আলিম ছাড়াও কয়েকজন প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্বেরর মন্তব্যও এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। 

) আল্লামামুহাম্মাদরাশীদরিদ্বা [রাহ.]: আল্লামা মুহাম্মাদ রাশীদ রিদ্বার জন্ম ১৮৬৫ সালে, মৃত্যু ১৯৩৫ সালে। তিনি ছিলেন হাদিস, তাফসির, আরবি সাহিত্য ও ইতিহাসের প্রখ্যাত আলিম এবং একজন সংস্কারবাদী ব্যক্তিত্ব। তাঁর জন্ম হয় আধুনিক লেবাননের কালামুনে, মৃত্যুর পর কায়রোয় দাফন হন। 

তাঁর কর্মক্ষেত্রে শাম থেকে মিসরে পরিব্যাপ্ত ছিল। এছাড়া তিনি ভারত, হিজাজ ও ইউরোপও সফর করেন। তাঁর প্রসিদ্ধ পত্রিকা ছিল “আল মানার”। 

আল্লামা রিদ্বা তাঁর প্রসিদ্ধ পত্রিকা আল মানারে ১৩৪৩ হিজরীর যুল হিজ্জাহ অর্থাৎ জুন-জুলাই, ১৯২৫ সালের সংখ্যায় শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবন তাইমিয়াহ [রাহ.] নিয়ে নিবন্ধ লেখেন ‌‌أثارة من التاريخ অর্থাৎ ইতিহাসের তাঁর প্রভাব শিরোনামে। 

এর প্রতিপাদ্য ছিল

في حالة نجد قبل الشيخ محمد عبد الوهاب

وما قام به من التجديد والإصلاح

“শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহহাবের পূর্বে নজদের অবস্থা এবং তাঁর মাধ্যমে যে সংস্কার ও সংশোধন সাধিত হয়েছে”।

নিবন্ধটিতে যেসব আলোচনা এসেছে সেগুলো এই বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে তিনি শাইখের [রাহ.] পূর্বে নজদের অবস্থা, শাইখের জীবনী, ইলম অর্জন, সংস্কার আন্দোলন এসব কিছু নিয়েই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন। 

শাইখ ইবন আব্দিল ওয়াহহাব [রাহ.] এর পঠন-পাঠন সম্পর্কে আল্লামা রিদ্বা লিখেছেন, 

‌كان ‌الشيخ ‌محمد ‌بن ‌عبد ‌الوهاب كثير المطالعة والتدبر والتفكر

شديد الشوق إلى العلم وطلبه

“শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহহাব প্রচুর পড়াশোনা, গভীর চিন্তা ও অনুধ্যান করতেন। ইলম ও ইলম অর্জনের প্রতি তাঁর ছিল প্রবল আকাঙ্ক্ষা”।

শাইখ-কে শাইখুল ইসলাম উপাধিতে ভূষিত করে শাইখের দাওয়াহ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, 

“শাইখুল ইসলাম মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহহাব [রাহ.]-এর দাওয়াহ ছিল মানুষকে আল্লাহর একত্বের দিকে ও আল্লাহর ইবাদাতের দিকে আহ্বান করা, আর আল্লাহ ব্যতীত অন্য সব কিছুর ইবাদাতকে বর্জন করা। তাঁর এই আহ্বানে তারা সাড়া দিল, যারা আল্লাহর জন্য হকের দিশা পাবার আকাঙ্ক্ষী ছিল। অতঃপর যারা দ্বীনে ইসলামে প্রবেশ করতে অস্বীকৃতি জানালো তিনি আল্লাহর জন্য তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করলেন। এক পর্যায়ে দলে দলে মানুষ আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করলো। সাধারণ-বিশেষ নির্বিশেষে সকল মানুষই এর সাক্ষ্য, তাঁর সমমনা ব্যক্তিরা যেমন এটা স্বীকার করবে, বিরোধী পক্ষকেও এটা মানতে হবে। হক তো সেটাই যার সাক্ষ্য শত্রুরাও দিতে বাধ্য হবে”। 

এরপর আল্লামা রাশীদ রিদ্বা [রাহ.] এর স্বপক্ষে খৃষ্টান ঐতিহাসিকদের বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। এই নিবন্ধের শেষে আমি কয়েকজন খৃষ্টান প্রাচ্যবিদের নাম এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছি। 

এছাড়া আল্লামা রিদ্বা ১৩৪৪ হিজরীর যুল কা’দাহ সংখ্যা মোতাবেক মে-জুন, ১৯২৬ সালের সংখ্যায় ‌‌مقدمة مجموعة مقالات

الوهابيون والحجاز, “ওয়াহাবীরা ও হিজাজ শীর্ষক নিবন্ধসমূহের ভূমিকা”-শীর্ষক একটি নিবন্ধ লেখেন। এতে তিনি এক স্থানে লেখেন:

وكان الشيخ محمد عبد الوهاب رحمه الله مجددًا للإسلام في بلاد نجد بإرجاع

أهله عن الشرك والبدع التي فشت فيهم إلى التوحيد والسنة على طريقة شيخ

الإسلام ابن تيمية

“শাইখুল ইসলাম মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহহাব [রাহ.] ছিলেন নজদ ভূখণ্ডে ইসলামের একজন মুজাদ্দিদ বা সংস্কারক। তিনি নজদে পরিব্যাপ্ত শির্ক ও বিদআত থেকে সরিয়ে এনে মানুষকে শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়ার [রাহ.] পন্থায় কুরআন ও সুন্নাহর দিকে ধাবিত করেন”। 

) আল্লামাতুশশামমুহাম্মাদবাহজাহআলবাইতারআশশাফিঈ [রাহ.]: 

শাইখ মুহাম্মাদ বাহজাহ আল বাইতার ছিলেন সিরিয়ার প্রসিদ্ধ আলিমে দ্বীন, শাফিঈ ফিকহের প্রসিদ্ধ ফকীহ, ভাষাবিদ ও সাহিত্যিক । তাঁর জন্ম ১৮৯৪ সালে দামেস্কের মায়দান মহল্লায়, মৃত্যুও ১৯৭৬ সালে দামেস্কেই হয়। তিনি আরেক প্রসিদ্ধ শাফিঈ আলিম, ইমাম জামালুদ্দীন কাসিমীর [রাহ.] ঘনিষ্ঠ ছাত্র ছিলেন। কর্ম জীবনে তিনি দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য অনুষদে অধ্যাপনা করেন এবং সেখানে তাফসির ও হাদিস পড়ান। এছাড়া দামেস্কের মাজমাউল লুগাতিল আরাবিয়্যাহ ও ইরাকের মাজমাউল ইলমীল ইরাকীর সভ্য ছিলেন। 

শাইখ মুহাম্মাদ বাহজাহ [রাহ.] শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়ার [রাহ.] জীবনী নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন যার নাম, “হায়াতু শাইখিল ইসলাম ইবন তাইমিয়াহ”। গ্রন্থটি দামেস্কের আল মাকতাবুল ইসলামী লিত তাবাআতি ওয়ান নাশর ১৯৬১ সালে প্রকাশ করে। বইটির মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ২২৪। 

এর ২০০নং পৃষ্ঠায় তিনি বলেন, “ওয়াহাবীদের এবং ইমাম মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহহাবের [রাহ.] কোনো সুনির্দিষ্ট মাযহাব নেই (অর্থাৎ তাঁরা কট্টরভাবে মাযহাব অনুসরণ করতেন না); বরং তিনি রাহিমাহুল্লাহ ছিলেন ইসলামী দাওয়াতের ক্ষেত্রে একজন মুজাদ্দিদ বা সংস্কারক। আর তিনি ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলের [রাহ.] ইত্তিবা বা অনুসরণ করতেন”।

) আল্লামাখাইরুদ্দীনআযযিরিকলী [রাহ.]: 

আল্লামা খাইরুদ্দীন আয যিরিকলীর [রাহ.] জন্ম ১৮৯৩ সালে লেবাননের বৈরুতে, মৃত্যু ১৯৭৬ সালে। তিনি ছিলেন একজন প্রখ্যাত চরিতাভিধান বিশারদ। তাঁর প্রসিদ্ধ কীর্তি হচ্ছে “আল আ’লাম” নামক ৮ খণ্ডের চরিতাভিধানটি (Biographical dictionary), যার খ্যাতি এখনো জগৎজোড়া। 

তিনি এই চরিতাভিধানে শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহহাব [রাহ.] কে নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি শাইখের পরিচয় দিতে গিয়ে লিখেছেন, 

زعيم النهضة الدينية الإصلاحية الحديثة في جزيرة العرب

“আরব উপদ্বীপের সাম্প্রতিক সময়ের দ্বীনি সংস্কারমূলক রেনেসাঁর প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিলেন”।

এরপর তিনি বলেন, “তিনি সালাফুস সালিহের মানহাজে চলে মানুষকে নির্ভেজাল তাওহিদের দিকে আহ্বান করেন, বিদআত বর্জনের আহ্বান করেন। এছাড়া যেসব ভ্রান্ত ধারণা ইসলামের নামে চেপে বসেছিল, তিনি সেগুলো চূর্ণবিচূর্ণ করে দেন”।

তিনি আরও বলেন: تأثر بها رجال الإصلاح في الهند ومصر والعراق والشام وغيرها

“তাঁর দাওয়াতের মাধ্যমে ভারত, মিসর, ইরাক, শাম ও অন্যান্য অঞ্চলের সংশোধনবাদী ব্যক্তিগণ প্রভাবিত হন”। 

তিনি এরকম কিছু ব্যক্তিত্বের লিস্টও প্রদান করেন, যেমন:

১) বাগদাদের প্রসিদ্ধ আলিম আলুসী আল কাবীর [রাহ.],

২) শামের ইমাম জামালুদ্দীন কাসিমী [রাহ.],

৩) উসমানী সাম্রাজ্যের প্রধান উজির এবং এক কালে তিউনিসিয়ার বেইলিকের প্রথম প্রধানমন্ত্রী খাইরুদ্দীন তিউনিসী [রাহ.],

৪) ভূপালের নবাব আল্লামা সিদ্দীন হাসান খান [রাহ.] প্রমুখ। 

উসমানীদের সাথে ওয়াহাবীদের সংঘর্ষের পরও খোদ উসমানী সাম্রাজ্যের প্রধান উজিরের প্রভাবিত হওয়াটা এদিকে ইঙ্গিত করে যে, হতে পারে সেই সংঘর্ষ ছিল নিছক রাজনৈতিক। এ বিষয় নিয়ে আমরা ইন শা আল্লাহ অন্য নিবন্ধে আলোচনা করব। 

) ইমামকাদ্বীআশশাওকানী [রাহ.]: 

ইমাম মুহাম্মাদ বিন আলী আশ শাওকানী [রাহ.] ছিলেন ইয়ামানের প্রসিদ্ধ ফকীহ, মুজতাহিদ ও ইমাম। তাঁর জন্ম ১৭৬০ সালে ইয়ামানের খাওলানে। তিনি ১৮৩৪ সালে মারা যান, এসময় তিনি সানআর বিচারক ছিলেন। তিনি নাইলুল আওতার, আল ফাওয়াইদুল মাজমুআহ, আদ দুরারুল বাহিয়্যাহ, ফাতহুল কাদীর ইত্যাদি প্রসিদ্ধ গ্রন্থের প্রণেতা। 

ইমাম শাওকানী [রাহ.] একটি ঘটনা উল্লেখ করতে গিয়ে শাইখ ইবন আব্দিল ওয়াহহাবের [রাহ.] বিশেষণ এভাবে উল্লেখ করেন, 

الشيخ العلامة محمد بن عبد الوهاب الداعي إلى التوحيد المنكر على المعتقدين في الأموات

“আশ শাইখ আল আল্লামা মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহহাব, যিনি ছিলেন তাওহিদের দিকে আহ্বানকারী এবং মৃত ব্যক্তিদের (ক্ষমতায়) বিশ্বাসীদের প্রত্যাখ্যানকারী”।

তিনি শাইখের রচিত আকিদা বিষয়ক রিসালাহ (চিঠি/পুস্তিকা) দেখে উল্লেখ করেন, 

وهي رسائل جيدة مشحونة بأدلة الكتاب والسنة

“তাঁর এসকল রিসালাহ অত্যন্ত উত্তম এবং কুরআন ও হাদিসের দলীলে ভর্তি”।

শাইখের ওপর উপস্থাপিত আপত্তির জবাবে শাইখ যেসব উত্তর লিখেছেন, তা দেখে ইমাম শাওকানী [রাহ.] বলেন, 

تدل على أن المجيب من العلماء المحققين العارفين بالكتاب والسنة

“(এসব জবাব থেকে) বোঝা যায় যে উত্তরদাতা ব্যক্তি মুহাক্কিক আলিমদের একজন এবং কিতাব ও সুন্নাহ সম্পর্কে অভিজ্ঞ”।

তিনি আরও বলেন, 

فرأيت جوابه مشتملا على اعتقاد حسن موافق للكتاب والسنة 

“আমি তাঁর দেয়া উত্তরগুলো দেখেছি, এগুলোতে আকিদাহ সম্পর্কিত যে আলোচনা রয়েছে তা সুন্দর এবং কুরআন ও সুন্নাহর সাথে সংগতিপূর্ণ”।

) মুহাম্মাদকুর্দআলী

মুহাম্মাদ কুর্দ আলীর জন্ম ১৮৭৬ সালে, মৃত্যু ১৯৫৩ সালে। তিনি ছিলে প্রখ্যাত সিরীয় সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও সাহিত্যিক। আল মুক্তাবাস ম্যাগাজিনের প্রকাশক এবং দামেস্কের আল মাজমাউল ইলমিল আরাবির প্রধান। 

শাইখের [রাহ.] প্রশংসা আলিমগণ ছাড়াও অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ করেছেন, যাদের মাঝে সাংবাদিক ও সাহিত্যিক ব্যক্তিত্বও রয়েছেন। এ হিসেবে মুহাম্মাদ কুর্দ আলীর বক্তব্য উল্লেখ করাও সমুচিত হবে। 

তিনি স্বীয় কিতাব “আল কাদীম ওয়াল হাদিসে” লিখেছেন, “ইবন আব্দিল ওয়াহহাব ছিলেন একজন দাঈ। তিনি মানুষকে গোমরাহী থেকে হিদায়াতের দিকে পথপ্রদর্শন করেছেন। তিনি মানুষকে মহান দ্বীনের দিকে তাড়িয়ে নিয়েছেন”।

) আল্লামামাহমূদশুকরীআলআলুসীআশশাফিঈ [রাহ.]: 

আল্লামা মাহমূদ শুকরী আল আলূসী [রাহ.] ছিলেন ইরাকের প্রখ্যাত আলিমে দ্বীন, ইতিহাসবিদ ও সাহিত্যিক। তিনি প্রসিদ্ধ মুফাসসির “তাফসিরে রূহুল মাআনী” প্রণেতা ইমাম শিহাবুদ্দীন আলূসীর [রাহ.] নাতি। জন্ম ১৮৫৭ সালে, মৃত্যু ১৯২৪ সালে। 

আল্লামা আলূসী [রাহ.] কেবল শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহহাবের [রাহ.] প্রশংসা করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি তাঁর ওপর আরোপিত বিভিন্ন অভিযোগ খণ্ডন করেছেন, এমনকি শাইখের কিতাবের ব্যাখ্যাও করেছেন। অথচ সেটা এমন এক সময় ছিল যখন আধুনিক সৌদি রাষ্ট্র ঠিকমত প্রতিষ্ঠিতও হয়নি। 

এ বিষয়ক তাঁর গ্রন্থ, “গায়াতুল আমানী ফীর রাদ্দি আলান নাবহানী”। 

শাইখ ইবন আব্দিল ওয়াহহাব [রাহ.] এর কিতাব “মাসাইলুল জাহিলিয়্যাহ” এর ব্যাখ্যা করে তিনি লিখেছেন, “ফাসলুল খিতাব ফী শারহি মাসাইলিল জাহিলিয়্যাহ”। 

এর ভূমিকায় তিনি শাইখের উল্লেখ করেন এভাবে-

ألفها الإمام محيي السنة، ومجدد الشريعة النبوية، أبو عبد الله ‌محمد ‌بن ‌عبد ‌الوهاب النجدي الحنبلي

“এটি রচনা করেছেন আল ইমাম, মুহিউস সুন্নাহ (অর্থাৎ সুন্নাহকে জীবিতকারী), নববী শরীআতের মুজাদ্দিদ, আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহহাব আন নাজদী আল হাম্বলী [রাহ.]”।

) আল্লামামুহাম্মাদবাশীরআসসাহসাওয়ানী [রাহ.]: 

আল্লামা সাহসাওয়ানী [রাহ.] ছিলেন ভারতের প্রখ্যাত আলিমে দ্বীন, হাদিস ও ফিকহের আলিম। তাঁর জন্ম ১৮৩৪ সালে ভারতের বর্তমান উত্তর প্রদেশের সাহসাওয়ানে। মৃত্যু ১৯০৮ সালে।

মক্কার শাফিঈ আলিম আহমাদ যাইনী দাহলান শাইখ ইবন আব্দিল ওয়াহহাবের [রাহ.] বিরুদ্ধে কিতাব লেখেন, যা সেসময় রাষ্ট্রীয় অবস্থান থেকেও সমর্থন পাচ্ছিল। এর বিরুদ্ধে আল্লামা সাহসাওয়ানী [রাহ.] নিছক দ্বীনি দায়িত্ববোধ থেকে এটি খণ্ডন করে লেখেন, “সিয়ানাতুল ইনসান আন ওয়াসওয়াসাতিশ শাইখ দাহলান”। বইটি ৫৩৯ পৃষ্ঠার। মূলত যাইনী দাহলানের সাথে তাওহিদ প্রশ্নে আল্লামা সাহসাওয়ানী [রাহ.] সরাসরি বিতর্ক করেছেন। এছাড়া তিনি মির্জা গোলাম আহমেদ কাদিয়ানীর সাথেও বিতর্ক করেছেন। 

যা-ই হোক, এই বইয়ের শুরুতে তিনি হাদিসে আসা মুজাদ্দিদদের আলোচনা করে লিখেছেন, 

ولقد كان الشيخ ‌محمد ‌بن ‌عبد ‌الوهاب النجدي من هؤلاء العدول المجددين

“আর অবশ্যই শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহহাব আন নাজদী ছিলেন সেসকল ন্যায়পরায়ণ মুজাদ্দিদদের একজন”।

) আল্লামামাওলানামানযূরনুমানী [রাহ.]: 

মাওলানা মানযূর নু’মানী [রাহ.] ছিলেন রাবিতাতুল আলামিল ইসলামীর সদস্য, দারুল উলুম দেওবন্দের মজসিলে শূরা ও মজলিসে আমেলার সদস্য, দারুল উলুম নাদওয়াতুল উলামা, লক্ষ্ণৌ এর শাইখুল হাদিস এবং জামাআতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। 

বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের অধিকারী এই হানাফী আলিমের জন্ম ১৯০৫ সালে, ব্রিটিশ ভারতের যুক্তপ্রদেশের সম্ভোলে। মৃত্যু ১৯৯৭ সালে উত্তর প্রদেশের লক্ষ্ণৌ-তে।

শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহহাব [রাহ.] সম্পর্কে তাঁর ইলমের হাতেখড়ি হয় স্বীয় উস্তায হযরত মাওলানা করিম বখশ সম্ভোলীর [রাহ.] হাতে। মাওলানা করিম বখশ [রাহ.] শাইখুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দীর [রাহ.] সেরা ছাত্রদের একজন। কর্মজীবনে তিনি মাদ্রাসা জামিউল উলুম, কানপুরের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। এছাড়া আজমগড়ের দারুল উলুম মাউ এর প্রধান শিক্ষকও ছিলেন। মুহাদ্দিসে কাবির মাওলানা হাবিবুর রহমান আজমী, মাওলানা আব্দুল লতিফ আজমী ও মাওলানা মানযূর নু’মানী [রাহ.] তাঁর তত্ত্বাবধায়নে হাদিসের কিছু কিতাব অধ্যয়ন করেন। 

মাওলানা করিম বখশ [রাহ.] শাইখ ইবন আব্দিল ওয়াহহাবের [রাহ.] “কিতাবুত তাওহিদ” গ্রন্থের ভূয়সী প্রশংসা করতেন। তিনি স্বীয় ছাত্রকেও তা পড়তে উদ্বুদ্ধ করেন। 

ফলে পরিণত বয়সে মাওলানা নু’মানী [রাহ.] সিদ্ধান্ত নেন যে শাইখ [রাহ.] এর ব্যাপারে যেসব ভুল ধারণা ভারতের উলামার মাঝে প্রচলিত রয়েছে তা খণ্ডন করা জরুরি। তাই তিনি “শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহহাব আউর হিন্দুস্তান কে উলামায়ে হক” নামে ১৪২ পৃষ্ঠার একটি বই লিখেন। বইটির প্রশংসা ও এর বক্তব্যের সত্যায়ন ও সমর্থন করেন তাবলীগ জামাআতের নেসাবের লেখক শাইখুল হাদিস যাকারিয়া কান্ধলভী [রাহ.] এবং দারুল উলুম দেওবন্দের অধ্যক্ষ ক্বারী মুহাম্মাদ তাইয়্যিব [রাহ.]।

এই বইয়ের সূচনায় মাওলানা নু’মানী [রাহ.] লিখেছেন, “তাঁর (শাইখের) মাসলাক (কর্মপদ্ধতি) ও নীতি অনেকটা সেটাই ছিল যা শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়াহ [রাহ.] ও তাঁর ছাত্র হাফিয ইবনুল কাইয়্যিম [রাহ.] ও অন্যান্যদের ছিল। আর শির্ক প্রতিহতকরণ এবং ইখলাস ও তাওহিদের দিকে দাওয়াত দেয়ার ক্ষেত্রে উনার কর্মপদ্ধতি (কিছু পার্থক্যসহ) সেটাই ছিল, যা হযরত শাহ ইসমাঈল শহীদের [রাহ.] ‘তাকউইয়াতুল ঈমান’ গ্রন্থে ছিল”।   

) আল্লামাআবুইয়ালাআযযাওয়াউইআলমালিকী [রাহ.]: 

আল্লামা আয যাওয়াউই [রাহ.] ছিলে আলজেরিয়ার প্রসিদ্ধ মালিকী আলিম, ইসলামী কলামিস্ট, ফকীহ ও ইতিহাসবিদ । তাঁর জন্ম ১৮৬২ সালে আলজেরিয়ার তিযি ওযু প্রদেশে। মৃত্যু ১৯৫২ সালে। 

তিনি শাইখের [রাহ.] আন্দোলন ও শাইখ সম্পর্কে প্রচুর লিখেছেন। আলজেরিয়ায় প্রচলিত ছিল যে ‘ওয়াহাবীরা’ হচ্ছে মু’তাযিলা! সুবহানআল্লাহ! 

আল্লামা আয যাওয়াউই [রাহ.] এই ধারণার খণ্ডন করেন। আশ শিহাব পত্রিকার ১৩৪৫ সালের ২ যুল কা’দাহ সংখ্যায় ওয়াহাবীরা মু’তাযিলা কি না এই প্রশ্নের জবাবে লেখেন:

أن الإخوان الوهابيين حنابلة يتعبدون على مذهب الإمام أحمد بن حنبل الذي هو أحد المذاهب الأربعة المشهورة

“আমাদের ওয়াহাবী ভাইয়েরা মূলত হাম্বলী। তারা ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলের [রাহ.] মাযহাব অনুযায়ী ইবাদাত করে থাকেন, যা কি না প্রসিদ্ধ ৪ মাযহাবের একটি”।

এই সংখ্যার ৪র্থ পৃষ্ঠায় তিনি শাইখ সম্পর্কে লেখেন, إن [ ابن] عبد الوهاب حنبلي ، وإنما هو عالم إصلاحي

“ইবন আব্দিল ওয়াহহাব ছিলেন হাম্বলী। তিনি ছিলেন একজন সংশোধনকামী আলিম”।

“আস সীরাতুস সাউই” পত্রিকার ৪ রজব ১৩৫২ হিজরীর সংখ্যায় তিনি শাইখকে স্মরণ করেন, العلامة المرحوم الشيخ محمد بن عبد الوهاب

“আল আল্লামা মরহুম আশ শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহহাব” বলে। 

এই সংখ্যায় তিনি উল্লেখ করেন যে আল্লাহ তাআলার আরশে সমুন্নত হওয়া, কবরের ওপর ইমারত নির্মাণ করা, এর মাধ্যমে তাওয়াসসুল করা তথা উসিলা ধরা এসব মাসআলায় শাইখের মত সেটাই যা মালিকী মাযহাবের অনুরূপ। তাই তিনি শাইখের [রাহ.] সংস্কার আন্দোলনকে মালিকী মাযহাবে ইমাম আশ শাতিবীর [রাহ.] সংস্কারের সাথে তুলনা করে লিখেছেন, 

نبههم إليه محمد بن عبد الوهاب ، كما نبهنا نحن أبو إسحاق الشاطبي صاحب كتاب ” الاعتصام ” وأمثاله

“তাদেরকে (আরবের লোকদের) মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহহাব [রাহ.] সেভাবেই এসব বিষয়ে সতর্ক করে জাগ্রত করেছেন যেভাবে আমাদেরকে ‘আল ই’তিসাম’ গ্রন্থের লেখক আবু ইসহাক আশ শাতিবী [রাহ.] ও তাঁর মত অন্যান্যরা সতর্ক করেছেন”। 

আস সীরাতুত সাউই পত্রিকার ১১ রজব ১৩৫২ সংখ্যায় তিনি ইস্তিগাসা তথা মৃত নেককারদের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা সম্পর্কে লিখেছেন, 

قال أيضا – يعني صاحب ” الشفاء ” – : وقال مالك في ( المبسوط ) : لا أرى أن يقف عند قبر النبي – صلى الله عليه وسلم – ويدعو ، ولكن يسلم ويمضي . قال شارح هذا الموضع شهاب الدين الخفاجي : ظاهره أن مذهب مالك عدم استحباب الوقوف مطلقا

“আর ‘আশ শিফা’ এর লেখক (কাদ্বী ইয়াদ্ব রাহ.), আরও লিখেছেন, ইমাম মালিক (রাহ.) আল মাবসূতে বলেছেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কবরের নিকট অবস্থান করে দুআ করাকে আমি সঠিক মনে করিনা; বরং সেখানে গিয়ে সালাম দেবে আর চলে যাবে। এর ব্যাখ্যায় শিহাবুদ্দীন আল খাফাজী (রাহ.) লিখেছেন, কাজেই এটা স্পষ্ট যে ইমাম মালিকের মাযহাব হচ্ছে (কবরের নিকট) অবস্থান করা শর্তহীনভাবেই অ-মুস্তাহাব”। 

এসব কারণেই যারা শাইখ ইবন আব্দিল ওয়াহহাব [রাহ.] ও তাঁর আন্দোলনের বিরোধিতা করে থাকে তাদেরকে তিনি মালিকী মাযহাবের বিরোধী আখ্যা দিয়ে এই নিবন্ধেই লিখেছেন, 

أقول إن المالكي الذي يطعن في الوهابيين يطعن في مالك ومذهبه من حيث يشعر أو لا يشعر أو لأنه جاهل أو متجاهل

“আর এজন্য আমি বলি যে, যেসকল মালিকী ওয়াহাবীদের ওপর আক্রমণ করে তারা আসলে ইমাম মালিক ও তাঁর মাযহাবের ওপরই আক্রমণ করে থাকে। হয় তারা এটা বুঝে করে, নয় না বুঝে করে। অথবা এর কারণ হচ্ছে তারা অজ্ঞ কিংবা অজ্ঞতার ভান ধরেছে”।

আর এই বিষয়টা সত্যি বিস্ময়কর যে, ২০ শতকের গোড়ার দিকে, যখন যোগাযোগ ব্যবস্থা মোটেও অত ভালো ছিল না, তখন আল্লামা আয যাওয়াউই [রাহ.] আলজেরিয়ায় বসে ভারতের আল্লামা সাহসাওয়ানীর [রাহ.] লেখা কিতাব “সিয়ানাতুল ইনসান”, এবং ইরাকের আল্লামা আলূসীর [রাহ.] লেখা কিতাব “গায়াতুল আমানির” প্রশংসা করেছেন ১২ জুমাদাল আখিরাহ ১৩৫৭ হিজরির “আল বাসাইর” পত্রিকায়।

১০) আল্লামাইবনবাদিসআলমালিকীআলআসারী [রাহ.]: 

আল্লামা আব্দুল হামীদ মাক্কী ইবন বাদিস [রাহ.] এর জন্ম ১৮৮৭ সালে আলজেরিয়ার কন্সটানটাইন শহরে , মৃত্যু ১৯৪০ সালে। তিনি স্বীয় সময়ে আলজেরিয়ার সকল আলিমদের শিরোমণি ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রচণ্ড ঔপনিবেশবাদ বিরোধী। আজীবন ফ্রেঞ্চ উপনিবেশবাদী শক্তির বিরুদ্ধে তিনি জিহাদে লিপ্ত ছিলেন। 

তিনি শাইখ ইবন আব্দিল ওয়াহহাবের [রাহ.] কথা উল্লেখ করতে গিয়ে এই বিশেষণ ব্যবহার করেন:

العلامة النجدي العظيم (محمد بن عبد الوهاب)

“মহান নজদী আল্লামা মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহহাব”।

তিনি এই আন্দোলন সম্পর্কে লেখেন:

وترمي إلى تطهير الإسلام من جميع البدع والخرافات التي لصقت به مع مر الزمن 

“এই আন্দোলন ইসলামকে সেসকল বিদআত ও কুসংস্কার থেকে সংস্কার করছিল যা সময়ের আবর্তনে ইসলামের সাথে এঁটে গিয়েছিল”।

এছাড়া “আস সীরাতুস সাউই”, “আশ শিহাব”-প্রভৃতি পত্রিকাতেও তিনি এ বিষয়ে বিভিন্ন সময় লিখেছেন। 

১১) আল্লামামুবারাকআলমিলী [রাহ.]:  

আল্লামা মুবারাক বিন মুহাম্মাদ আল-মিলী আল-জাযায়েরী [রাহ.] এর জন্ম ১৮৯৬ বা ৯৮ সালে, আর মৃত্যু ১৯৪৫ সালে। ছিলেন প্রসিদ্ধ আলিম, ঐতিহাসিক এবং ইসলামি কলামিস্ট। “আশ শিহাব”, ‘আল বাসাইর”, “আস সুন্নাহ” প্রভৃতি পত্রিকায় লিখতেন। 

আল্লামা আল মিলী [রাহ.] তাঁর অঞ্চলে প্রসারিত শির্ক-বিদআত দেখে খুব কষ্ট পেতেন। এর উপশমের জন্য তিনি একটি গ্রন্থ লেখেন, যার নাম: রিসালাতুশ শির্ক ওয়া মাযাহিরুহ”। 

৪৬৪ পৃষ্ঠার এই বইয়ের শুরুতে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, তিনি ঠিক যে ধরণের বই লিখতে চান তার জন্য প্রয়োজনীয় লেখনী তিনি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। পরে শাইখ আস সাহসাওয়ানীর [রাহ.] “সিয়ানাতুল ইনসান”, ইমাম সানআনীর [রাহ.], “তাতহীরুল ই’তিক্বাদ” আর ইমাম শাওকানীর [রাহ.] “আদ দুরারুন নাদ্বীদ” কিতাবের সাহায্য নিয়ে লেখা শুরু করেন। বইটি লেখা শেষ হবার পর আরব থেকে একজন তাঁকে “ফাতহুল মাজীদ বি শারহি কিতাবিত তাওহিদ” পাঠান। এই বইটি শাইখ ইবন আব্দিল ওয়াহহাবের [রাহ.] কিতাব “কিতাবুত তাওহিদের” ব্যাখ্যা, যা লিখেছেন তাঁরই নাতি আল্লামা আব্দুর রাহমান বিন হাসান আলুশ শাইখ [রাহ.]।

বইটি পেয়ে আল্লামা আল মিলী [রাহ.] অত্যন্ত আপ্লুত হয়ে পড়েন, তিনি লিখেছেন: ولو اطلعت عليه قبل كتابة الرسالة؛ لخفف علي من عناء ابتكار العناوين وتنسيقها

“যদি পুস্তিকাটি লেখার আগেই আমি এই কিতাবটা পড়তে পারতাম, তাহলে বইয়ের শিরোনাম উদ্ভাবন ও সুবিন্যস্তকরণের ক্ষেত্রে আমার কষ্টটা লাঘব হত”। এছাড়া এই বই থেকে তিনি যথেষ্ট ফায়দা পাবার কথাও উল্লেখ করেন। 

১২) আল্লামামুহাম্মাদহামিদআলফাকী [রাহ.]: 

আল্লামা মুহাম্মাদ হামিদ আল ফাকী [রাহ.] ছিলেন মিসরের প্রসিদ্ধ আলিম এবং বিপ্লবী ব্যক্তিত্ব। জন্ম ১৮৯২ সালে, মৃত্যু ১৯৫৯ সালে। পড়াশোনা করেছেন আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশুদ্ধ আকিদাহ বিস্তার, কুরআন ও সুন্নাহের জ্ঞান প্রচার করতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন জামাআতু আনসারিস সুন্নাতিল মুহাম্মাদিয়্যাহ। এই সংগঠনটি এখনো সক্রিয় রয়েছে। 

তিনি বিভিন্ন বিষয়ে প্রচুর গ্রন্থ রচনা করেছেন, এছাড়া তাঁর সম্পাদনায় অনেক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ওয়াহাবী দাওয়াহ নিয়ে তাঁর একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থ রয়েছে, যার নাম: আসারু দাওয়াতিল ওয়াহাবিয়্যাহ। 

এই বইয়ের শুরুতে ওয়াহাবী দ্বারা কী বোঝানো হয় তার ব্যাখ্যায় তিনি লিখেছেন: 

الوهابية: نسبة إلى ‌الإمام ‌المصلح، ‌شيخ الإسلام، محمد بن عبد الوهاب مجدد القرن الثاني عشر

“ওয়াহাবিয়্যাহ: শব্দটি সংস্কারক ইমাম, শাইখুল ইসলাম, মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহহাব, যিনি ছিলেন বারো হিজরি শতকের মুজাদ্দিদ, তাঁর দিকে সম্পৃক্ত করে বলা হয়”। 

এরপর এই শব্দটি কেন সঠিক নয় বরং আরবি ভাষা অনুযায়ী আন্দোলনের নাম মুহাম্মাদিয়্যাহ হওয়া উচিৎ ছিল, এর ব্যাখ্যা করেছেন। 

এই অংশটুকুতেই শাইখ ইবন আব্দিল ওয়াহহাব [রাহ.] সম্পর্কে তিনি যে ভাষায় শব্দ চয়ন করেছেন, তা থেকেই তাঁর ও তাঁর দাওয়াতের প্রতি শাইখ হামিদের [রাহ.] শ্রদ্ধা স্পষ্টভাবেই বোঝা যায়। এটাও বোঝা যায় যে তিনি শাইখকে একজন মুজাদ্দিদ মনে করতেন। 

এরপর তিনি আলোচনা করেছেন যে শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহহাব [রাহ.] মূলত ছিলেন হাম্বলী ফিকহের অনুসারী এবং আকিদায় ছিলেন সালাফে সালিহীনের অনুসারী। শাইখের মাযহাব সম্পর্কে অন্য নিবন্ধে আমরা আলোচনা করেছি, আলহামদুলিল্লাহ। 

১৩) উস্তাযআব্দুলমুতাআলআসসাঈদী [রাহ.]: 

উস্তায আব্দুল মুতাআলের জন্ম ১৮৯৪ সালে, মৃত্যু ১৯৬৬ সালে। ছিলেন আরবি ভাষাবিদ ও সাহিত্যিক। আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ভাষা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন, মাজমাউল লুগাতিল আরাবিয়্যার সদস্য ছিলেন। 

তাঁর একটি প্রখ্যাত বই হচ্ছে “আল মুজাদ্দিদুন ফিল ইসলাম”। এই গ্রন্থে তিনি ইসলামের ইতিহাসে যেসকল মুজাদ্দিদের আগমন ঘটেছে তাঁদের তালিকাবদ্ধ করতে চেষ্টা করেছেন। 

এই গ্রন্থে হিজরি ১২ শতকের মুজাদ্দিদদের নাম তালিকাবদ্ধ করতে গিয়ে ২য় অবস্থানে শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহহাবের [রাহ.] নাম উল্লেখ করেন।

১৪) হাফিযওয়াহবাহ

হাফিয ওয়াহবাহ ছিলেন একজন কূটনৈতিক, মিসরের ব্রিটিশ বিরোধী উভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা, এজন্য তাঁকে মাল্টায় নির্বাসন জীবনও কাটাতে হয়। আল আযহারের গ্র্যাজুয়েট ছিলেন, পাশাপাশি মিসরের প্রধান মুফতী উস্তায মুহাম্মাদ আব্দুহুর ছাত্রও ছিলেন। তাঁর জন্ম ১৮৮৯ সালে, মৃত্যু ১৯৬৭ সালে। 

তিনি স্বীয় গ্রন্থ “খামসুনা আমা ফি জাযিরাতিল আরব” এ লিখেছেন, 

ولكنه مصلحٌ مجدد، داع إلى الرجوع إلى الدين الحقّ،

“বরং তিনি (শাইখ) ছিলেন একজন সংস্কারক মুজাদ্দিদ। তিনি মানুষকে দ্বীনে হকের দিকে আহ্বান করেছেন”। 

এছাড়া তিনি স্বীয় উস্তায মুফতী মুহাম্মাদ আব্দুহু এর মত সম্পর্কে লিখেছেন যে, “তিনি স্বীয় উস্তায, মিসরের মুফতী, ইমাম মুহাম্মাদ আব্দুহুকে আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বীয় দর্সসমূহে শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহহাবের প্রশংসা করতে শুনেছেন। তিনি তাঁকে আল মুসলিহুল আযীম বা মহান সংস্কারক হিসেবে অভিহিত করতেন”।

এ পর্যন্ত আমরা বিভিন্ন প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্বের মন্তব্য উল্লেখ করেছি, যাদের মাঝে অধিকাংশই আলিম। এছাড়া অন্যান্য আরও অনেক ব্যক্তির মন্তব্য ইতিহাসের পাতায় রয়েছে, আলোচনা অতি বিস্তৃত হবার আশঙ্কায় সেগুলো পরিহার করছি।

উদাহরণস্বরূপ: আব্বাস মাহমুদ আক্কাদ, মুহাম্মাদ বাহী, আহমাদ আমীন প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।

এছাড়া অমুসলিম ওরিয়েন্টালিস্ট যেমন চার্লস ম্যানজিন(Charles Mangin), বার্নার্ড লুইস (Bernard Lewis), Johann Ludwig Burckhardt, Theodore Lothrop Stoddard, Carl Brockelmann প্রমুখ গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। 

নিবন্ধটি শেষ করছি দেওবন্দী ধারার প্রখ্যাত আলিম ড. মুফতী ইয়াসির নাদিম আল ওয়াজিদীর [হাফি.] মন্তব্য দিয়ে। তিনি দ্বীনের তাজদিদ তথা সংস্কার-পুনর্জাগরণের বিষয়ে ঊর্দূ ভাষায় একটি চমৎকার বই লিখেছেন যার নাম, “তাজদিদে দ্বীন: শারীআত আউর তারিখ কি রাউশনি মে”। এই গ্রন্থে তিনি দ্বীনের মুজাদ্দিদদের তালিকা দিতে গিয়ে লিখেছেন, “ইমাম মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহহাব নাজদী[রাহ.]”

অতঃপর তাঁর পরিচয় দিয়ে গিয়ে লিখেছেন, “তাওহিদ ও রিসালাতের রক্ষক, কুরআন ও সুন্নাতের প্রচারক, কুফর ও বিদআতের বিনাশকারী, শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহহাব বিন সুলাইমান নাজদীও (১১১৫-১২০৬ হি.) মুজাদ্দিদের সিলসিলা বা চেইনের সেই মুবারক আঙটা, যার তাজদিদ বা সংস্কারমূলক খেদমত কেবল ১২ হিজরি শতককেই প্রভাবিত করেনি; বরং অনাগত শতাব্দীগুলোকেও প্রভাবিত করেছে। তাঁর ইসলাহী বা সংশোধন-সংস্কারমূলক আন্দোলন কেবল নজদ অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং এর প্রভাব পুরো আরব উপদ্বীপ এবং এর আশেপাশের এলাকায়ও পৌঁছে গিয়েছিল”।

References:

1 আল্লামা আয যিরিকলী (রাহ.), আল আ’লাম: ৬/১২৬ 

2 https://hijricalendars.com/hijri/1343 

3 মাজাল্লাতুল মানার: ২৬/২০০ 

4 https://hijricalendars.com/hijri/1344 

5 মাজাল্লাতুল মানার: ২৭/১৭৬ 

6 যাইলুল আ’লাম: ১/১৬৭-৬৮ 

7 আল আ’লাম: ৬/২৫৭ 

8 আল আ’লাম: ৬/২৯৮ 

9 আল বাদারুত তালি’: ১/২৬২ 

10 আল বাদারুত তালি: ২/৭ 

11 আল আ’লাম: ৬/২০২ 

12 আক্বিদাতু মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহহাব আস সালাফিয়্যাহ ওয়া আসারুহা ফি আলামিল ইসলামী: ২/৪১২ 

13 আল আ’লাম: ৭/১৭২ 

14 ফাসলুল খিতাব, পৃ: ২১০ 

15 আল আ’লাম: ৬/৫৩ 

16 সিয়ানাতুল ইনসান, পৃ: ৬

17 History of the Dar al-Ulum Deoband: 2/113

18 History of the Dar al-Ulum Deoband: 2/58

19 পদ্ধতি, পথ- ফারহাংগে আমিরা, পৃ: ৫৮১ 

20 শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহহাব আউর হিন্দুস্তান কে উলামায়ে হক, পৃ: ১৩-১৪ 

21 মু’জামু আ’লামিল জাযাইর, পৃ: ১৬৪ 

22 আল আ’লাম: ৩/২৮৯ 

23 আসারু ইবন বাদিস: ৪/২৩৬ 

24 রিসালাতুশ শির্ক, পৃ: ৩৮ 

25https://ar.wikipedia.org/wiki/%D9%85%D8%AD%D9%85%D8%AF_%D8%AD%D8%A7%D9%85%D8%AF_%D8%A7%D9%84%D9%81%D9%82%D9%8A 

26 আল মুজাদ্দিদুন ফিল ইসলাম, পৃ: ৩৩০ 

27 আশ শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহহাব ফি মিরাআতি উলামাইশ শারক ওয়াল গারব, পৃ: ১২ 

28 মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহহাব আক্বীদাতুহুস সালাফিয়্যাহ, পৃ: ১১৮ 

29 তাজদিদে দ্বীন, পৃ: ৩৫৪